১০ সেপ্টেম্বর উটাহ ভ্যালি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে চার্লি কার্ক তাঁর মতো করেই বক্তৃতা দিচ্ছিলেন—শিক্ষার্থীদের উসকে দিচ্ছিলেন, প্রশ্নের জবাব দিচ্ছিলেন। ৩১ বছর বয়সী টার্নিং পয়েন্ট ইউএসএর প্রতিষ্ঠাতা কার্ক কয়েক হাজার শিক্ষার্থীর সামনে মঞ্চে বসেছিলেন। ঠিক তখনই একটি গুলি তাঁর গলায় লাগে। আতঙ্কিত ভিড় ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। হাসপাতালে নেওয়া হলেও পরে তাঁর মৃত্যু হয়।
ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজের সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি নিশ্চিত করেন। তিনি লিখেন, মার্কিন যুবসমাজকে কেউই কার্কের মতো বুঝতে পারেননি। পেছনে রয়ে গেছে তাঁর স্ত্রী ও দুই সন্তান।
রাজনৈতিক সহিংসতার দীর্ঘ ছায়া
আমেরিকান রাজনীতি দীর্ঘদিন ধরে সহিংসতার ইতিহাস বহন করে আসছে। ১৯৬০-এর দশক জুড়ে কেনেডি থেকে কিং—অনেক রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতেও সেই ধারাবাহিকতা ভিন্ন আকারে চলছে।
২০২১ সালে কংগ্রেস সদস্যদের বিরুদ্ধে হুমকির সংখ্যা ৯,৬০০ ছাড়ায়। ২০২২ সালে পল পেলোসি হামলার শিকার হন, নিউইয়র্কে গভর্নর প্রার্থী লি জেলডিনকে ছুরি দিয়ে আঘাতের চেষ্টা হয়। ২০২৪ সালে ট্রাম্প নিজেও দু’বার হত্যাচেষ্টার মুখোমুখি হন। এ বছর একাধিক রাজনৈতিক হামলা, অগ্নিসংযোগ, গুলি এবং আন্তর্জাতিক উত্তেজনা সহিংসতার মাত্রা আরও বাড়িয়েছে।
প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্রিজিং ডিভাইডস ইনিশিয়েটিভের নির্বাহী পরিচালক শ্যানন হিলার বলেন, ঘৃণার ভাষা, অস্ত্রের সহজলভ্যতা, ভুয়া তথ্য এবং প্রতিষ্ঠানের প্রতি আস্থাহীনতা মিলে আমেরিকায় বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি করেছে।
কার্কের উত্থান
শিকাগো শহরতলিতে জন্ম নেওয়া কার্ক অল্প বয়সেই রক্ষণশীল রাজনীতির প্রতি ঝুঁকেন। স্কুল জীবনে লিখিত একটি প্রবন্ধ তাঁর রাজনৈতিক যাত্রার দরজা খুলে দেয়। ব্যবসায়ী বিল মন্টগোমেরির সহায়তায় তিনি টার্নিং পয়েন্ট ইউএসএ প্রতিষ্ঠা করেন। ধনী দাতাদের পৃষ্ঠপোষকতায় সংগঠনটি দ্রুত শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
তিনি কলেজ ক্যাম্পাসগুলোতে বিতর্ক উসকে দিয়ে আলোচনায় আসেন। “প্রফেসর ওয়াচলিস্ট” তৈরি করে বিতর্কিত হন। বহু বক্তব্যে সমালোচিত হলেও তিনি রক্ষণশীলদের কাছে নায়ক হয়ে ওঠেন।
টার্নিং পয়েন্ট পরে পরিণত হয় এক বিশাল সংগঠনে—গণমাধ্যম, ভোটার সংগঠন এবং হাজারো স্কুল-কলেজ চ্যাপ্টারের সমন্বয়ে।
ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সহযোগী
২০১৬ সালের নির্বাচনী প্রচারে কার্ক প্রথমে ট্রাম্পের পক্ষে ছিলেন না, কিন্তু পরে ট্রাম্প জুনিয়রের সহকারী হিসেবে যোগ দিয়ে ট্রাম্প পরিবারের ভেতরের বৃত্তে প্রবেশ করেন। এরপর থেকে তিনি ট্রাম্পের সবচেয়ে আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন।
কোভিড-১৯ মহামারির সময় তিনি মাস্ক-বিরোধী বক্তব্য, স্কুল বন্ধের সমালোচনা করে জাতীয় মিডিয়ায় জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। তাঁর জনপ্রিয় পডকাস্ট “দ্য চার্লি কার্ক শো” কোটি মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। ২০২৪ সালের নির্বাচনে তরুণ ভোটারদের টানতে তাঁর ভূমিকা ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
ভবিষ্যতের পরিকল্পনা ও আকস্মিক সমাপ্তি
২০২৫ সালের শরৎকালীন ট্যুরের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন কার্ক। তিনি নতুন বই লেখার পরিকল্পনা করেছিলেন, দীর্ঘস্থায়ী একটি আন্দোলন গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখছিলেন। এমনকি তিনি ভবিষ্যতে জেডি ভ্যান্সকে প্রেসিডেন্ট করার জন্য সমর্থনও প্রকাশ করেছিলেন।
কিন্তু হঠাৎ একটি গুলির শব্দে সব থেমে গেল। তাঁর হত্যাকাণ্ড শুধু ব্যক্তিগত ক্ষতি নয়, আমেরিকার রাজনীতিতে সহিংসতার নতুন অধ্যায় শুরুর আশঙ্কা তৈরি করেছে।
সহিংসতার অশনি সংকেত
ইতিহাসে দেখা গেছে, রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড প্রায়ই আরও বড় সহিংসতার দিকে ঠেলে দিয়েছে। মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের হত্যার পর যেমন দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়েছিল, গ্যাবি গিফোর্ডসের গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর যেমন ভয় ও অবিশ্বাস বেড়েছিল, কিংবা ৬ জানুয়ারির কংগ্রেস হামলার পর যেমন দ্বন্দ্ব তীব্র হয়েছিল।
চার্লি কার্কের হত্যাকাণ্ডও সেই দীর্ঘ শৃঙ্খলে যুক্ত হতে পারে—একটি ট্র্যাজেডি, যা হয়তো আমেরিকার রাজনীতিকে আরও বেশি অস্থিতিশীল করে তুলবে।