০৭:০৮ অপরাহ্ন, শনিবার, ০৮ নভেম্বর ২০২৫
নাইজেরিয়া বন্যপ্রাণী পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির আইন পাস করল মাইক্রোসফট ও জি৪২ সংযুক্ত আরব আমিরাতে ডেটা-সেন্টার বিস্তার ঘোষণা বড় টেকের চাপের মুখে ইইউ এইআই আইন বাস্তবায়ন বিলম্বে বিবেচনায় বাংলাদেশ আমেরিকা থেকে গম কিনছে, বাণিজ্য উত্তেজনা কমাতে বড় পদক্ষেপ ব্লেক লাইভলির মামলায় সাক্ষী টেইলর সুইফট ও হিউ জ্যাকম্যান; ক্ষতিপূরণের দাবি ১৬১ মিলিয়ন ডলার ডাক রাশ্মিকার ‘দ্য গার্লফ্রেন্ড’ প্রথম দিনেই ব্যর্থতার মুখে ৩ দফা দাবি: শহীদ মিনারে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অবস্থান কর্মসূচি গাজীপুরে তুলার গুদামে আগুন নিয়ন্ত্রণে সেন্ট মেরি ক্যাথেড্রাল চার্চে বিস্ফোরণ: তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ

ক্রীড়াবিদদের মধ্যে খাওয়ার ব্যাধির ঝুঁকি

  • Sarakhon Report
  • ০২:২৭:৫৬ অপরাহ্ন, রবিবার, ৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • 116

আকিকো সুজুকির অভিজ্ঞতা

জাপানি ফিগার স্কেটার আকিকো সুজুকি কিশোর বয়সে শুনেছিলেন তার আদর্শ ওজন হওয়া উচিত ৪৭ কেজি। তিনি সরল মনে তা মেনে নিয়েছিলেন। এর ফলে খাবারের সঙ্গে তার সম্পর্ক নষ্ট হয় এবং তিনি অ্যানোরেক্সিয়ায় আক্রান্ত হন।
২০০৩ সালের বসন্তে এক প্রতিযোগিতা শেষে বিমানবন্দরে মাংস খাওয়ার পর তিনি বাথরুমে গিয়ে সব বমি করে ফেলেন। প্রথমে ভেবেছিলেন এটি কেবল নতুন খাবারের প্রতিক্রিয়া। কিন্তু ধীরে ধীরে তার ওজন ৪৮ থেকে ৪০ কেজি হয়ে যায়। কিছুদিন পর নেমে আসে ৩২ কেজিতে। উচ্চতা ১৬০ সেন্টিমিটার হলেও নিজেকে সবসময় অন্য স্কেটারদের সঙ্গে তুলনা করতেন। হাত-পা লম্বা করতে না পারলেও ওজন নিয়ন্ত্রণই তার কাছে একমাত্র উপায় ছিল।


খাওয়ার ব্যাধি কী এবং কেন ঝুঁকি বেশি

অ্যানোরেক্সিয়া (নিজেকে না খাইয়ে রাখা) ও বুলিমিয়া (অতিরিক্ত খাওয়া ও বমি করা) হচ্ছে সবচেয়ে প্রচলিত খাওয়ার ব্যাধি। জাপানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী প্রায় আড়াই লাখ মানুষ এ সমস্যায় ভুগছেন। মৃত্যুহার ৫ শতাংশ পর্যন্ত।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ক্রীড়াবিদরা এ ব্যাধির ঝুঁকিতে বেশি থাকেন। কারণ শারীরিক সক্ষমতার জন্য তাদের শরীরের ওপর প্রবল চাপ থাকে। বিশেষত মেয়েরা নান্দনিক খেলায় বা ওজননির্ভর খেলায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।


ভয়, চাপ এবং পারিবারিক প্রভাব

সুজুকি শৈশব থেকেই পরিবারের প্রত্যাশা ও খেলার সৌন্দর্য-ভিত্তিক মূল্যায়নের কারণে খাবারের সঙ্গে জটিল সম্পর্ক তৈরি করেন। তিনি মিষ্টি এড়িয়ে চলতেন, খাবার নিয়ন্ত্রণে রাখতেন, এমনকি হাইস্কুলে গিয়ে পুরোপুরি মাংস খাওয়া বন্ধ করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর স্বাধীনভাবে খাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে আরও সংকটে পড়েন। ক্ষুধা লাগলেও তিনি লাইব্রেরিতে লুকিয়ে থাকতেন যাতে কেউ তাকে ক্যাফেটেরিয়ায় না দেখে। ওজন নিয়ে উদ্বেগ তাকে গ্রাস করত: “আমি কি যথেষ্ট পাতলা? আমার ওজনই কি আমার মূল্য নির্ধারণ করছে?”


অসুস্থতা ও পুনরুদ্ধারের পথ

অ্যানোরেক্সিয়ার সাধারণ উপসর্গ যেমন শীত লাগা, রক্ত সঞ্চালন কমে যাওয়া, অনিদ্রা, মাথা ঘোরা, চুল পড়া—সবই তিনি ভুগেছেন। পরিবার ও কোচের সহায়তায় কিছুদিন খেলা থেকে দূরে থেকে চিকিৎসা নেন। ধীরে ধীরে প্রোটিন খাওয়া শুরু করে সুস্থতার পথে ফেরেন।
২০০৪-০৫ মৌসুমে আবার প্রতিযোগিতায় ফিরে আসেন এবং দুই শীতকালীন অলিম্পিকে অংশ নেন। পরবর্তীতে তিনি কোরিওগ্রাফার, টিভি ভাষ্যকার ও বক্তা হিসেবে কাজ শুরু করেন।


তাকাহিরো ফুজির গল্প

বক্সার তাকাহিরো ফুজি একই ধরনের সমস্যায় পড়েন। ওজন মাপের চাপ তাকে বুলিমিয়ার দিকে ঠেলে দেয়। কখনো দিনে ছয় ঘণ্টা সাউনায় থেকেছেন, আবার কখনো দৌড়ের সময় ভারী পোশাক পরে অতিরিক্ত ঘাম ঝরিয়েছেন। একবার ৫০০ গ্রাম কমাতে না পেরে রক্ত বের করার চেষ্টা পর্যন্ত করেন।
তিনি মানসিক চাপে খাবার গিলতেন, পরে নিজেকে বমি করাতেন। ২৩ বছর বয়সে শুরু হওয়া এ প্রবণতা কয়েক বছর চলতে থাকে। পরে নিজেই বুঝতে পারেন তিনি বুলিমিয়া ও বিষণ্নতায় ভুগছেন।

অবশেষে খেলাধুলা ছেড়ে পাহাড়ে কৃষিকাজ ও দৌড়ানোর মাধ্যমে মানসিক শান্তি খুঁজে পান। কয়েক বছর পর আবার খেলায় ফেরেন। এখন ৩৬ বছর বয়সে তিনি ওজন না কমিয়েই এমএমএ-তে অংশ নিচ্ছেন। নিয়মিত তিন বেলা খাচ্ছেন এবং আগের চেয়ে অনেক সুস্থ বোধ করছেন।


বিশেষজ্ঞদের মতামত

টোকিওর মেইজি গাকুইন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আয়া নিশিজোনো মাহা মনে করেন, খাওয়ার ব্যাধি শুধু পাতলা হওয়ার বাসনা থেকে আসে না। ক্রীড়াক্ষেত্রে মানসিক চাপ, কোচ-অ্যাথলেট সম্পর্ক এবং সামাজিক প্রভাবও বড় ভূমিকা রাখে।
তিনি বলেন, ক্রীড়াবিদদের স্বাস্থ্যসেবা বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে সহায়তা নেওয়ার সংস্কৃতি তৈরি করতে হবে। কোচদের উচিত নয় চিকিৎসা তদারকি করা, বরং সমস্যার প্রাথমিক লক্ষণ দেখলে বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠানো।


পুনরুদ্ধার ও আশার বার্তা

সুজুকি আজ মনে করেন, অ্যানোরেক্সিয়া জয় করা সম্ভব। তিনি এখন নিয়মিত পিলাটিস করেন, পেশি গঠন করার চেষ্টা করছেন এবং ওজন মাপার যন্ত্র ব্যবহার করেন না। তার বার্তা: সুস্থ দেহ মানে কেবল ওজনের সংখ্যা নয়।
অন্যদিকে ফুজি স্বীকার করেন, মানসিক স্বাস্থ্য জটিল বিষয় এবং পুনরুদ্ধার সরল পথ নয়। তবুও তিনি বিশ্বাস করেন সঠিক পরিবেশ ও সহায়ক মানুষ থাকলে খেলোয়াড়রা হতাশা থেকে বের হতে পারেন।


খাওয়ার ব্যাধি একটি গুরুতর মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্য সমস্যা। এটি ক্রীড়াবিদদের জন্য নীরব যুদ্ধের মতো, যা বাহ্যিক সাফল্যের আড়ালে লুকিয়ে থাকে। আকিকো সুজুকি ও তাকাহিরো ফুজির অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে, সঠিক সহায়তা, মানসিক শক্তি এবং সামাজিক সমর্থন পেলে এই সংকট থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।

জনপ্রিয় সংবাদ

নাইজেরিয়া বন্যপ্রাণী পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির আইন পাস করল

ক্রীড়াবিদদের মধ্যে খাওয়ার ব্যাধির ঝুঁকি

০২:২৭:৫৬ অপরাহ্ন, রবিবার, ৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫

আকিকো সুজুকির অভিজ্ঞতা

জাপানি ফিগার স্কেটার আকিকো সুজুকি কিশোর বয়সে শুনেছিলেন তার আদর্শ ওজন হওয়া উচিত ৪৭ কেজি। তিনি সরল মনে তা মেনে নিয়েছিলেন। এর ফলে খাবারের সঙ্গে তার সম্পর্ক নষ্ট হয় এবং তিনি অ্যানোরেক্সিয়ায় আক্রান্ত হন।
২০০৩ সালের বসন্তে এক প্রতিযোগিতা শেষে বিমানবন্দরে মাংস খাওয়ার পর তিনি বাথরুমে গিয়ে সব বমি করে ফেলেন। প্রথমে ভেবেছিলেন এটি কেবল নতুন খাবারের প্রতিক্রিয়া। কিন্তু ধীরে ধীরে তার ওজন ৪৮ থেকে ৪০ কেজি হয়ে যায়। কিছুদিন পর নেমে আসে ৩২ কেজিতে। উচ্চতা ১৬০ সেন্টিমিটার হলেও নিজেকে সবসময় অন্য স্কেটারদের সঙ্গে তুলনা করতেন। হাত-পা লম্বা করতে না পারলেও ওজন নিয়ন্ত্রণই তার কাছে একমাত্র উপায় ছিল।


খাওয়ার ব্যাধি কী এবং কেন ঝুঁকি বেশি

অ্যানোরেক্সিয়া (নিজেকে না খাইয়ে রাখা) ও বুলিমিয়া (অতিরিক্ত খাওয়া ও বমি করা) হচ্ছে সবচেয়ে প্রচলিত খাওয়ার ব্যাধি। জাপানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী প্রায় আড়াই লাখ মানুষ এ সমস্যায় ভুগছেন। মৃত্যুহার ৫ শতাংশ পর্যন্ত।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ক্রীড়াবিদরা এ ব্যাধির ঝুঁকিতে বেশি থাকেন। কারণ শারীরিক সক্ষমতার জন্য তাদের শরীরের ওপর প্রবল চাপ থাকে। বিশেষত মেয়েরা নান্দনিক খেলায় বা ওজননির্ভর খেলায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।


ভয়, চাপ এবং পারিবারিক প্রভাব

সুজুকি শৈশব থেকেই পরিবারের প্রত্যাশা ও খেলার সৌন্দর্য-ভিত্তিক মূল্যায়নের কারণে খাবারের সঙ্গে জটিল সম্পর্ক তৈরি করেন। তিনি মিষ্টি এড়িয়ে চলতেন, খাবার নিয়ন্ত্রণে রাখতেন, এমনকি হাইস্কুলে গিয়ে পুরোপুরি মাংস খাওয়া বন্ধ করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর স্বাধীনভাবে খাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে আরও সংকটে পড়েন। ক্ষুধা লাগলেও তিনি লাইব্রেরিতে লুকিয়ে থাকতেন যাতে কেউ তাকে ক্যাফেটেরিয়ায় না দেখে। ওজন নিয়ে উদ্বেগ তাকে গ্রাস করত: “আমি কি যথেষ্ট পাতলা? আমার ওজনই কি আমার মূল্য নির্ধারণ করছে?”


অসুস্থতা ও পুনরুদ্ধারের পথ

অ্যানোরেক্সিয়ার সাধারণ উপসর্গ যেমন শীত লাগা, রক্ত সঞ্চালন কমে যাওয়া, অনিদ্রা, মাথা ঘোরা, চুল পড়া—সবই তিনি ভুগেছেন। পরিবার ও কোচের সহায়তায় কিছুদিন খেলা থেকে দূরে থেকে চিকিৎসা নেন। ধীরে ধীরে প্রোটিন খাওয়া শুরু করে সুস্থতার পথে ফেরেন।
২০০৪-০৫ মৌসুমে আবার প্রতিযোগিতায় ফিরে আসেন এবং দুই শীতকালীন অলিম্পিকে অংশ নেন। পরবর্তীতে তিনি কোরিওগ্রাফার, টিভি ভাষ্যকার ও বক্তা হিসেবে কাজ শুরু করেন।


তাকাহিরো ফুজির গল্প

বক্সার তাকাহিরো ফুজি একই ধরনের সমস্যায় পড়েন। ওজন মাপের চাপ তাকে বুলিমিয়ার দিকে ঠেলে দেয়। কখনো দিনে ছয় ঘণ্টা সাউনায় থেকেছেন, আবার কখনো দৌড়ের সময় ভারী পোশাক পরে অতিরিক্ত ঘাম ঝরিয়েছেন। একবার ৫০০ গ্রাম কমাতে না পেরে রক্ত বের করার চেষ্টা পর্যন্ত করেন।
তিনি মানসিক চাপে খাবার গিলতেন, পরে নিজেকে বমি করাতেন। ২৩ বছর বয়সে শুরু হওয়া এ প্রবণতা কয়েক বছর চলতে থাকে। পরে নিজেই বুঝতে পারেন তিনি বুলিমিয়া ও বিষণ্নতায় ভুগছেন।

অবশেষে খেলাধুলা ছেড়ে পাহাড়ে কৃষিকাজ ও দৌড়ানোর মাধ্যমে মানসিক শান্তি খুঁজে পান। কয়েক বছর পর আবার খেলায় ফেরেন। এখন ৩৬ বছর বয়সে তিনি ওজন না কমিয়েই এমএমএ-তে অংশ নিচ্ছেন। নিয়মিত তিন বেলা খাচ্ছেন এবং আগের চেয়ে অনেক সুস্থ বোধ করছেন।


বিশেষজ্ঞদের মতামত

টোকিওর মেইজি গাকুইন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আয়া নিশিজোনো মাহা মনে করেন, খাওয়ার ব্যাধি শুধু পাতলা হওয়ার বাসনা থেকে আসে না। ক্রীড়াক্ষেত্রে মানসিক চাপ, কোচ-অ্যাথলেট সম্পর্ক এবং সামাজিক প্রভাবও বড় ভূমিকা রাখে।
তিনি বলেন, ক্রীড়াবিদদের স্বাস্থ্যসেবা বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে সহায়তা নেওয়ার সংস্কৃতি তৈরি করতে হবে। কোচদের উচিত নয় চিকিৎসা তদারকি করা, বরং সমস্যার প্রাথমিক লক্ষণ দেখলে বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠানো।


পুনরুদ্ধার ও আশার বার্তা

সুজুকি আজ মনে করেন, অ্যানোরেক্সিয়া জয় করা সম্ভব। তিনি এখন নিয়মিত পিলাটিস করেন, পেশি গঠন করার চেষ্টা করছেন এবং ওজন মাপার যন্ত্র ব্যবহার করেন না। তার বার্তা: সুস্থ দেহ মানে কেবল ওজনের সংখ্যা নয়।
অন্যদিকে ফুজি স্বীকার করেন, মানসিক স্বাস্থ্য জটিল বিষয় এবং পুনরুদ্ধার সরল পথ নয়। তবুও তিনি বিশ্বাস করেন সঠিক পরিবেশ ও সহায়ক মানুষ থাকলে খেলোয়াড়রা হতাশা থেকে বের হতে পারেন।


খাওয়ার ব্যাধি একটি গুরুতর মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্য সমস্যা। এটি ক্রীড়াবিদদের জন্য নীরব যুদ্ধের মতো, যা বাহ্যিক সাফল্যের আড়ালে লুকিয়ে থাকে। আকিকো সুজুকি ও তাকাহিরো ফুজির অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে, সঠিক সহায়তা, মানসিক শক্তি এবং সামাজিক সমর্থন পেলে এই সংকট থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।