দুই ভিন্ন তরুণ, একই অভিজ্ঞতা
কেসি কিরাকোফের অনলাইন ষড়যন্ত্র আর ঘৃণার জগতে প্রবেশ ঘটে মাত্র ১৪ বছর বয়সে একটি ইউটিউব ভিডিওর মাধ্যমে। ধীরে ধীরে সে বিশ্বাস করতে শুরু করে যে পৃথিবীর শেষ আসন্ন, অ্যান্টিক্রাইস্ট আসছে।
অন্যদিকে, এ.এম. হিকম্যান মাত্র ১৩ বছর বয়সে পড়েন টেড কাজিনস্কির ‘ইউনাবম্বার ম্যানিফেস্টো’। অল্পদিনের মধ্যেই সে জড়িয়ে পড়ে সারভাইভালিস্ট ফোরামে। ২১ বছরে এসে সে রেডিটে হয়ে ওঠে একটি বড় ফোরামের মডারেটর, যেখানে আলোচনার কেন্দ্র ছিল সরকার, পুঁজিবাদ ও সব ধরনের প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে “মুক্তি”র কথা।
দুজনের রাজনৈতিক অবস্থান ভিন্ন হলেও—একজন ডানপন্থার দিকে আর অন্যজন বামপন্থার দিকে ঝুঁকেছিল—তারা দুজনেই খুঁজছিল একটা “অ্যাডভেঞ্চার”, এক ধরনের সম্পৃক্ততা। কিন্তু এর ফলাফল হয়েছিল হতাশা আর নিঃসঙ্গতা।

কেন তরুণরা ঝুঁকছে অনলাইনে
মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, ষড়যন্ত্র তত্ত্ব, নারী বিদ্বেষ কিংবা রাজনৈতিক চরমপন্থা—এসবের ফাঁদে সবচেয়ে বেশি পড়ছে কিশোর আর তরুণ পুরুষরা। কারণ, আধুনিক সময়ে ছেলেদের বেড়ে ওঠার স্বাভাবিক ক্ষেত্রগুলো অনেকটাই সংকুচিত হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে স্কুলগুলোতে কাঠমিস্ত্রির কাজ শেখানো বা আউটডোর খেলা কমে গেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, একই আচরণের জন্য ছেলেরা মেয়েদের চেয়ে বেশি শাস্তি পাচ্ছে। আবার পুরুষ শিক্ষকের সংখ্যাও কমছে। এ শূন্যতা তরুণদের টেনে নিচ্ছে রোমাঞ্চকর চরমপন্থী ধারণার দিকে।
হিকম্যান বলেন, “আজকের ছেলেবেলা এক শূন্যতা। ইন্টারনেটে পাওয়া চরমপন্থী ধারণাগুলোই হয়ে উঠছে বিকল্প অ্যাডভেঞ্চার।”
সহিংসতার দিকেও টান
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেখা গেছে, এ ধরনের অনলাইন চরমপন্থা অনেক তরুণকে টেনে নিচ্ছে সহিংসতার দিকে। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায় রক্ষণশীল কর্মী চার্লি কার্কের হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত ২২ বছরের এক যুবককে, যে দীর্ঘ সময় ধরে বামপন্থী রাজনৈতিক অনলাইন গ্রুপে সক্রিয় ছিল। একই দিনে কলোরাডোতে ১৬ বছরের এক কিশোর স্কুলে সহপাঠীদের গুলি করে হত্যা করে, যে যুক্ত ছিল শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী অনলাইন গ্রুপে।
ফরেনসিক মনোবিজ্ঞানী জোনি জনস্টনের মতে, “এসব অনলাইন গ্রুপ তরুণদের সেই প্রয়োজন মেটাচ্ছে, যা অন্য কোথাও তারা পাচ্ছে না—পরিচয়, বন্ধুত্ব, শক্তি আর নিয়ন্ত্রণের অনুভূতি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এসব সাধারণত ঘৃণাকে ঘিরেই তৈরি।”

হিকম্যানের অরাজকতাবাদী জীবন
গ্রামীণ নিউইয়র্কে দারিদ্র্যের মধ্যে বেড়ে ওঠা হিকম্যানের মা ছিলেন মাদকাসক্ত। এই অভিজ্ঞতা তাকে প্রশ্ন করতে শিখিয়েছিল, “বিশ্বটা এত খারাপ কেন?”
তার অনুসন্ধান তাকে অরাজকতার পথে টেনে নেয়। রেডিটে সে সমমনাদের খুঁজে পায়। সেখানেই আলাপচারিতা দ্রুত রূপ নিত সহিংস পরিকল্পনায়।
আট বছর সে ছিল সমাজের বাইরে—হিচহাইকিং, চুরি, ও স্ল্যাব সিটির মতো অফ-গ্রিড শিবিরে বসবাস। কিন্তু বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। সেখানকার অরাজক জীবন ভরা ছিল মাদক, অপব্যবহার আর মৃত্যুর ঘটনায়।
২০১৯ সালে সে কোস্ট গার্ডে যোগ দেয় এবং ধীরে ধীরে ফিরে আসে ক্যাথলিক বিশ্বাসে। বর্তমানে সে নিউইয়র্কে স্ত্রী-সন্তানসহ লেখালেখি করছে নিজের সাবস্ট্যাক প্ল্যাটফর্মে।
কিরাকোফে: ষড়যন্ত্র থেকে বাস্তবতায়
কিরাকোফে ১৪ বছর বয়সে ইউটিউবে প্রস্তাবিত একটি ভিডিও থেকে ঢুকে পড়ে “ট্রুথার” আন্দোলনে। সেখান থেকে ধীরে ধীরে বিশ্বাস করতে থাকে যে বড় বড় ঘটনা, যেমন ৯/১১ বা কোভিড, সবই গোপন ষড়যন্ত্রের আড়াল।
সে খেলাধুলা ও শিল্পচর্চা করলেও অনলাইনে পাওয়া এসব ধারণা তাকে ভেতর থেকে অস্থির করে তোলে। শেষ পর্যন্ত এ বিশ্বাস তাকে হতাশায় ডুবিয়ে দেয়।

তবে ১৭ বছর বয়সে বান্ধবীর ট্রান্সজেন্ডার ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয়ের পর সে নিজের বিশ্বাস নিয়ে প্রশ্ন তোলে। বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা তাকে শিখিয়েছে অন্যকে মানবিকভাবে দেখার শিক্ষা।
বর্তমানে সে একটি কারখানায় কাজ করে এবং টিকটকে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব থেকে বেরিয়ে আসার অভিজ্ঞতা শেয়ার করছে। আগস্টে তার একটি ভিডিও ৮ লাখ ৫০ হাজারেরও বেশি মানুষ দেখেছে।
কিরাকোফে বলেন, “চার্লি কার্কের হত্যাকাণ্ড মানুষকে বুঝিয়েছে, অনলাইনে সম্পৃক্ততা কতটা বিপজ্জনক হতে পারে। অনেকে ভাবে তারা এসব প্রভাব থেকে মুক্ত, কিন্তু সেটাই আসলে পতনের শুরু।”
এই প্রতিবেদনে দুই তরুণের ভিন্ন অভিজ্ঞতা দেখায়, কীভাবে ইন্টারনেটের চরমপন্থী সংস্কৃতি তরুণদের টেনে নেয় একাকিত্ব, হতাশা ও সহিংসতার দিকে।
তারা খুঁজছিল জীবনের অর্থ আর সম্পৃক্ততা। কিন্তু চরমপন্থার ফাঁদ তাদের শূন্যতা আরও গভীর করেছে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















