বর্ষাকালজুড়ে ঘূর্ণিঝড় ও মৌসুমি বৃষ্টির ধারাবাহিকতায় টানা বৃষ্টি। আকাশ থেকে নামা এই পানিকে অনেকেই কেবল জলাবদ্ধতা ও বন্যা নিয়ন্ত্রণের আলোচনায় দেখেন—যে বিষয়টি দুর্ভাগ্যজনকভাবে নানা অনিয়মের সুযোগ হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব সি.পি. ডেভিডের একটি গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য আমি শুনেছি: এই সময়ে যে বিপুল বৃষ্টি ও তার সৃষ্ট পানির রন-অফ (প্রবাহ) হয়, সেটিকে কেবল বন্যা নিয়ন্ত্রণ নয়, ভবিষ্যৎ প্রয়োজনে ব্যবহারের জন্য ধরে রাখা উচিত। বিষয়টি আরও জানতে আমি সাবেক পরিবেশ সচিব টনি লয়জাগার সঙ্গে কথা বলি।
ধারণাটি হলো “সমন্বিত পানি শাসন”—যেখানে বর্ষায় প্রবল বৃষ্টির যে পানি নেমে আসে, তা সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাজে লাগানোর ব্যবস্থা করা হবে, যাতে তা অপচয় না হয়। এমনকি সঠিকভাবে পানি সংরক্ষণ করতে পারলে সেটি নিজেই বন্যা নিয়ন্ত্রণের কার্যকর উপায় হয়ে উঠতে পারে—ক্ষতিকর স্থানে জমে না থেকে উপকারী স্থানে রাখার মাধ্যমে। বৃষ্টি, বন্যা বা প্রাকৃতিক উৎস থেকে আসা পানিকে জীবনের অপরিহার্য প্রয়োজন মেটাতে—বা ভবিষ্যতের প্রয়োজনের জন্য—ধরে রাখতে হলে পরিকল্পিত শাসন ও সমন্বয় দরকার, যাতে সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা সফল হয়। এ জন্য শুধু পানি নয়, ভূমি ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সম্পদ মিলিয়ে একটি কার্যকর ড্রেনেজ বা জলাধার এলাকা (বেসিন) গড়ে তুলতে হবে, যা বর্তমান ও ভবিষ্যতের সামাজিক-অর্থনৈতিক কল্যাণ সর্বাধিক করবে।
আমাদের প্রতিবেশী কয়েকটি দেশ—যেমন ভারত ও লাওস—ইতিমধ্যে এমন উদ্যোগ নিয়েছে। পানি সঞ্চয়ের এই প্রচেষ্টা সংশ্লিষ্ট পরিবেশব্যবস্থার টেকসইতার সঙ্গে আপস না করেই করা হয়। খরার সময়ে পানীয় জল, কৃষি ও দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজন মেটাতে এই সঞ্চিত পানি অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রাখে। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে কার্যকর পানি সাশ্রয় ও সংরক্ষণ হতে হবে সামষ্টিক উদ্যোগে। তথাকথিত তৃতীয় বিশ্বের বাস্তবতায় কাজটি শুরু করতে হবে সচেতনতা ও তথ্যপ্রচার দিয়ে—কেন এটি জরুরি, কীভাবে সফল হতে পারে, এবং কীভাবে স্থানীয় মানুষকে এতে সম্পৃক্ত করা যায়। দরকার সঠিক তথ্য, উদাহরণ এবং নতুন কিছু চেষ্টা করার মানসিকতা।
এই সব উপাদান একসঙ্গে এলে এমন এক ধাপে পৌঁছানো যায়, যেখানে পরিবেশের যত্ন ও মানুষের কল্যাণ—দুটোই লক্ষ্য রেখে “সমন্বিত পানি শাসন/ব্যবস্থাপনা” বাস্তবে রূপ পায়। এখানে বিশেষ করে নারীদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ—পরিবার ও সম্প্রদায়ের জন্য পানি ব্যবহার ও সাশ্রয়ে তারা কেন্দ্রীয় ভূমিকা রাখতে পারেন। ভবিষ্যতের জন্য পানি সঞ্চয়ে নারীরা সক্রিয় হলে তারা সমন্বিত পানি শাসনের অপরিহার্য অংশীদার হয়ে ওঠেন। স্থানীয় সম্প্রদায়ের সঙ্গে মিলে তারা সচেতনতা বাড়ান, ঘর-সংসারের অভ্যাসে পানি সাশ্রয়ের জীবনধারা অনুসরণ করেন—যা সম্প্রদায়ভিত্তিক পানি সংরক্ষণের মূলভিত্তি।
জলবায়ু পরিবর্তন, জনঘনত্ব বৃদ্ধি এবং এই বাস্তবতায় মানিয়ে নিয়ে ভবিষ্যতের চাহিদা মেটাতে পানি নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তার প্রেক্ষাপটে বুদ্ধিমান পানি ব্যবস্থাপনা এখন বিশেষভাবে জরুরি। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কোনো কোনো এলাকায় বৃষ্টির সময়কাল, ঘনত্ব ও পরিমাণে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা যেতে পারে। ফলে অবকাঠামো পরিকল্পনায় ভবিষ্যৎ জলবায়ু অনুমানকে মান্য করে নকশা করতে হবে। ইতিমধ্যে এমন একটি ‘অ্যাডাপটেশন প্ল্যান’ বিবেচনায় আছে—যা প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কাজ করার পথনির্দেশ দেবে এবং সমাধানে পৌঁছাতে কী ধরনের কঠিন (হার্ড) অবকাঠামো প্রয়োজন, তা নির্দিষ্ট করে দেবে।
পানি জীবনের মূল ভরসা। এটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উপাদানও—অনেকের কাছে এর আধ্যাত্মিক তাৎপর্য রয়েছে (ধারণার উদাহরণ হিসেবে বাপ্তিস্মের পানি)। অথচ পৃথিবীর মোট পানির মাত্র ২.৫ শতাংশ মিঠে পানি; বাকিটা লবণাক্ত। তাই মিঠে পানি বা অ-লবণাক্ত পানির ব্যবহার ও বণ্টন হতে হবে সব পরিবেশে ন্যায়সঙ্গত ও কার্যকর। অবকাঠামো অবশ্যই লাগবে—কিন্তু তা প্রযুক্তিগতভাবে বাস্তবসম্মত, আর্থিকভাবে সাশ্রয়ী ও টেকসই হতে হবে—ক্রমশ কমে আসা পানিসম্পদ ও তার মূল কারণগুলো একসঙ্গে মোকাবিলা করেই কেবল জলসংকট প্রশমিত করা সম্ভব।
সমন্বিত পানি শাসনের আওতায় যে বিষয়গুলো মোকাবিলা করতে হবে তার মধ্যে রয়েছে—মাটিক্ষয়, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও তার প্রযুক্তিগত দিক, আচরণগত পরিবর্তন আনতে শিক্ষা, পানি বরাদ্দের ন্যায়সঙ্গত পদ্ধতি, পানিদূষণ রোধ, অর্থায়ন ব্যবস্থাপনা, তথ্যপ্রচার ও অগ্রিম পরিকল্পনা—সবই পানির যুক্তিসংগত ব্যবহারের লক্ষ্যে।