সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহার মানুষের জ্ঞানীয় ক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে—সম্প্রতি বিভিন্ন গবেষণা এমনই ইঙ্গিত দিচ্ছে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম কীভাবে তথ্য খুঁজে বের করে, শেখে এবং মনে রাখে, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের উদ্বেগ বাড়ছে।
উদ্বেগের কারণ
পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়ার্টন স্কুলের অধ্যাপক শিরি মেলুমাদ জানিয়েছেন, তিনি বেশ চিন্তিত এই পরিস্থিতি নিয়ে। তাঁর মতে, আজকের তরুণরা হয়তো খুব শিগগিরই ঐতিহ্যবাহী গুগল সার্চ কীভাবে করতে হয়, সেটাই ভুলে যাবে।
গত বসন্তে তিনি ২৫০ জনের ওপর গবেষণা করেন। অংশগ্রহণকারীদের বলা হয় বন্ধুকে স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের পরামর্শ লিখতে। কেউ নিজে গুগল সার্চ করে তথ্য সংগ্রহ করতে পারে, আবার কেউ শুধু গুগলের এআই–তৈরি সারাংশ ব্যবহারের সুযোগ পায়।
যারা এআই–তৈরি সারাংশ ব্যবহার করেছে, তাদের পরামর্শ ছিল খুব সাধারণ ও অস্পষ্ট—যেমন ভালো খাবার খাওয়া, পানি পান করা, ঘুমানো। অন্যদিকে যারা গুগল সার্চ করেছে, তারা শারীরিক, মানসিক ও আবেগিক সুস্থতার বিভিন্ন দিক নিয়ে অনেক বেশি সুস্পষ্ট ও কার্যকর পরামর্শ দিতে পেরেছে।
এআই কি শেখার ক্ষতি করছে?
প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো দাবি করে চ্যাটবট ও এআই সার্চ টুল শেখা ও কাজকে আরও দ্রুত ও কার্যকর করবে। কিন্তু সাম্প্রতিক বহু গবেষণা বলছে—এআই-এর ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল হলে শিক্ষার মান কমে যায়।

শিক্ষাবিদদের এই শঙ্কার জনপ্রিয় নাম—‘ব্রেন রট’। অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারি ২০২৪ সালে এটিকে বছরের শব্দ ঘোষণা করে। এর অর্থ—নিম্নমানের ইন্টারনেট কনটেন্টে আসক্ত হয়ে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া।
ইতিহাসেও প্রযুক্তিকে দোষারোপ করার নজির আছে। সক্রেটিস বলেছিলেন—লেখার প্রচলন মানুষের স্মৃতিশক্তি নষ্ট করছে। ২০০৮ সালে ‘ইস গুগল মেকিং আস স্টুপিড?’ শিরোনামের আলোচনাও হয়েছিল। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি আরও উদ্বেগজনক, কারণ যুক্তরাষ্ট্রে শিশু ও কিশোরদের পাঠ–বুঝার দক্ষতা এখন রেকর্ড নিম্নে।
পাঠে ও স্মৃতিতে অবনতি
যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় শিক্ষা মান মূল্যায়নের সাম্প্রতিক পরীক্ষায় দেখা গেছে—আটম শ্রেণি ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের পড়ার দক্ষতা উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। করোনা মহামারির সময়ে অনলাইনে অতিরিক্ত সময় কাটানোকে এর বড় কারণ মনে করা হচ্ছে।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে—এআই ব্যবহার ও মানসিক কর্মক্ষমতা হ্রাসের মধ্যে সম্পর্ক রয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমও একইভাবে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে—বিশেষত শিশুদের ক্ষেত্রে স্মৃতি, শব্দভাণ্ডার ও পড়া–বুঝার পরীক্ষায় খারাপ ফল দেখা যায়।
এআই ও মস্তিষ্ক: এমআইটির গবেষণা
এ বছর এমআইটি একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা প্রকাশ করে। ৫৪ জন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীকে ৫০০ থেকে ১,০০০ শব্দের প্রবন্ধ লিখতে দেওয়া হয়। কেউ ChatGPT ব্যবহার করতে পারে, কেউ গুগল সার্চ, আর কেউ কোনো প্রযুক্তি ব্যবহার না করে লেখে।
শিক্ষার্থীদের মাথায় ইলেক্ট্রিক সিগন্যাল মাপার সেন্সর লাগানো ছিল। দেখা যায়, ChatGPT ব্যবহারকারীদের মস্তিষ্কের কার্যকলাপ সবচেয়ে কম—কারণ প্রবন্ধের মূল অংশটি এআই-ই লিখছিল।
প্রবন্ধ লেখা শেষ হওয়ার এক মিনিট পর সবাইকে নিজের লেখা থেকে কয়েকটি লাইন মুখস্থ বলতে বলা হয়। ChatGPT ব্যবহারকারীদের ৮৩ শতাংশ কোনো বাক্যই মনে রাখতে পারেনি। গুগল সার্চ ব্যবহারকারীরা কিছু অংশ মনে রাখতে পেরেছে। আর যারা নিজস্ব জ্ঞান দিয়ে লিখেছে, অনেকেই প্রায় পুরো প্রবন্ধই হুবহু বলতে পেরেছে।
গবেষক নাটালিয়া কোসমিনা জানান—এআই–এর ওপর নির্ভরশীল হলে মানুষ তথ্য মনে রাখে না, নিজের লেখা বলে অনুভব করে না—অর্থাৎ শেখার মর্মই হারিয়ে যায়।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রভাব
যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি অঙ্গরাজ্যে শ্রেণিকক্ষে মোবাইল ফোন নিষিদ্ধ করা হচ্ছে। কারণ, TikTok বা Instagram ব্যবহারে মনোযোগ নষ্ট হয়।
এক গবেষণায় ৯ থেকে ১৩ বছর বয়সী ৬,৫০০ শিশুর তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়—যারা দিনে ১ থেকে ৩ ঘণ্টা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করেছে, তাদের পড়া, স্মৃতি ও শব্দভাণ্ডার পরীক্ষার স্কোর উল্লেখযোগ্যভাবে কম—যারা একেবারেই ব্যবহার করেনি তাদের তুলনায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্ক্রিনে অতিরিক্ত সময় কাটালে পড়া, ঘুম ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজের সময় কমে যায়—এটাই মূল ক্ষতি।
স্বাস্থ্যকর উপায়ে প্রযুক্তি ব্যবহার
শিশুদের জন্য নির্দিষ্ট স্ক্রিন সময় নির্ধারণ করা কঠিন, কারণ স্ক্রিন মানেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নয়। তাই বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ—শোবার ঘরে ফোন না রাখা, খাবার টেবিলে ফোন না রাখা, পড়াশোনা বা ঘুমের সময় একেবারে স্ক্রিন–ফ্রি থাকা।
TikTok ‘Time Away’ নামে কিশোরদের ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ আনার ফিচার চালু করেছে, তবে উদ্বেগ পুরোপুরি কমেনি।
এআই ব্যবহারের সম্ভাব্য সমাধান
এমআইটির গবেষণায় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে আসে—যারা আগে মাথা ব্যবহার করে লিখেছিল, পরে ChatGPT ব্যবহারের সুযোগ পেয়ে তাদের মস্তিষ্ক সবচেয়ে সক্রিয় দেখা যায়। কিন্তু যারা আগে ChatGPT ব্যবহার করেছিল, পরে যখন তাদের নিজে লিখতে বলা হয়—তারা আগের দলের সমান সক্ষমতা দেখাতে পারে না।
অর্থাৎ, সঠিক উপায় হলো—প্রথমে নিজের চিন্তা দিয়ে শেখা বা লেখা শুরু করা, পরে এআই ব্যবহার করে সম্পাদনা বা উন্নয়ন করা—যেমন গণিতে প্রথমে সূত্র শেখা হয়, পরে ক্যালকুলেটর ব্যবহার করা হয়।

সচেতন ব্যবহারই মূল
অধ্যাপক মেলুমাদের মতে, এআই সারাংশ শেখার সক্রিয় প্রক্রিয়াকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়। আগে মানুষ লিংকে ক্লিক করে তথ্য যাচাই করত—এখন সবকিছুই দেখিয়ে দেওয়া হয়।
তাঁর পরামর্শ হলো—চ্যাটবটকে বিস্তৃত গবেষণার দায়িত্ব না দেওয়া, ছোট তথ্য যাচাইয়ে এআই ব্যবহার করা, আর গভীর শেখার ক্ষেত্রে বই ও বিস্তারিত উৎসের ওপর নির্ভর করা।
প্রযুক্তি আমাদের সহায়ক হতে পারে, তবে ব্যবহার হতে হবে সচেতন ও সীমিত—না হলে শেখা, মনে রাখা ও চিন্তা করার স্বাভাবিক ক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
#সামাজিক_যোগাযোগমাধ্যম #শিক্ষা_গবেষণা #মস্তিষ্কের_ক্ষমতা #ডিজিটাল_আসক্তি
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















