বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যুক্তরাষ্ট্র থেকে বছরে প্রায় ১২০ কোটি (১.২ বিলিয়ন) ডলারের জ্বালানি আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে থাকবে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি), তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) ও পরিশোধিত তেল। সরকারের দাবি, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমানো এবং ভবিষ্যতে রপ্তানি খাতে সুযোগ তৈরি করাই এ সিদ্ধান্তের মূল লক্ষ্য। কিন্তু অর্থনীতিবিদ ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, মধ্যপ্রাচ্যের বাজারের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্র থেকে এই আমদানি বাংলাদেশকে বছরে প্রায় ২০০ মিলিয়ন ডলারের বাড়তি খরচে ফেলতে পারে।
সরকারের উদ্যোগ ও যুক্তি
সরকার জানিয়েছে, আগামী বছর থেকে নিয়মিতভাবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে জ্বালানি আনা হবে। জ্বালানি বিভাগের সচিব মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম জানিয়েছেন, বছরে মোট ১.২ বিলিয়ন ডলারের জ্বালানি আমদানি করা হবে। এর মধ্যে শুধু এলএনজি কার্গো আনতে খরচ হবে প্রায় ৭০০ মিলিয়ন ডলার।
সরকারের যুক্তি হলো—যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বাড়ানো হলে দুই দেশের বাণিজ্য ভারসাম্যে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। বর্তমানে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দুই দেশের বাণিজ্যের পরিমাণ ১২.৪ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে বাংলাদেশ রপ্তানি করেছে ৮.৪ বিলিয়ন এবং আমদানি করেছে ২.৩ বিলিয়ন ডলার। ফলে ঘাটতি থাকছে মূলত যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষেই। সরকার মনে করছে, এ আমদানি ঘাটতি কমানোর কৌশল হতে পারে।
মধ্যপ্রাচ্যের বাজারের প্রতিযোগিতা
বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে কাতার, ওমান ও সৌদি আরব থেকে এলএনজি, এলপিজি ও তেল আমদানি করছে। এসব দেশের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি থাকায় দাম তুলনামূলক কম এবং স্থিতিশীল থাকে।
এলএনজি: কাতার থেকে সরবরাহ করা এলএনজি আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় সস্তা হয়।
এলপিজি: সৌদি আরবের আরামকো মূল্যমানকে বিশ্বে মানদণ্ড ধরা হয়। বাংলাদেশও এই মূল্য কাঠামোর সুবিধা পেয়ে থাকে।
পরিশোধিত তেল: ভৌগোলিক কারণে পরিবহন ব্যয়ও যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় অনেক কম।
এমন পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের দিকেই ঝুঁকে পড়ায় স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে—এই অতিরিক্ত ব্যয়ের চাপ কীভাবে সামলানো হবে।
বাড়তি ব্যয়ের হিসাব
বিশেষজ্ঞদের হিসাব অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানিতে খরচ বাড়বে তিনভাবে—
এলএনজি: প্রতি MMBtu গড়ে ১–১.৫ ডলার বেশি পড়বে। বছরে এর ফলে প্রায় ১২০–১৫০ মিলিয়ন ডলার অতিরিক্ত ব্যয় হবে।
এলপিজি: যুক্তরাষ্ট্র থেকে এলপিজি আনলে প্রতি টনে প্রায় ৪০–৫০ ডলার বেশি খরচ হবে। ফলে বাড়তি ব্যয় দাঁড়াবে প্রায় ২৫–৩০ মিলিয়ন ডলার।
পরিশোধিত তেল: দূরত্ব ও পরিবহন ব্যয়ের কারণে অতিরিক্ত খরচ হতে পারে আরও ১০–১৫ মিলিয়ন ডলার।
সব মিলিয়ে বছরে প্রায় ১৫৫–১৯৫ মিলিয়ন ডলার অতিরিক্ত খরচ বহন করতে হতে পারে।
ভোক্তা ও শিল্পখাতে প্রভাব
বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের বড় অংশ গ্যাস ও তেলের ওপর নির্ভরশীল। তাই জ্বালানি আমদানির খরচ বাড়লে তার প্রভাব পড়বে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচে। এর পাশাপাশি পরিবহন খাতে জ্বালানির দাম বেড়ে গেলে সাধারণ ভোক্তার ওপরও চাপ তৈরি হবে। শিল্প খাত, বিশেষত পোশাক খাত, জ্বালানির দাম বাড়লে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়তে পারে।
দৈনন্দিন জীবনে প্রভাব
জ্বালানি খরচ বাড়লে তা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় সরাসরি প্রভাব ফেলে।
বিদ্যুৎ বিল: গ্যাসের দাম বাড়লে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচও বাড়বে। ফলে গৃহস্থালি বিদ্যুৎ বিল বৃদ্ধি পেতে পারে।
পরিবহন ভাড়া: ডিজেল ও অকটেনের দাম বেড়ে গেলে গণপরিবহন ভাড়া বাড়বে। অফিসযাত্রী, শিক্ষার্থী এবং নিম্নআয়ের মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
বাজারদর: পরিবহন ব্যয় বাড়লে কৃষিপণ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দামও বেড়ে যাবে। বিশেষত চাল, ডাল, সবজি, মাছ ও মাংসের মতো পণ্যে বাড়তি খরচ যোগ হবে।
এলপিজি ব্যবহারকারী পরিবার: শহরাঞ্চলে রান্নার জন্য এলপিজির ওপর নির্ভরশীল পরিবারগুলোকে প্রতি সিলিন্ডারে বেশি টাকা গুনতে হবে।
মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের ভোগান্তি: আয় না বাড়লেও ব্যয় বাড়বে, ফলে পরিবারগুলোকে জীবনযাত্রার মান কমাতে হবে।

সম্ভাব্য কূটনৈতিক সুবিধা
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ইজাজ হোসেন বলেছেন, প্রতিযোগিতামূলক দামে আমদানি না করলে ভোক্তার ওপর চাপ বাড়বে। তবে তিনি মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানির বিনিময়ে যদি পোশাক রপ্তানিতে শুল্ক ছাড় বা অন্য কোনো বিশেষ সুবিধা পাওয়া যায়, তাহলে দেশ শেষ পর্যন্ত উপকৃতও হতে পারে।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানির ওপর পাল্টা শুল্ক ২০ শতাংশে নামিয়েছে। ফলে ভবিষ্যতে বাণিজ্য সম্পর্ক উন্নত হওয়ার সুযোগ তৈরি হতে পারে।
বাংলাদেশের জ্বালানি খাতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রবেশ নতুন মাত্রা তৈরি করলেও এটি অর্থনীতিতে এক ধরনের “কূটনৈতিক বিনিয়োগ” হিসেবে দেখা হচ্ছে। প্রশ্ন হলো—এই বিনিয়োগের বিনিময়ে কী আসলেই যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিতে নতুন দরজা খুলে দেবে, নাকি সাধারণ মানুষকে প্রতিবছর ২০০ মিলিয়ন ডলারের বাড়তি চাপ বইতে হবে?
এখন সিদ্ধান্তের ভার সরকারের হাতে—তারা কি জনগণের দৈনন্দিন জীবনে চাপ সৃষ্টি করে আমদানি বাড়াবেন, নাকি মধ্যপ্রাচ্যের তুলনামূলক সস্তা বিকল্প ধরে রাখবেন?
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















