ব্রাজিলে লুকানো খনিজ ভাণ্ডার
ব্রাজিলের মাটির নিচে রয়েছে কোটি টন রেয়ার আর্থ খনিজ, যা বিশ্বব্যাপী ড্রোন, রোবট, বৈদ্যুতিক গাড়ি, মিসাইলসহ আধুনিক প্রযুক্তি ও সামরিক সরঞ্জাম তৈরিতে অপরিহার্য। এ খনিজের মজুদের দিক থেকে ব্রাজিল বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম।
গত কয়েক বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রাজিল নীরবে আলোচনা চালাচ্ছিল—কীভাবে মার্কিন বিনিয়োগ ও প্রযুক্তিগত সহায়তায় এ খনিজ ভাণ্ডারকে কাজে লাগানো যায়। যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য ছিল চীনের ওপর নির্ভরশীলতা কমানো, কারণ বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ৯০ শতাংশ রেয়ার আর্থ সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে চীন।![]()
হঠাৎ বাণিজ্যিক সংকট
তবে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রাজিলের মধ্যে কূটনৈতিক টানাপোড়েন এ আলোচনায় ধাক্কা দিয়েছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ব্রাজিলের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন, যার উদ্দেশ্য ছিল তার রাজনৈতিক মিত্র সাবেক প্রেসিডেন্ট জাইর বোলসোনারোকে সুবিধা দেওয়া। বোলসোনারোর বিরুদ্ধে বর্তমানে অভ্যুত্থান ষড়যন্ত্রের মামলা চলছে।
শুল্ক ঘোষণার আগে যুক্তরাষ্ট্র ইঙ্গিত দিয়েছিল, ব্রাজিলের কৌশলগত খনিজে প্রবেশাধিকারকে বাণিজ্য আলোচনার অংশ করতে হবে। এর জবাবে প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভা কঠোর ভাষায় প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, “কেউ ব্রাজিলের সম্পদে হাত দিতে পারবে না। এ দেশ ব্রাজিলের জনগণের।”
চীনের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ ভাঙার চেষ্টা
রেয়ার আর্থ খনিজ পৃথিবীর ভূত্বকে তুলনামূলকভাবে প্রচুর থাকলেও এগুলো আলাদা ও প্রক্রিয়াজাত করা জটিল। চীন শুধু খনিই নয়, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও চুম্বক তৈরির ক্ষেত্রেও একচেটিয়া অবস্থান তৈরি করেছে। ফলে পশ্চিমা দেশগুলো এ খাতে পিছিয়ে পড়েছে।
চীন আগে জাপানের ওপর সরবরাহ বন্ধ করেছিল, আর বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ওপরও সীমাবদ্ধতা আরোপ করছে। এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র নতুন উৎস খুঁজছে। পেন্টাগন ইতিমধ্যে এমপি ম্যাটেরিয়ালস নামের একটি মার্কিন কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেছে, যাতে চীনের প্রভাব কমানো যায়।
ব্রাজিলকেই এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করা হচ্ছে। দেশটির প্রায় ২১ মিলিয়ন টন রিজার্ভ রয়েছে, যদিও তা কাজে লাগাতে এখনও সময় লাগবে। বর্তমানে মাত্র একটি খনি (যেটির পেছনে মার্কিন বিনিয়োগও রয়েছে) সামান্য পরিমাণ উৎপাদন করছে, তবে সেগুলো প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য চীনে পাঠাতে হচ্ছে।
আলোচনার পটভূমি ও ভাটা
২০১৯ সালের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র ব্রাজিলকে প্রযুক্তিগত সহায়তা ও বিনিয়োগ দিতে বেশ আগ্রহ দেখিয়েছিল। বাইডেন প্রশাসনের সময়ে একাধিক প্রতিনিধি দল ব্রাজিল সফর করে। ব্রাজিলও তখন আগ্রহী অংশীদার ছিল।
কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসন ক্ষমতায় আসার পর সুর বদলায়। জুলাই মাসে উচ্চ শুল্কের হুমকির পর যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিক গ্যাব্রিয়েল এসকোবার ব্রাজিলের খনন সংগঠনের সঙ্গে আবার বৈঠক করেন। তখন যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি জানিয়ে দেয়, তারা ব্রাজিলের কৌশলগত খনিজে প্রবেশাধিকার চায়। এতে ব্রাজিলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।
তবে শুল্ক কার্যকর হওয়ার পর কিছু ব্রাজিলীয় কর্মকর্তা নরম সুরে জানান যে, আলোচনার টেবিলে রেয়ার আর্থ বিষয়টি আনা যেতে পারে। কিন্তু পরে আলোচনায় স্থবিরতা নেমে আসে।
রাজনৈতিক টানাপোড়েন
ট্রাম্পের দাবি, ব্রাজিলকে বোলসোনারোর মামলার বিষয়টি বাদ দিতে হবে, অথচ লুলার সরকার মনে করে গণতন্ত্র রক্ষায় মামলাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণে আলোচনায় অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।
সম্প্রতি ট্রাম্প ব্রাজিলকে “ভয়াবহ বাণিজ্য অংশীদার” বলে মন্তব্য করেন। জবাবে লুলা বলেন, ব্রাজিল আসলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যে ঘাটতিতেই রয়েছে। তিনি যোগ করেন, “আমরা আলোচনায় প্রস্তুত, তবে ব্রাজিল কখনো যুক্তরাষ্ট্রের সামনে মাথা নত করবে না।”
ব্রাজিলের নতুন দিকনির্দেশ
এখন ব্রাজিল যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া এগিয়ে যাওয়ার পথ খুঁজছে। স্পেনের একটি ম্যাপিং কোম্পানির সহায়তায় রিজার্ভের মানচিত্র তৈরি করছে এবং দুই ডজনেরও বেশি আন্তর্জাতিক কোম্পানি ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় প্রক্রিয়াজাতকরণ সক্ষমতা গড়ে তোলার চেষ্টা করছে।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক তালিকায় রেয়ার আর্থ বাদ পড়ায় মার্কিন কোম্পানিগুলো সেখানে বিনিয়োগে অনীহা দেখাতে পারে। সাবেক মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন, এতে মূলত যুক্তরাষ্ট্র নিজের জন্যই এক ধরনের নিষেধাজ্ঞা তৈরি করছে।
ব্রাজিলের বিপুল রেয়ার আর্থ ভাণ্ডার বিশ্বশক্তিগুলোর জন্য কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্র চীনের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ ভাঙতে চাইলেও বর্তমান রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে এ সহযোগিতা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। লুলা সরকার এখন নতুন মিত্রদের সঙ্গে এগিয়ে যেতে চাচ্ছে, যা বৈশ্বিক খনিজ সরবরাহে নতুন সমীকরণ তৈরি করতে পারে।
ব্রাজিলের রেয়ার আর্থ খনিজ নিয়ে অচলাবস্থা: মার্কিন শুল্ক আলোচনায় ভাটা
-
সারাক্ষণ রিপোর্ট - ১২:২৯:০৬ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৭ অগাস্ট ২০২৫
- 47
জনপ্রিয় সংবাদ




















