বাংলার বনের গর্ব
বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্যে একসময় বন মোরগ ছিল এক অনন্য রঙিন ও রাজসিক পাখি। প্রাকৃতিক বনাঞ্চলে এর উপস্থিতি ছিল গ্রামীণ লোককথা, গান ও শিকারের গল্পে উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে। একশ বছর আগে দেশের বিস্তীর্ণ বনভূমি—বিশেষ করে চট্টগ্রাম, সিলেট, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও মধুপুর-শালবন এলাকায়—বন মোরগ অবাধে বিচরণ করত।
একশ বছর আগের চিত্র: অগণিত বন মোরগের রাজত্ব
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে বাংলার বনভূমি ছিল প্রায় অক্ষত। তখন বন মোরগ (স্থানীয় ভাষায় কখনও ‘বনকুক্কুট’) ঝোপঝাড়, উঁচু গাছপালা আর ঝরনামুখী পাহাড়ি জায়গায় দলে দলে ঘুরে বেড়াত। কৃষকের ধানক্ষেতের কাছাকাছি বনমুখী এলাকায়ও তাদের দেখা মিলত। বন্যপ্রাণী শিকার ছিল তৎকালীন গ্রামীণ বিনোদন ও জীবিকার অংশ, তবু বন মোরগের সংখ্যা এত বেশি ছিল যে বিলুপ্তির কোনো আশঙ্কা তখন কেউ কল্পনাও করেনি।
ঐতিহাসিক নথি ও প্রবীণদের বর্ণনা অনুযায়ী, ১৯২০-৩০ সালের দিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের লুসাই পাহাড়, বান্দরবানের ত্রি-সীমানা এলাকা এবং সিলেটের পাহাড়ি বনের ভেতরে বন মোরগ ছিল সবচেয়ে বেশি। সেসময় ভোরবেলায় বনের ভেতর তাদের ডাকার শব্দে পাহাড় ও উপত্যকা মুখরিত থাকত।

বন মোরগের জীবনযাপন ও গুরুত্ব
বন মোরগ মূলত গৃহপালিত মুরগির পূর্বপুরুষ হিসেবে বিবেচিত হয়। এরা বনের ভেতর ছোট দলে চলাফেরা করে, মূলত মাটি ঠুকে খাদ্য সংগ্রহ করে এবং প্রজনন মৌসুমে পুরুষ মোরগ রঙিন পালক ও ডানার প্রদর্শনী করে স্ত্রী মোরগকে আকর্ষণ করে। এরা বনের পোকামাকড় ও বীজ বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, ফলে বনজ পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় অপরিহার্য।
বর্তমান পরিস্থিতি: সংকটের মুখে বন মোরগ
আজকের বাংলাদেশে বন মোরগ প্রায় বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে। অবৈধ শিকার, বন উজাড়, কৃষিজমি সম্প্রসারণ ও মানুষের বসতি বৃদ্ধির ফলে তাদের আবাসস্থল দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে কেবল চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের সীমিত কিছু গভীর বনে, যেমন রেমা-কালেঙ্গা, লাওয়াছড়া ও কিছু পাহাড়ি সংরক্ষিত এলাকায় বন মোরগের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। তবে সংখ্যায় তারা অত্যন্ত কম। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ (IUCN) বাংলাদেশে এদের সংরক্ষণকে জরুরি ঘোষণা করেছে।

পাহাড়ি মোরগ: আরেক হারিয়ে যাওয়া রঙিন পাখি
অতীতের প্রাচুর্য
পাহাড়ি মোরগ বা হিল কক (Hill Cock) মূলত পার্বত্য চট্টগ্রামের গভীর বন ও উঁচু পাহাড়ি ঝোপে বাস করত। একশ বছর আগে এদের সংখ্যাও ছিল অনেক বেশি। সকাল ও বিকেলের দিকে পাহাড়ের চূড়া থেকে এদের ডাকা শোনা যেত, যা পাহাড়ি মানুষের কাছে ছিল একপ্রকার সময় জানানোর সংকেত।
জীবনধারা ও পার্থক্য
পাহাড়ি মোরগ বন মোরগের তুলনায় আরও উজ্জ্বল রঙের, ডানার পালকে ধাতব ঝিলিক ও লম্বা লেজের জন্য বিশেষভাবে চেনা যায়। এরা বেশি খাড়া ঢাল ও ঝরনামুখী গাছপালা-পূর্ণ অঞ্চলে বাস করে। খাদ্যাভ্যাসও বন মোরগের মতো হলেও পাহাড়ি মোরগের চলাফেরা তুলনামূলক বেশি গোপনীয়।
বর্তমান অবস্থা
পাহাড়ি মোরগের বর্তমান অবস্থা বন মোরগের চেয়েও বেশি বিপন্ন। পাহাড়ি বনের দ্রুত ধ্বংস, অবৈধ কাঠ আহরণ, বনপথে মানুষের অনুপ্রবেশ ও অবাধ শিকার এই প্রজাতিকে প্রায় বিলুপ্তির পথে ঠেলে দিয়েছে। বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ির কিছু দুর্গম এলাকায় এখনও তাদের দেখা মেলে, কিন্তু সংখ্যা এতই কম যে প্রাকৃতিক প্রজননের মাধ্যমে জনসংখ্যা পুনরুদ্ধার প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা
বন মোরগ ও পাহাড়ি মোরগ কেবল বনের সৌন্দর্যের প্রতীক নয়, বরং পরিবেশগত ভারসাম্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজন—
- অবৈধ শিকার বন্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ
- বনাঞ্চল পুনরুদ্ধার ও সম্প্রসারণ
- পাহাড়ি অঞ্চলে সংরক্ষিত এলাকা বৃদ্ধি
- স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণে সচেতনতা কর্মসূচি
বিলুপ্তির পথে
এক শতাব্দী আগে যে বন মোরগ ও পাহাড়ি মোরগ বাংলার বনে-জঙ্গলে রাজত্ব করত, আজ তারা প্রায় বিলুপ্তির পথে। ইতিহাস আমাদের বলে, একসময়কার প্রাচুর্য অযত্নে হারিয়ে যায়। তাই এখনই যদি সচেতন সংরক্ষণ কার্যক্রম শুরু না হয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হয়তো কেবল বইয়ের পাতায় বা ছবিতে এই রঙিন পাখিদের দেখতে পাবে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















