ভয়াবহ ক্ষতের চিত্র
আন্তর্জাতিক চিকিৎসক ও নার্সরা জানিয়েছেন, গাজার হাসপাতালে যে ধরনের ক্ষত তারা দেখেছেন তা আধুনিক যুগের অন্য যেকোনো সংঘাতের তুলনায় অনেক বেশি ভয়াবহ। চিকিৎসা বিষয়ক খ্যাতনামা ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল (বিএমজে)-তে প্রকাশিত নতুন এক গবেষণায় বলা হয়েছে, গাজার বেসামরিক মানুষের ক্ষতের ধরন ও তীব্রতা যুক্তরাষ্ট্রের সেনাদের ইরাক ও আফগানিস্তান যুদ্ধের সময়কার অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলে যায়।
জরিপের পদ্ধতি
গবেষণায় অংশ নিয়েছেন ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার ৭৮ জন মানবিক চিকিৎসাকর্মী। তারা গাজায় ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দুই থেকে বারো সপ্তাহের বিভিন্ন মেয়াদে কাজ করেছেন। দেশে ফেরার তিন মাস পর্যন্ত লগবুক ও শিফট রেকর্ড ব্যবহার করে তারা জরিপে অংশ নেন।
গবেষণায় মোট ২৩,৭০০-এর বেশি ট্রমা ইনজুরি ও সাত হাজার অস্ত্রসৃষ্ট ক্ষতের তথ্য লিপিবদ্ধ হয়, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যের সঙ্গে প্রায় মিলে যায়।
‘অস্বাভাবিকভাবে ভয়াবহ’ ক্ষত
গবেষকরা বলেন, কোনো যুদ্ধক্ষেত্রে ক্ষত সম্পর্কিত পূর্ণাঙ্গ তথ্য পাওয়া কঠিন হলেও গাজার ক্ষতকে তারা ‘অস্বাভাবিকভাবে ভয়াবহ’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
দুই-তৃতীয়াংশ অস্ত্রসৃষ্ট ক্ষত বিস্ফোরণের কারণে হয়েছে, যা অন্য সংঘাত অঞ্চলে দেখা বিস্ফোরণজনিত আঘাতের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি। গবেষণাটি জানায়, এই হার যুক্তরাষ্ট্রের সেনাদের ইরাক ও আফগানিস্তান যুদ্ধে ভোগ করা আঘাতের হারের সমান।
সেনাদের সঙ্গে বেসামরিকদের তুলনা
গবেষণার প্রধান লেখক ব্রিটিশ সার্জন ওমর আল-তাজি বলেন, এ পার্থক্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সৈন্যরা বিপদের মুখোমুখি হতে প্রস্তুত থাকে, প্রশিক্ষণ ও সুরক্ষা পায়। কিন্তু গাজার সাধারণ মানুষ একেবারেই অরক্ষিত অবস্থায় একই মাত্রার সামরিক মানের আঘাত পাচ্ছেন।
তিনি বলেন, ক্ষতের পরিমাণ, ছড়িয়ে পড়া ও তীব্রতা ইঙ্গিত দেয় যে, আধুনিক যুদ্ধের ইতিহাসে এমন চিত্র আগে দেখা যায়নি।
শিশুদের ভয়াবহ দগ্ধ হওয়া
আল-তাজি বলেন, গাজায় তিনি এমন বহু শিশুকে চিকিৎসা দিয়েছেন যাদের তৃতীয় ও চতুর্থ স্তরের দগ্ধ ক্ষত এত গভীর ছিল যে হাড় ও মাংসপেশি পর্যন্ত দৃশ্যমান ছিল। এই দগ্ধ হওয়ার পরিমাণ ও ভয়াবহতা তাকে স্তম্ভিত করেছে।
চিকিৎসাকর্মীদের বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা
জরিপে চিকিৎসাকর্মীদের নিজস্ব অভিজ্ঞতা বর্ণনার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল।
একজন চিকিৎসক বলেন, সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল সেই মুহূর্ত, যখন মায়েরা তাদের মৃত সন্তানকে বাঁচানোর জন্য আকুতি জানাতেন।
অন্যরা উল্লেখ করেছেন, পরিবারের সদস্যদের মৃত্যু প্রত্যক্ষ করার পর কিছু শিশু আত্মহত্যার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল।
চিকিৎসাসামগ্রী ও সহায়তার অভাবে চিকিৎসকরা বাধ্য হয়েছিলেন কাকে বাঁচানোর সুযোগ বেশি সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে চিকিৎসা দিতে।
গাজায় প্রবেশে প্রতিবন্ধকতা
আল-তাজি জানান, তিনি গত বছর মে মাসে গাজা ইউরোপিয়ান হাসপাতালে কাজ শুরু করেন, ঠিক এর কিছুদিন পরেই ইসরায়েল রাফাহ শহরে বড় আকারের হামলা চালায়।
গবেষণায় স্থানীয় ফিলিস্তিনি চিকিৎসকদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, কারণ এতে তাদের নিরাপত্তার ঝুঁকি থাকত।
তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, আন্তর্জাতিক চিকিৎসাকর্মীদের গাজায় প্রবেশ ক্রমেই বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। গত আগস্টে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) প্রতিনিধি রিক পিপারকর্ন সতর্ক করেছিলেন, এই প্রবেশাধিকার অস্বীকারের ফলে বহু মানুষ অপ্রয়োজনীয়ভাবে মৃত্যুবরণ করছে।
গবেষণাটি স্পষ্টভাবে জানায়, গাজায় ইসরায়েলি সামরিক অভিযানে সাধারণ মানুষ যে ক্ষতের শিকার হচ্ছেন তা আধুনিক যুদ্ধক্ষেত্রের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ এবং বেদনাদায়ক দৃশ্যগুলোর একটি। এই পরিস্থিতি শুধু তাৎক্ষণিক চিকিৎসা সংকট