বাংলাদেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হওয়া সত্ত্বেও বিশ্বব্যাপী দ্রুত বাড়তে থাকা হালাল খাদ্যের বাজারে বড় কোনো অবস্থান তৈরি করতে পারেনি। অথচ বিশ্বের হালাল ইন্ডাস্ট্রি আজ বহু ট্রিলিয়ন ডলারের বাজারে পরিণত হয়েছে। এখানে বাংলাদেশের ব্যর্থতার কারণগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যাক।
বৈশ্বিক হালাল খাদ্যবাজারের চিত্র
বর্তমানে বিশ্বের হালাল খাদ্যের বাজারের আকার প্রায় ২ ট্রিলিয়ন ডলার। মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক ও এমনকি পশ্চিমা দেশগুলোতেও হালাল পণ্যের চাহিদা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। শুধু মুসলিম নয়, অমুসলিম ভোক্তারাও হালাল পণ্যকে স্বাস্থ্যকর ও নিরাপদ মনে করে ক্রয় করছেন।
তবে এই সুবিশাল বাজারে বাংলাদেশের অবদান খুবই সীমিত, যা দেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনার সঙ্গে যায় না।
মান নিয়ন্ত্রণ ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির অভাব
হালাল খাদ্য রপ্তানির অন্যতম প্রধান শর্ত হলো আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখা এবং নির্ভরযোগ্য হালাল সার্টিফিকেশন থাকা। মালয়েশিয়া, ব্রুনাই, সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশগুলো ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হালাল সার্টিফিকেশন ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে।
বাংলাদেশে এখনও পূর্ণাঙ্গ বিশ্বমানের হালাল সার্টিফিকেশন কর্তৃপক্ষ শক্ত অবস্থান নিতে পারেনি। ফলে বিদেশি ক্রেতারা বাংলাদেশি পণ্যের ওপর আস্থা রাখতে দ্বিধাগ্রস্ত হন।

অবকাঠামো ও প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা
হালাল খাদ্য উৎপাদনের জন্য আলাদা প্রসেসিং লাইন, আধুনিক যন্ত্রপাতি এবং বিশেষায়িত প্রযুক্তির প্রয়োজন হয়। কিন্তু বাংলাদেশে খাদ্যশিল্প এখনও প্রথাগত ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল। আধুনিক মাংস প্রক্রিয়াকরণ প্ল্যান্ট, কোয়ালিটি টেস্টিং ল্যাব এবং কোল্ড চেইন লজিস্টিকসের অভাবে উৎপাদিত পণ্য বিশ্বমান বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়।
বাজার গবেষণা ও কৌশলগত পরিকল্পনার ঘাটতি
মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া কিংবা তুরস্ক সরকার হালাল ইন্ডাস্ট্রিকে কৌশলগতভাবে জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। তারা ব্র্যান্ডিং, গবেষণা ও বাজার সম্প্রসারণে বিপুল বিনিয়োগ করেছে।
অন্যদিকে বাংলাদেশে সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে হালাল পণ্য রপ্তানির জন্য বিশেষ কৌশল বা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা তেমনভাবে নেওয়া হয়নি। ফলে উদ্যোক্তারা সঠিক দিকনির্দেশনা পান না।

বিনিয়োগ ও উদ্যোক্তা সংকট
হালাল খাদ্যশিল্পে বিনিয়োগে ঝুঁকি নিতে অনেক উদ্যোক্তা পিছিয়ে যান। কারণ উৎপাদন প্রক্রিয়ায় উচ্চ মান বজায় রাখা, আন্তর্জাতিক সার্টিফিকেশন পাওয়া এবং রপ্তানির নিয়মকানুন মেনে চলা অনেক ব্যয়সাপেক্ষ। এ ছাড়া এই খাতে ভর্তুকি বা কর-সুবিধার অভাব উদ্যোক্তাদের আগ্রহ কমিয়ে দিয়েছে।
দক্ষ জনবল ও প্রশিক্ষণের ঘাটতি
হালাল খাদ্য উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণে বিশেষ জ্ঞানসম্পন্ন জনবল প্রয়োজন। বাংলাদেশে এই খাতে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ও শিক্ষাব্যবস্থা নেই। ফলে অনেক প্রতিষ্ঠান পেশাদারভাবে বাজারে প্রবেশ করতে পারে না।
আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও নীতিগত অসহযোগিতা
বাংলাদেশের রপ্তানি খাতে দীর্ঘদিন ধরে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা বিদ্যমান। বিশেষ করে নতুন খাত যেমন হালাল ইন্ডাস্ট্রির জন্য সহজ নীতি, প্রণোদনা বা দ্রুত অনুমোদন ব্যবস্থা না থাকায় উদ্যোক্তারা বাধাগ্রস্ত হচ্ছেন।
অন্যদিকে প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলো নীতিগত সহায়তা দিয়ে এ খাতকে জাতীয় অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনা করছে।

সম্ভাবনার জানালা
যদিও বাস্তবতায় বাংলাদেশ এখনও পিছিয়ে, তবুও হালাল খাদ্যবাজার দখলের যথেষ্ট সুযোগ আছে। দেশে প্রচুর পশুসম্পদ, কৃষিপণ্য ও মৎস্যসম্পদ রয়েছে, যা সঠিকভাবে প্রক্রিয়াজাত করে রপ্তানি করা সম্ভব। সরকার যদি আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে হালাল সার্টিফিকেশন কর্তৃপক্ষকে শক্তিশালী করে, অবকাঠামো ও লজিস্টিকস উন্নত করে এবং উদ্যোক্তাদের জন্য কর-সুবিধা ও ভর্তুকি দেয়, তবে বাংলাদেশ অচিরেই বৈশ্বিক হালাল খাদ্যবাজারে বড় অংশীদার হতে পারে।
বাংলাদেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হওয়া সত্ত্বেও হালাল খাদ্যের বিশ্ববাজারে পিছিয়ে আছে মূলত মান নিয়ন্ত্রণ, অবকাঠামো, সার্টিফিকেশন ও নীতিগত ঘাটতির কারণে। তবে সুযোগ এখনও হাতছাড়া হয়নি। সঠিক কৌশল, সরকারি সহযোগিতা এবং উদ্যোক্তাদের উদ্যোগ থাকলে বাংলাদেশ সহজেই এই বহু ট্রিলিয়ন ডলারের বাজারের বড় অংশীদার হয়ে উঠতে পারে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















