সংক্ষিপ্তসার
- সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত উল্টো ফল বয়ে আনে,সহিংসতা ছড়ায়
- দুর্নীতি দমন ও অর্থনীতি চাঙা করতে ব্যর্থতার অভিযোগ
- চীনের ঘনিষ্ঠ ভাবা হলেও নিরপেক্ষতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ওলি
আকস্মিক পদত্যাগ
নেপালের কমিউনিস্ট নেতা কে.পি. শর্মা ওলি এক বছর আগে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়ে স্থিতিশীলতা ও কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু গত মঙ্গলবার (৯ সেপ্টেম্বর) দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলনে সহিংসতা, ১৯ জনের প্রাণহানি ও স্বৈরতান্ত্রিক আচরণের অভিযোগের মুখে তিনি আকস্মিকভাবে পদত্যাগ করেন।
এই পদত্যাগ আধুনিক নেপালের অস্থির রাজনৈতিক চিত্রকে প্রতিফলিত করে। ওলি চারবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, কিন্তু প্রতিবারই নানা বিতর্ক ও অস্থিরতার সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন।

প্রতিবাদের আগুনে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন
ওলির ঘনিষ্ঠ এক সহযোগী জানান, তার ব্যক্তিগত বাসভবনে বিক্ষোভকারীরা আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। টেলিভিশনে সম্প্রচারিত ছবিতে দেখা যায়, বিক্ষুব্ধ জনতা বাসভবনে প্রবেশ করে জানালা, চেয়ার, হাঁড়ি-পাতিল ভাঙচুর চালিয়ে ভবনে আগুন দেয়। নিরাপত্তা বাহিনী সংখ্যায় কম থাকায় দূর থেকে কেবল তাকিয়ে থাকে।
প্রখ্যাত সংবিধান বিশেষজ্ঞ বিপিন অধিকারী বলেন, “জনগণের মধ্যে দীর্ঘদিনের অসন্তোষ হঠাৎ বিস্ফোরিত হয়েছে। সহিংসতায় সবাই তীব্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ও ক্ষুব্ধ হয়েছে।”
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিষেধাজ্ঞা ও তরুণ প্রজন্মের নেতৃত্ব
গত সপ্তাহে ফেসবুকসহ কয়েকটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধের সিদ্ধান্তই মূলত ব্যাপক বিক্ষোভের জন্ম দেয়। তরুণ প্রজন্ম বিশেষ করে জেনারেশন জেড অভিযোগ তোলে — এই সিদ্ধান্তের উদ্দেশ্য বিরোধী কণ্ঠ দমন এবং দুর্নীতিবাজ অভিজাত শ্রেণিকে রক্ষা করা।
সরকার দাবি করে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুয়া তথ্য ও প্রতারণার বিস্তার ঠেকাতেই এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু জনগণ এই যুক্তি গ্রহণ করেনি।
দুর্নীতি ও অর্থনৈতিক স্থবিরতার অভিযোগ
প্রতিবাদকারীরা অভিযোগ করেন, ওলির সর্বশেষ মেয়াদে দুর্নীতি আরও গভীর হয়েছে, অর্থনীতি থমকে গেছে এবং স্বৈরতান্ত্রিক আচরণ বেড়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতায় বিনিয়োগ আসেনি, আর কর্মসংস্থান না থাকায় লাখো তরুণ মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে কাজ খুঁজতে দেশ ছেড়েছে।

ওলির শৈশব ও রাজনৈতিক উত্থান
১৯৫২ সালে পূর্ব নেপালে জন্ম নেওয়া ওলির শৈশব ছিল দুঃখ-দুর্দশায় ভরা। চার বছর বয়সে গুটিবসন্তে মা মারা যান, বন্যায় পরিবার বাস্তুচ্যুত হয়ে দাদাবাড়িতে থাকতে বাধ্য হয়েছিল। তরুণ বয়সেই তিনি কমিউনিস্ট আন্দোলনে যুক্ত হন এবং রাজতন্ত্রের বিরোধিতার জন্য ১৯৭০ ও ৮০-এর দশকে ১৪ বছর কারাবন্দি ছিলেন।
তিনি কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল (ইউনিফায়েড মার্কসিস্ট–লেনিনিস্ট) বা সিপিএন-ইউএমএল-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং ধীরে ধীরে জাতীয় রাজনীতির কেন্দ্রীয় চরিত্রে পরিণত হন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ নানা মন্ত্রিত্ব পাওয়ার পর চারবার প্রধানমন্ত্রী হন।
ভারতের সঙ্গে টানাপোড়েন, চীনের দিকে ঝোঁক
প্রথমবার ২০১৫ সালে প্রধানমন্ত্রী হন তিনি, যখন ভারত সীমান্ত অবরোধ করে নেপালকে জ্বালানি ও ওষুধ সংকটে ফেলে। তখনই ওলির সরকার চীনের সঙ্গে ট্রানজিট চুক্তি করে ভারতের একচেটিয়া বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ ভেঙে দেয়।
এশিয়ার দুই শক্তিধর দেশ ভারত ও চীন নেপালে প্রভাব বিস্তারে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। অনেক পর্যবেক্ষক ওলিকে চীনের ঘনিষ্ঠ মনে করলেও তিনি ভারত বিরোধী জাতীয়তাবাদী অবস্থান নিয়েছিলেন। বিতর্কিত মানচিত্র প্রকাশ করে ভারত নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল নেপালের অংশ হিসেবে দাবি করেছিলেন তিনি।
তবে ২০২২ সালে রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, নেপাল তার নেতৃত্বে নিরপেক্ষ ও অজোটপন্থী থাকবে।

ওলি’র পদত্যাগ শুধু একজন নেতার পতন নয়, বরং নেপালের দীর্ঘ রাজনৈতিক অস্থিরতা ও দুর্নীতিগ্রস্ত শাসনব্যবস্থার প্রতিফলন। প্রতিবাদের আগুনে যে ক্ষোভ জ্বলে উঠেছে, তা নেপালের আগামী দিনের রাজনীতির গতিপথ নির্ধারণে বড় ভূমিকা রাখবে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















