বঙ্গোপসাগরের বিস্তৃত জলরাশিতে নানান প্রজাতির সামুদ্রিক প্রাণী বাস করে, যার মধ্যে হুক-নোজড সি-স্নেক (Enhydrina schistosa) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য এবং শঙ্কাজনক। স্থানীয় জেলেদের কাছে এটি “বিষধর সাগর সাপ” বা “হুক নাকের সাপ” নামে পরিচিত। আকার, স্বভাব ও বিষের তীব্রতার জন্য এটি সমুদ্রজীববিজ্ঞানী এবং মাছ ধরাদের কাছে সমানভাবে পরিচিত।
আবাসস্থল ও বিস্তৃতি
এ সাপ প্রধানত বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী অগভীর পানিতে দেখা যায়। নদীর মোহনা, কাদামাটি ও বালুময় তলদেশ এবং সামুদ্রিক ঘাসবেষ্টিত এলাকা এদের প্রধান আবাসস্থল। বর্ষাকালে নদীর স্রোতের সাথে কিছু সাপ আরও ভেতরের দিকে চলে আসে। কক্সবাজার, টেকনাফ, পটুয়াখালী এবং সুন্দরবনের উপকূলে এদের উপস্থিতি বেশি।

শারীরিক গঠন ও বৈশিষ্ট্য
এই প্রজাতির দৈর্ঘ্য সাধারণত ১ থেকে ১.৫ মিটার হয়। নাক সামান্য উপরের দিকে বাঁকানো ও হুকের মতো দেখতে, যা শিকার ধরতে ও তলদেশে খাবার খুঁজতে সহায়ক। শরীরের উপরের অংশ ধূসর বা জলপাই রঙের, নিচের অংশ সাদা। শক্তিশালী ফুসফুসের কারণে এটি দীর্ঘ সময় পানির নিচে থাকতে পারে।
খাদ্যাভ্যাস ও শিকার পদ্ধতি
এরা ছোট মাছ, চিংড়ি এবং অন্যান্য ছোট সামুদ্রিক প্রাণী খায়। দ্রুত সাঁতরে এসে দাঁত দিয়ে শিকারকে ধরে বিষ প্রবেশ করায়, যা স্নায়ুতন্ত্রকে অবশ করে দেয়। ফলে শিকার দ্রুত অচেতন হয়ে পালাতে পারে না।
বিষের তীব্রতা ও মানুষের ঝুঁকি
এটি বিশ্বের অন্যতম বিষধর সামুদ্রিক সাপ। এর বিষে থাকা নিউরোটক্সিন স্নায়ুতন্ত্রকে পক্ষাঘাতগ্রস্ত করে শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ করে দিতে পারে। সাধারণত মানুষকে আক্রমণ করে না, কিন্তু জালে ধরা পড়লে বা বিরক্ত করা হলে কামড়ায়। দ্রুত চিকিৎসা না পেলে এর কামড় প্রাণঘাতী হতে পারে।

জীবনচক্র ও প্রজনন
এ সাপ ডিম না পেড়ে সরাসরি বাচ্চা দেয় (ভিভিপ্যারাস)। স্ত্রী সাপ সাধারণত ৪ থেকে ৮টি বাচ্চা জন্ম দেয়। প্রজনন মৌসুমে উপকূলের অগভীর জলে বেশি ঘোরাফেরা করে।
স্থানীয় জীবনে গুরুত্ব ও সংঘাত
উপকূলের মাছ ধরারা প্রায়ই জালে এই সাপের মুখোমুখি হন। যদিও তারা এটিকে ক্ষতিকর মনে করেন, তবু সাগরের খাদ্যশৃঙ্খলে এর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। ছোট মাছের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং বাস্তুসংস্থানের ভারসাম্য রক্ষায় এটি সহায়ক। কিন্তু মাছ ধরার জাল ও ট্রলারের কারণে অনেক সাপ মারা যায়।
সংরক্ষণ পরিস্থিতি ও হুমকি
আইইউসিএন তালিকায় বর্তমানে এ প্রজাতিকে ‘Least Concern’ হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও, অতিরিক্ত মাছ ধরা, আবাসস্থল ধ্বংস এবং দূষণের কারণে এদের সংখ্যা হ্রাসের ঝুঁকি রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনে সমুদ্রের তাপমাত্রা ও স্রোতের পরিবর্তন এদের বিস্তৃতিতে প্রভাব ফেলতে পারে।

অতীত ও বর্তমান উপস্থিতির পরিসংখ্যান
প্রায় ৩০-৪০ বছর আগে বাংলাদেশের উপকূলে এই সাপের সংখ্যা অনেক বেশি ছিল। ১৯৮০ ও ১৯৯০-এর দশকে প্রতিদিন জেলেদের জালে ৫-৭টি সাপ ধরা পড়া স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু ২০২০-এর পর থেকে এ সংখ্যা কমে গেছে। বর্তমানে গড়ে এক সপ্তাহে ১-২টি সাপ ধরা পড়ে। এর পেছনে প্রধান কারণ অতিরিক্ত মাছ ধরা, জলদূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব।
জেলেদের অভিজ্ঞতা ও মাঠপর্যায়ের তথ্য
টেকনাফ ও কক্সবাজারের জেলেরা জানান, আগে জালে ধরা পড়লে ভয় পেয়ে সাগরে ফেলে দিতেন। এখন অনেকে বিক্রি করেন, কারণ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কিছু দেশে এর চামড়া ও তেল ব্যবহার হয়। তবে অনেকে এখনো এটিকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করে এবং জাল থেকে সাবধানে ছাড়িয়ে দেন। জেলেদের মতে, কামড়ের পর দ্রুত চিকিৎসা না পেলে মৃত্যু হতে পারে, তাই সতর্কতা জরুরি।

হুক-নোজড সি-স্নেক বঙ্গোপসাগরের সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি যেমন বিপজ্জনক, তেমনি পরিবেশের জন্য অপরিহার্য। উপকূলে সচেতনতা বৃদ্ধি, জেলেদের প্রশিক্ষণ ও সংরক্ষণ উদ্যোগের মাধ্যমে মানুষ ও এ সাপের মধ্যে সংঘাত কমানো সম্ভব। সংখ্যার পতন পরিবেশগত ভারসাম্যের জন্য সতর্কবার্তা, তাই এখনই সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন, যাতে এই সামুদ্রিক প্রাণী ও মানুষের সহাবস্থান নিশ্চিত হয়।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















