ধরলা (ভারতে যার উজানে নাম জলঢাকা বা সিঙ্গিমারি) হলো ব্রহ্মপুত্রের একটি শাখা–উপনদী। নদীটি হিমালয়ের কোলে জন্ম নিয়ে ভূটান ও ভারতের পাহাড়–পাহাড়ি বন পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে, তারপর কুড়িগ্রাম–লালমনিরহাটের জনজীবন ছুঁয়ে যমুনায় মিলিত হয়। নদীপথের এই যাত্রায় যেমন আছে বন্যপ্রাণ ও মাছের সমৃদ্ধ ভান্ডার, তেমনি আছে বর্ষায় বন্যা ও ভাঙনের দুঃসহতা, আবার আছে যোগাযোগ ও বাণিজ্যের সহায়তাও।
উৎপত্তি: সিকিমের কুপুপ লেক ও পানগোলাখা অভয়ারণ্য
ধরলার উৎস হিমালয়ের পূর্ব সিকিমে—পানগোলাখা বন্যপ্রাণ অভয়ারণ্যের কুপুপ বা বিতাং হ্রদাঞ্চল। এখানেই নদীটির উজানি নাম জলঢাকা। এই অভয়ারণ্য থেকে জলঢাকাসহ কয়েকটি নদী বেরিয়ে আসে; সিকিম–ভূটান–পশ্চিমবঙ্গের সংরক্ষিত অরণ্য জুড়ে এর জলবিধৌত এলাকা বিস্তৃত।
হিমালয়, সিকিম ও ভূটান অংশের পথরেখা
উৎসভূমির পর ধরলা পূর্ব সিকিম থেকে ভূটানের সামতসে জেলায় ঢুকে আবার ভারতে ফিরে আসে; এরপর জলপাইগুড়ি ও কোচবিহার জেলায় দিয়ে দক্ষিণ–পূর্বে নামে। পাহাড়ি এ অংশে নদীর পাড়ঘেঁষা বনাঞ্চল লাল পান্ডা, হিমালয়ি কালো ভাল্লুক, গোরাল, বার্কিং ডিয়ার, নানা তিতির ও উচ্চভূমির বহু পরিযায়ী পাখির আবাসস্থল।

ভূটান অংশের জলজ জীববৈচিত্র্য
ধরলার আশপাশের ভূটানি অংশে মিঠাজলের সমৃদ্ধ মাছের প্রজাতি পাওয়া যায়। এখানে প্রচুর দেশি প্রজাতির মাছ রয়েছে, যা উজান এলাকায় জলজ–পুষ্টি–পরিবেশের সমৃদ্ধি নির্দেশ করে।
ভারত অংশ পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশপথ
ধরলা কোচবিহার ও জলপাইগুড়ি অতিক্রম করে বাংলাদেশের লালমনিরহাট জেলায় প্রথমবার প্রবেশ করে। পরে পাটগ্রামের কাছে আবার কিছুটা ভারতভূমি স্পর্শ করে পূর্বদিকে গিয়ে কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলা দিয়ে দ্বিতীয়বার বাংলাদেশে প্রবেশ করে এবং দক্ষিণে নেমে আসে।
বাংলাদেশের পথ: কোন কোন এলাকা ছুঁয়ে কোথায় শেষ
বাংলাদেশ অংশে ধরলা লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়। কুলাঘাট, মোহঘাট ও কুড়িগ্রাম সদর অতিক্রম করে নদীটি কুড়িগ্রাম জেলাতেই যমুনায় মিশে যায়। এই পথে নদীতে নাব্যতার ওঠানামায় চর সৃষ্টি, ভাঙন ও পলি জমার প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে।

বাংলাদেশ অংশের মাছের বৈচিত্র্য
কুড়িগ্রাম–লালমনিরহাট অংশে সাম্প্রতিক জরিপে মোট ৭৬ প্রজাতির দেশি মাছ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে কার্প গোত্রের মাছ বেশি, সঙ্গে আছে দানিও, ক্যাটফিশ, শোল–টাকি, বাম ইত্যাদি। প্রায় ৩৭ শতাংশ প্রজাতি বিপন্ন তালিকায়, যার প্রধান কারণ নির্বিচার শিকার, বিষ প্রয়োগ ও বিধ্বংসী জালের ব্যবহার।
বন্যপ্রাণ: তীরের বন–চরভূমি
ধরলার দুই কূলের চর, কাশবন ও ঝোপঝাড়ে বিভিন্ন পাখি যেমন বক, ধলেশার, চিত্রা হাঁস, ধলাবুক বুলবুলি প্রভৃতি দেখা যায়। বর্ষায় শিয়াল, সোনালি শেয়াল, শজারু, বনবিড়ালও তীরে আশ্রয় নেয়। উজানের পার্বত্য অংশে সংরক্ষিত অরণ্যে লাল পান্ডা, কালো ভাল্লুক, তিতির, মোনাল ও ব্লাড ফেজ্যান্টের আবাস রয়েছে।

যোগাযোগ ও স্থানীয় অর্থনীতি
কুড়িগ্রামের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়ায় ধরলা স্থানীয় নৌ–যাতায়াত ও পণ্য পরিবহনে বহুদিন ধরে সহায়ক। খেয়া ও নৌকা চলাচল ছিল নিয়মিত। সাম্প্রতিক সময়ে কুড়িগ্রাম, ফুলবাড়ী ও কুলাঘাটে সেতু নির্মাণে দুই কূলের সংযোগ সহজ হয়েছে। ২০১৮ সালে ‘শেখ হাসিনা ধরলা সেতু’ উদ্বোধনের পর যোগাযোগ ও স্থানীয় বাণিজ্যে গতি বেড়েছে।
বন্যা ও নদীভাঙন
জুন–সেপ্টেম্বরে উজানের পাহাড়ি ঢল ও ভারী বৃষ্টিতে ধরলা ফুলে–ফেঁপে ওঠে। এ সময় লালমনিরহাট–কুড়িগ্রামের নিচুভূমি ও চর ডুবে যায়, ভাঙন তীব্র হয়। সাম্প্রতিক মৌসুমেও পানি বৃদ্ধির ফলে বন্যা ও ভাঙনের ঝুঁকি দেখা দিয়েছে।
নদীর রূপ–রূপান্তর
বাংলাদেশ অংশে ধরলার ওপরের দিকে বোনা–বোনা চ্যানেল ও নিচের দিকে আঁকাবাঁকা ধারা দেখা যায়। গড় নদীতল ঢাল অল্প হওয়ায় বর্ষায় প্রবাহ দ্রুত হলেও শুষ্ক মৌসুমে নাব্যতা কমে যায় এবং চর সৃষ্টি হয়।

সংরক্ষণ–পরিচর্যা
ধরলা নদী ও এর অববাহিকাকে রক্ষায় উজান থেকে ভাটি পর্যন্ত সমন্বিত ব্যবস্থাপনা জরুরি। সিকিম, ভূটান, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে তথ্য ভাগাভাগি, বর্ষা পূর্ব সতর্কতা ব্যবস্থা ও পলি অপসারণের পরিকল্পনা নিতে হবে। মাছের প্রজনন মৌসুমে অবাধ আহরণ বন্ধ রাখা, বিষ ও কারেন্ট জালসহ সব বিধ্বংসী মাছ ধরার উপকরণ নিষিদ্ধ করা জরুরি। বিপন্ন প্রজাতির মাছের আবাসস্থল ও প্রজনন ক্ষেত্র রক্ষায় নির্দিষ্ট সংরক্ষিত এলাকা নির্ধারণ করতে হবে এবং বিকল্প জীবিকার সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি, চর ও পাড়ের ভাঙন রোধে কমিউনিটি–ভিত্তিক তটরক্ষা ব্যবস্থা, জিও–ব্যাগ ও উদ্ভিদনির্ভর বায়োইঞ্জিনিয়ারিং প্রযুক্তি ব্যবহার করা যেতে পারে। বর্ষাকালে আগাম আশ্রয়কেন্দ্র, নিরাপদ পানি ও খাদ্য সরবরাহের প্রস্তুতি থাকলে দুর্যোগের ক্ষতি অনেকটা কমানো সম্ভব হবে।
উপসংহার
ধরলা একদিকে হিমালয়ের প্রাণবৈচিত্র্যময় উজানের জলধারাকে ভাটির কৃষিভূমিতে এনে দেয়, অন্যদিকে বর্ষায় বন্যা ও ভাঙনের ঝুঁকি তৈরি করে। সেতু ও নৌ–যোগাযোগ, মাছ ও বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ এবং সীমান্ত–পারের সমন্বিত ব্যবস্থাপনা—এই তিন দিক ঠিকভাবে বাস্তবায়ন হলে ধরলা নদী উত্তরাঞ্চলের জীবন–জীবিকার বড় ভরসা হয়ে উঠতে পারে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















