লোভ, অহংকার, হিংসা—এই তিনটি শব্দ শুধু ধর্মশাস্ত্রে নয়, মানবসমাজের যাবতীয় সভ্যতাবোধ, দর্শন ও নৈতিক শৃঙ্খলার জন্যও একপ্রকার অভিশাপ। এগুলোকে অনৈতিক বলার জন্য আলাদা ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। সাধারণ মানবিক বোধ থেকেই বোঝা যায়, এই তিনটি প্রবণতা যেখানেই প্রবেশ করে, সেখানেই বিভেদ, অসন্তোষ এবং ধ্বংস ছড়িয়ে পড়ে। তবে ব্যক্তিজীবনে এই গুণত্রয় যতটুকু ক্ষতিকর, রাজনীতি ও রাষ্ট্রপরিচালনায় তারা তার চেয়ে বহুগুণ বেশি ভয়াবহ। কারণ, ব্যক্তিগত চারিত্রিক দুর্বলতা যখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সঙ্গে মিশে যায়, তখন তা কেবল একটি ব্যক্তি নয়, একটি সমাজ, একটি জাতি ও একটি প্রজন্মকে বিপর্যস্ত করে তোলে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা এই সত্যের জীবন্ত প্রমাণ।
এই লেখায় আমরা অনুসন্ধান করব—কীভাবে এই তিন গুণ বাংলাদেশে রাজনীতিকে রুদ্ধ করেছে, কেন অতীতে কিছুটা হলেও রাজনীতি ছিল উদার ও সহনশীল, এবং কেন আজ আমরা একটি অতল অনৈতিকতার দিকে দ্রুত এগিয়ে চলেছি।
একসময় রাজনীতি ছিল জনগণের
বাংলাদেশের রাজনীতির শুরুটা ছিল স্বপ্নময়, সংগ্রামী এবং আত্মত্যাগে গৌরবান্বিত। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ—এইসব বড় বড় পর্বে যারা রাজনীতিতে এসেছিলেন, তাদের লক্ষ্য ছিল জনগণের অধিকার, জাতীয় মুক্তি এবং ন্যায্য সমাজ প্রতিষ্ঠা। রাজনীতি ছিল নীতি, আদর্শ এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি ভালো সমাজ গঠনের হাতিয়ার।

১৯৫২ সালে ভাষা শহীদরা জানতেন না তারা কোনো মন্ত্রী হবেন, জনপ্রতিনিধি হবেন, গাড়ি-বাড়ির মালিক হবেন। তবু তারা প্রাণ দিয়েছেন ভাষার জন্য। ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলনের কর্মীরাও ছিলেন তেমনি নিঃস্বার্থ। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু যখন বলেছিলেন, “এইবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এইবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”—তখন তিনি জানতেন না এই আন্দোলনের ফলাফল কী হবে, জীবন থাকবে কিনা, সেটাই অনিশ্চিত। তবু রাজনীতি করতেন, কারণ তাদের রাজনীতিতে ছিল আদর্শের স্পর্শ। তাদের মধ্যে অহংকার ছিল না, বরং ছিল জনগণের কাছে দায়বদ্ধতা। হিংসা থাকলেও তা ছিল রাজনৈতিক—প্রতিপক্ষের প্রতি, জাতির জন্য ‘শত্রু’ বিবেচিত ব্যক্তিদের প্রতি। ব্যক্তিগত প্রতিহিংসার জায়গা সেখানে ছিল খুব কম। এবং সর্বোপরি, লোভ—তা একেবারেই ছিল না বলা চলে। ব্যক্তিগত লাভের জন্য কেউ রাজনীতিতে আসেননি, বরং ত্যাগ স্বীকার করেই নেতৃত্বে উঠে এসেছেন।
ক্ষমতা ও লোভের বীজ
তবে ইতিহাসের পরিহাস, স্বাধীনতার পরপরই রাজনীতিতে লোভ ও প্রতিহিংসার বীজ বপিত হতে থাকে। ক্ষমতা, সম্পদ ও রাষ্ট্রীয় সম্পদের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে শুরু হয় প্রতিযোগিতা। বঙ্গবন্ধু চেষ্টা করেছিলেন সমাজতান্ত্রিক আদর্শে রাষ্ট্র পরিচালনার, কিন্তু ততদিনে রাজনীতিতে ঢুকে পড়েছে বহুস্বর, বহুগোষ্ঠীর স্বার্থ ও নানা রকমের সুযোগসন্ধানী লোক। তাঁর জীবনদানের পর দেশের রাজনীতিতে সামরিক হস্তক্ষেপ রাজনীতিকে সম্পূর্ণ অন্য এক ধারায় প্রবাহিত করে। জাতির আদর্শভিত্তিক রাজনীতি ভেঙে পড়ে। সামরিক আমলে সুবিধাবাদী শ্রেণির উত্থান ঘটে, যারা রাজনীতিকে ব্যবসার রূপ দেয়। এই সময় থেকেই রাজনীতি লোভের অন্যতম কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায়।
গণতন্ত্রের নামে গণগ্রাস
নব্বইয়ের গণআন্দোলনের পর দেশে গণতন্ত্র ফিরেছে বটে, কিন্তু প্রকৃত অর্থে কি ফিরে এসেছে? আমাদের রাজনীতি এখন গণতন্ত্রের খোলসে সর্বগ্রাসী দখল ও লোভের দানব হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজকাল দল ক্ষমতায় গেলে শুধু সরকার নয়, রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গ, প্রতিটি খাত, প্রতিটি নিয়োগ, পদোন্নতি, প্রশাসন—সবই দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করতে চায়। তারা চায় শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্ম, এমনকি ক্রীড়া ও বিনোদন জগতেও তাদের একচেটিয়া প্রভাব থাকুক। এই ‘সবকিছু করায়ত্ত’ করার মানসিকতাই লোভের চূড়ান্ত রূপ।
রাজনৈতিক দলের মধ্যকার প্রতিদ্বন্দ্বিতা এখন আর নীতির নয়, বরং কে কত দ্রুত রাষ্ট্রের সম্পদ লুণ্ঠন করতে পারে, কে কত মানুষ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে—এই প্রতিযোগিতা। তাই একদল ক্ষমতায় থাকলে অন্যদল শুধুই নিষ্পেষিত হয়, আর ক্ষমতায় গেলে পুরোনো প্রতিশোধ নেয়। এই প্রতিহিংসার চক্রই রাজনীতিকে করেছে হিংসার রাজনীতিতে পরিণত।

জনগণ নয়, নেতাই দেশ
রাজনীতির মূলনীতি হওয়া উচিত ‘জনগণই সবকিছুর উৎস’। কিন্তু এখন আমরা এমন এক রাজনৈতিক চর্চা দেখছি, যেখানে মনে হয় দলপ্রধানই দেশ, নেতা মানেই সংবিধান। এই অহংকার রাজনীতির সবচেয়ে বিপজ্জনক গুণ। কারণ, অহংকার মানুষকে সমালোচনা সহ্য করতে দেয় না। গণতন্ত্রের শত্রু হলো এমন নেতৃত্ব, যারা প্রশ্ন শুনতে চায় না।
আজ যে নেতা বা দল ক্ষমতায় আছে, তারা মনে করে তারা অপরিহার্য। তাদের কোনো ভুল হয় না। তারা সংবিধান, আইন, ন্যায়—সবকিছু ব্যাখ্যা করে নিজের সুবিধামতো। তারা নিজেদের বিরোধীকে জনগণের শত্রু হিসেবে তুলে ধরেন। নির্বাচন, গণমাধ্যম, বিচার—সবকিছুকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করেন যেন তারা চিরস্থায়ী সম্রাট। এভাবেই রাজনীতি থেকে সহনশীলতা ও দায়বদ্ধতা উঠে যায়। যে অহংকার শাসকদের মনে জন্ম নেয়, তা অন্ধ করে দেয় পুরো ব্যবস্থাকে।
হিংসা ও প্রতিহিংসা
১৯৭৪-৭৫ সালে দেশে রাজনৈতিক হিংসার যে বীজ বপন হয়েছিল, তা আজ পুরোপুরি মহীরুহে পরিণত। রাজনীতির মাঠ এখন যুদ্ধক্ষেত্র। গুলিবর্ষণ, মিছিল ঠেকাতে গুলি, গণগ্রেপ্তার, নেতা-কর্মীদের বাড়িতে গিয়ে হামলা—এসব এখন এতটাই স্বাভাবিক যে আমরা আর বিস্মিত হই না।
ছাত্ররাজনীতিতে এটি আরও ভয়ংকর। হল দখল, দলীয় পরিচয়ের বাইরে কাউকে থাকতে না দেওয়া, সাংগঠনিক বিরোধে খুন, নির্যাতন, গুম—এসব রীতিমতো গৃহীত সংস্কৃতি হয়ে উঠেছে। হাসপাতাল, বিশ্ববিদ্যালয়, এমনকি আদালত—এসবও রাজনীতির প্রতিহিংসা থেকে মুক্ত নয়। বিরোধীদের দমন করতে রাষ্ট্রীয় যন্ত্র ব্যবহার, মামলা, সাজানো অভিযোগ, পাসপোর্ট জব্দ—এসবই এখন ‘পলিসি’। এভাবে একটা রাষ্ট্রের মধ্যে রাষ্ট্র তৈরি হয়—একটি ভয়ঙ্কর, প্রতিহিংসামূলক, লোভাতুর ব্যবস্থা।
কেন দরকার ছিল উদারতা, কেন তা হারালাম?
রাজনীতিতে যে ‘মিনিমাম উদারতা’ প্রয়োজন—তা কি আমরা চিরতরে হারিয়ে ফেলেছি? এই উদারতা মানে এই নয় যে রাজনৈতিক দল প্রতিপক্ষকে ভালোবাসবে। বরং এর মানে হলো—
• বিরোধীদের টিকে থাকার জায়গা থাকবে
• মতপ্রকাশের অধিকার থাকবে
• রাষ্ট্রীয় সম্পদের ওপর সর্বদলীয় অধিকার থাকবে
• সরকার যাবে-আসবে, কিন্তু রাষ্ট্র ও সমাজের স্থিতি থাকবে
এই বোধটাই আজ হারিয়ে গেছে। রাজনীতি মানেই এখন সবকিছু করায়ত্ত করা, অন্য দলকে নিশ্চিহ্ন করা, নিজেদের দলীয় গোষ্ঠীকে বিত্তশালী করা। একসময় সংসদ ছিল বিতর্কের জায়গা, এখন তা একতরফা বুলেটিনে পরিণত হয়েছে। একসময় ছাত্রসংগঠন মানে ছিল আদর্শ, এখন তা মারামারি ও চাঁদাবাজির নাম। একসময় রাজনীতিকরা ছিলেন জনতার নেতা, এখন তারা প্রটোকলের বন্দি।

নাগরিক সমাজও কি দায়মুক্ত?
আমরা যারা রাজনীতিবিদ নই, তারাও কি পুরোপুরি দায়মুক্ত? না। আমরা যখন অন্ধ দলীয় আনুগত্যে চোখ বন্ধ করি, আমরা যখন ভোটের অধিকার বিসর্জন দিয়ে বলি “নেতা জানেন”, আমরা যখন অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা না বলে চুপ থাকি, তখন আমরাও এই লোভ, অহংকার ও হিংসার রাজনীতিকে সহায়তা করি। তাই পরিবর্তন শুধু শীর্ষে নয়, সমাজের গভীরে দরকার।
রাজনীতির মুক্তি কোথায়?
রাজনীতি মানুষের জন্য, না মানুষ রাজনীতির জন্য—এই প্রশ্নের উত্তর থেকেই শুরু হতে পারে আমাদের ভবিষ্যৎ রাজনীতি নির্মাণের পথ। যদি রাজনীতি হয় লোভহীন, অহংকারমুক্ত, হিংসাবর্জিত—তবে তা হবে প্রকৃত গণতন্ত্রের পথ। আর যদি তা হয় আত্মমুগ্ধ, প্রতিহিংসাপরায়ণ ও সর্বগ্রাসী—তবে তা হবে দুর্বিনীত, বিকারগ্রস্ত এক চক্র।
এই লেখার উদ্দেশ্য কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা নয়, বরং একটা আয়না তুলে ধরা—যেখানে আমরা নিজের মুখ দেখতে পারি। আমরা চাই রাজনীতি ফিরুক জনতার কাছে, স্বজনপ্রীতির বদলে ফিরুক ন্যায়ের কাছে, ক্ষমতার লোভে নয়—দায়বদ্ধতার অহংকারে রাজনীতি হোক শক্তিশালী। রাজনীতি যদি দেশ ও জনগণের উন্নয়নের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপায় হয়, তাহলে সেটিকে গড়তে হলে আমাদের আগে গড়তে হবে লোভ, অহংকার ও হিংসা থেকে মুক্ত এক নতুন মানসিকতা।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, বিশিষ্ট বিশ্লেষক- রাজনীতি ও সমাজ
বিভুরঞ্জন সরকার 


















