চীনের জন্য হরমুজ প্রণালীর গুরুত্ব
চীনের মোট তেল আমদানির প্রায় ৪০ শতাংশ হরমুজ প্রণালীর ওপর নির্ভরশীল। তাই এটি চীনের অর্থনীতির জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ জীবনরেখা। এখানে সংঘাত, নিষেধাজ্ঞা বা সামান্য ভুল সিদ্ধান্তও জ্বালানি বাজারে বড় ধাক্কা দিতে পারে। তেলের দাম বৃদ্ধি, পরিবহন খরচ বাড়া এবং শিল্প উৎপাদনে চাপ সৃষ্টি হওয়া অনিবার্য হয়ে উঠবে।
কৌশলগত অবস্থান ও চীনের অগ্রাধিকার
চীন সামরিক শক্তি প্রদর্শনের বদলে কূটনৈতিক উদ্যোগ, অবকাঠামো বিনিয়োগ এবং নীরব নিরাপত্তা সহযোগিতাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। এই কৌশলের দুটি মূল উদ্দেশ্য হলো:
- আঞ্চলিক শক্তির দ্বন্দ্বে সরাসরি না জড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোনো দেশের সঙ্গে সংঘর্ষ এড়ানো।
- পারস্য উপসাগরের তেল উৎপাদনকারী দেশ ও ইরানের সঙ্গে বিশ্বাসযোগ্য সম্পর্ক বজায় রাখা, যাতে দীর্ঘমেয়াদি সরবরাহ নিশ্চিত থাকে।

চীন অর্থনৈতিক আন্তঃনির্ভরশীলতাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। বন্দর, পাইপলাইন ও চুক্তির মাধ্যমে প্রভাব বিস্তার করলেও প্রকাশ্যে সামরিক শক্তি দেখাচ্ছে না।
সীমিত উপস্থিতির দুর্বলতা
এই সীমিত উপস্থিতি চীনের জন্য দুর্বলতাও বয়ে এনেছে। পারস্য উপসাগরের দেশগুলো সন্দেহ করছে, সংকটকালীন পরিস্থিতিতে চীন কতটা সক্রিয় ভূমিকা নেবে। যৌথ নৌ মহড়া বা প্রকাশ্য প্রতিশ্রুতির অভাব অনেকের কাছে মনে হচ্ছে যে চীন নীরবে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন নিরাপত্তা কাঠামোকেই সমর্থন করছে। এর ফলে চীনের কূটনৈতিক প্রভাব ও সমান অংশীদার হওয়ার প্রচেষ্টা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
শক্তিশালী ভূমিকার প্রত্যাশা
একটি প্রকৃত শক্তিশালী ভূমিকা মানে কেবল তেল চুক্তি নয়, বরং আরও এগিয়ে যাওয়া। একতরফা নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান, নিয়মিত যৌথ মহড়া এবং প্রকাশ্য প্রতিশ্রুতি প্রয়োজন। এগুলো পারস্য উপসাগরের দেশগুলোকে আশ্বস্ত করবে যে চীন কেবল অর্থনৈতিক নয়, নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও দায়িত্ব ভাগ করতে প্রস্তুত।

সাম্প্রতিক সংঘাত ও ঝুঁকি
সাম্প্রতিক ১২ দিনের ইরান-ইসরায়েল সংঘাত এই ভঙ্গুর ভারসাম্যকে সামনে নিয়ে এসেছে। ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র ইরানের সামরিক ও পারমাণবিক স্থাপনায় আঘাত হানে, আর ইরান পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালায়। যদিও সংঘাত দ্রুত থেমে যায়, তবুও নতুন করে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়ে গেছে। একটি মাত্র ভুল হিসাবেই অঞ্চলটি আবার বড় যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা সরাসরি যুক্ত হবে।
যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যেই পারস্য উপসাগরে বিশাল সামরিক উপস্থিতি বজায় রেখেছে—কাতার ও বাহরাইনে বিমান ঘাঁটি, নৌবাহিনী এবং কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরবে অগ্রবর্তী সেনা রয়েছে। অন্যদিকে ইরান বহুবার সতর্ক করেছে যে পরিস্থিতি খারাপ হলে তারা হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দেবে।
প্রণালী বন্ধের সম্ভাব্য প্রভাব
হরমুজ প্রণালী সাময়িক সময়ের জন্যও বন্ধ হয়ে গেলে বিশ্ব অর্থনীতির একাধিক খাত বড় ধাক্কা খাবে।
- পেট্রোকেমিক্যাল শিল্পে ন্যাফথা সংকট দেখা দেবে, ইথিলিনের দাম বেড়ে যাবে।
- প্লাস্টিক শিল্পে কাঁচামালের ঘাটতি তৈরি হবে।
- ভারত ও ব্রাজিলের মতো দেশের সার আমদানিতে দেরি ও ব্যয় বৃদ্ধি পাবে।
- জাহাজগুলোকে আফ্রিকা ঘুরে আসতে হলে পরিবহন ব্যয় হঠাৎ অনেক বেড়ে যাবে।
সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে চীন, যার আমদানির বড় অংশই এই প্রণালীর ওপর নির্ভরশীল।

চীনের সামনে দ্বিধা
এখন চীনের সামনে একটি স্পষ্ট দ্বিধা—সতর্ক কূটনীতি ও নীরব কৌশলে এগোনো অব্যাহত রাখা, নাকি অর্থনৈতিক প্রভাবের সঙ্গে বাস্তব প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা যুক্ত করা। এতদিন নীরব কৌশল ট্যাঙ্কার চলাচল সচল রেখেছিল, তবে সাম্প্রতিক পরিস্থিতি চীনের ওপর আরও সক্রিয় ভূমিকা নেওয়ার চাপ তৈরি করছে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















