৮৮ বছর বয়সেও নতুন চ্যালেঞ্জ
থাইল্যান্ডের শীর্ষ ভোক্তা পণ্য উৎপাদক ও বিতরণকারী প্রতিষ্ঠান সাহা গ্রুপের চেয়ারম্যান বুনসিতি চোকওয়াতানা গত ২৫ জুলাই নিজের ৮৮তম জন্মদিনে কর্মীদের উদ্দেশে এক গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দেন। তিনি জানান, এখন আর শুধু ঐতিহ্যগত ব্যবসা যথেষ্ট নয়, প্রতিষ্ঠানকে দ্রুত ডিজিটালমুখী হতে হবে। তার ভাষায়, “ই-কমার্স থাইল্যান্ডে বড় ধরনের পরিবর্তন আনছে। আমাদের জরুরি ভিত্তিতে ডিজিটাল কোম্পানিতে রূপান্তরিত হতে হবে।”
নতুন উদ্যোগ: ই-কমার্স ডিজিটাল থাই হোল্ডিং
২০২৪ সালের শেষদিকে বুনসিতি চালু করেন ই-কমার্স ডিজিটাল থাই হোল্ডিং (EDTH) নামের নতুন প্রতিষ্ঠান। এর লক্ষ্য সাহা গ্রুপের প্রায় ৩০০টি সহযোগী কোম্পানিকে ডিজিটাল পথে রূপান্তর করা। প্রাথমিকভাবে ১ বিলিয়ন বাথ (প্রায় ৩০ মিলিয়ন ডলার) মূলধন দিয়ে শুরু হওয়া এ ইউনিটকে তিনি আগামী প্রজন্মের জন্য প্রধান প্রবৃদ্ধির ইঞ্জিন হিসেবে দেখতে চান।

এই নতুন ইউনিট ইতোমধ্যেই অ্যামাজন ওয়েব সার্ভিসেস (AWS)-এর সঙ্গে চুক্তি করেছে এবং বিশ্বখ্যাত লজিস্টিক কোম্পানি ডিএইচএল (DHL)-এর সঙ্গে অংশীদারিত্ব করেছে, যাতে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য সরবরাহ জোরদার করা যায়। ভবিষ্যতে বিদেশি প্রভাবশালী বাজার যেমন দক্ষিণ কোরিয়া ও মালয়েশিয়ায় থাই পণ্য পৌঁছাতে ইনফ্লুয়েন্সারদের সাহায্যে লাইভ-কমার্স প্ল্যাটফর্ম তৈরির পরিকল্পনাও রয়েছে।
লক্ষ্য লাজাদা-শপির মতো প্ল্যাটফর্ম
বুনসিতি চীনা ই-কমার্স মডেল থেকে শিক্ষা নিয়ে বলেছেন, “আমরা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় লাজাদা বা শপির মতো একটি শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে চাই।” তবে এই প্ল্যাটফর্ম শুধু সাহা গ্রুপের পণ্য নয়, তৃতীয় পক্ষের বিক্রেতাদের পণ্যও সরবরাহ করবে। তার বিশ্বাস, সাহা গ্রুপের নামের বিশ্বাসযোগ্যতা নতুন প্ল্যাটফর্মকে এগিয়ে নেবে।
ভবিষ্যতের বিনিয়োগ পরিকল্পনা
ইডিটিএইচ আগামীতে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক কৌশলগত অংশীদারদের বিনিয়োগ আহ্বান করবে এবং মূলধন ১০ বিলিয়ন বাথ পর্যন্ত বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে। এমনকি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তির (IPO) কথাও ভাবছে। বুনসিতি বলেছেন, “আগামী ১০ বছরেই সাহার ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে।”

ইতিহাস ও সম্প্রসারণ
১৯৪২ সালে ব্যাংককের চায়না টাউনে একটি ছোট দোকান থেকে সাহা গ্রুপের যাত্রা শুরু হয়। প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন বুনসিতির বাবা থিয়াম, যিনি চাওঝোউ, চীন থেকে এসেছিলেন। ১৯৯১ সালে নেতৃত্ব হাতে নেওয়ার পর বুনসিতি প্রতিষ্ঠানটিকে ৩০ হাজারেরও বেশি পণ্যের উৎপাদক ও বিতরণকারী জায়ান্টে পরিণত করেন—যার মধ্যে রয়েছে ডিটারজেন্ট, প্রসাধনী, ইনস্ট্যান্ট নুডলস।
তিনি জাপানি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে ব্র্যান্ড গড়েন, যেমন ওয়াকোআল (অন্তর্বাস), লায়ন (ভোক্তা পণ্য), লসন (কনভেনিয়েন্স স্টোর) ও ডন ডনকি (খুচরা চেইন)। এ কারণেই তাকে থাইল্যান্ডের “ভোক্তা সাম্রাজ্যের রাজা” বলা হয়।
অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ ও ধীরগতির ডিজিটাল পরিবর্তন
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, সাহার প্রবৃদ্ধি এখন অনিশ্চিত। থাই অর্থনীতি দুর্বল, ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতা কমছে। জনপ্রিয় ব্র্যান্ড ‘মামা’ নুডলসের বিক্রিও প্রভাবিত হচ্ছে। থাইল্যান্ডের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ২০২৫ সালে সর্বোচ্চ ২.৩% হতে পারে, যা আগের বছরের চেয়ে কম।

এমন পরিস্থিতিতে সাহার ডিজিটাল রূপান্তর জরুরি। ব্যাংককভিত্তিক এক কনসালট্যান্টের মতে, “সাহার কোনো কেন্দ্রীয় কোম্পানি নেই যা ডিজিটালাইজেশন বা প্রবৃদ্ধি কৌশলকে নেতৃত্ব দেয়। ফলে প্রায় ৩০০ প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি আলাদাভাবে কাজ করছে।”
প্রতিযোগিতা ও নতুন কৌশল
২০২৫ সালে থাইল্যান্ডের ই-কমার্স বাজারের আকার ২২.৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে, যা ২০২৯ সালে ৩২.২ বিলিয়ন ডলার হতে পারে। তবে বাজার ইতোমধ্যেই শপিই, লাজাদা ও টিকটক শপের দখলে—যারা যথাক্রমে ৫১%, ২৫% ও ২৪% শেয়ার নিয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, “যদি সাহা কেবল নকল মডেল দাঁড় করায়, তবে সফল হওয়া কঠিন। আলাদা বৈশিষ্ট্য থাকতে হবে।” এখানে এডব্লিউএস-এর অংশীদারিত্ব সাহাকে ই-কমার্সের বাইরে লজিস্টিক, গ্রাহক ব্যবস্থাপনা ও ডেটা সেন্টার খাতে বড় খেলোয়াড় বানাতে পারে।

প্রজন্ম পরিবর্তন ও নেতৃত্বে পরিবর্তন
যদিও সাহা গ্রুপ ঐতিহ্যগতভাবে পরিবার-নির্ভর, বুনসিতি এখন পেশাদার বাইরের নেতৃত্বকেও গুরুত্ব দিতে চান। তিনি বলেছেন, “পরিবারের সদস্যদের ব্যবস্থাপনায় থাকার প্রয়োজন নেই। তারা শেয়ারহোল্ডার হিসেবে থাকতে পারে, আর ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব বাইরের প্রতিভাবান পেশাজীবীদের দেওয়া উচিত।”
বর্তমানে তার বড় ছেলে থামারাত আইসিসি ইন্টারন্যাশনালের প্রেসিডেন্ট এবং মেয়ের জামাতা ভিচাই সাহা পাঠানা ইন্টার-হোল্ডিং-এর প্রধান নির্বাহী। তবু বুনসিতি চান নতুন প্রজন্ম, পরিবার হোক বা বাইরের মানুষ, তার শুরু করা ই-কমার্স উদ্যোগকে এগিয়ে নিয়ে যাক। তার ভাষায়, “আমার প্রজন্মের অভিজ্ঞতা এখন আর ততটা কার্যকর নয়। নতুন প্রজন্মই ভবিষ্যতের চাবিকাঠি।”
৮৮ বছর বয়সেও বুনসিতি চোকওয়াতানা সাহা গ্রুপকে ডিজিটাল যুগে প্রবেশ করানোর নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তিনি চান, আগামী প্রজন্ম নতুন চিন্তাভাবনা দিয়ে সাহাকে টিকিয়ে রাখুক এবং থাইল্যান্ডে যেমন, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও প্রতিযোগিতায় সক্ষম করুক।

সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















