হঠাৎ বৃষ্টিতে বিপর্যয়ের মুখে উত্তরাঞ্চল
বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে টানা অতিবৃষ্টিতে নতুন করে বন্যার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমারসহ চারটি প্রধান নদীর পানি বিপৎসীমার কাছাকাছি চলে এসেছে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, আগামী ১২ ঘণ্টা হতে পারে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ উজান থেকে নেমে আসা ঢল এবং অব্যাহত বৃষ্টিপাতের কারণে নদীর পানি আরও বাড়তে পারে।
ভারি বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা ঢল
গত তিন দিনের ভারি বর্ষণে লালমনিরহাট, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম ও রংপুর জেলার নদীগুলো ফুলে ফেঁপে উঠেছে।
বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, রবিবার সকাল ৯টা থেকে সোমবার সকাল ৯টার মধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে ভারি থেকে অতিভারি বৃষ্টিপাত হতে পারে।
বিশেষ করে ভারতের সিকিম, দার্জিলিং, কোচবিহার ও জলপাইগুড়িতে রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়েছে, যা বাংলাদেশের নদীগুলোর প্রবাহে সরাসরি প্রভাব ফেলছে।
বৃষ্টিপাতের পরিসংখ্যান
রংপুর বিভাগের বিভিন্ন স্থানে গত ২৪ ঘণ্টায় উল্লেখযোগ্য বৃষ্টি হয়েছে।
- পঞ্চগড়ে ১১৮ মিলিমিটার
- নীলফামারীর ডালিয়ায় ৮৫ মিলিমিটার
- কুড়িগ্রামের পাটেশ্বরীতে ৭৫ মিলিমিটার
অন্যদিকে উজানের ভারতের দার্জিলিংয়ে ২৬১ মিলিমিটার, কোচবিহারে ১৯০ মিলিমিটার এবং জলপাইগুড়িতে ১৭২ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে। এর ফলেই তিস্তা নদীর পানি ডালিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। স্থানীয়দের ভাষায়, “এক রাতেই নদীর চেহারা বদলে গেছে।”
নদীপাড়ের আতঙ্ক
নীলফামারীর টেপাখরচা গ্রামের কৃষক আব্দুল জলিল বলেন,
“গতকাল পর্যন্ত নদী শান্ত ছিল। আজ সকালে দেখি ঘরের বারান্দায় পানি। ফসলের জমি ডুবে গেছে, গরু রাখার জায়গাও নেই।”
ধরলা নদীর শিমুলবাড়ি পয়েন্টে প্রতিঘণ্টায় পানি ৩–৪ সেন্টিমিটার করে বাড়ছে। কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী, রাজারহাট ও ফুলবাড়ী উপজেলার চরাঞ্চলে ইতিমধ্যে নিম্নভূমি প্লাবিত হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলী মো. আতাউর রহমান বলেন,
“ধরলা ও দুধকুমারের পানি বিপৎসীমার কাছাকাছি পৌঁছেছে। বৃষ্টির প্রবণতা অব্যাহত থাকলে আরও অন্তত ২০–৩০ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি হতে পারে।”
জীবিকা থমকে, স্কুল বন্ধ, রাস্তায় জল
রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার কয়েকটি গ্রামে স্কুলঘর আশ্রয়কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। শিক্ষক রহিমা খাতুন জানান,
“গত দুই দিনে ৩০টির বেশি পরিবার স্কুলে আশ্রয় নিয়েছে। বাচ্চারা এখন আর পড়াশোনা করছে না, শুধু নিরাপদে থাকতে চায়।”
অব্যাহত বৃষ্টিতে কাঁচা রাস্তাগুলো কর্দমাক্ত হয়ে পড়েছে, অনেক জায়গায় যানবাহন চলাচল বন্ধ। হাট-বাজারে সবজি ও নিত্যপণ্যের দামও বেড়েছে।
রংপুর শহরের তাজহাট এলাকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, “ড্রেন বন্ধ হয়ে গেছে, বৃষ্টির পানি ঘরে ঢুকছে।”
কৃষিতে বড় ধাক্কা
এই বন্যা যদি আরও কয়েক দিন স্থায়ী হয়, তবে আমন ধান, সবজি ও পাটের ক্ষতি হবে ভয়াবহ।
লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার কৃষক আবু সাঈদ বলেন,
“মাঠে পানি উঠে গেছে। ধানের শীষ এখন পানির নিচে। যদি আর দুই দিন বৃষ্টি থাকে, তবে ফসল নষ্ট হয়ে যাবে।”
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের জেলা কর্মকর্তা জানান, প্রায় ৭ হাজার হেক্টর জমি ঝুঁকিতে আছে। তিনি বলেন,
“আমরা মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে কৃষকদের সতর্ক করছি। প্রয়োজনে দ্রুত ফসল কাটার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।”
প্রশাসনের প্রস্তুতি
বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্র জানিয়েছে, স্থানীয় প্রশাসনকে জরুরি প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে।
লালমনিরহাটের জেলা প্রশাসক বলেন,
“নদীপ্রান্তের ইউনিয়নগুলোতে মাইকিং শুরু হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে, প্রয়োজনে মানুষকে সরিয়ে নেওয়া হবে।”
পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, বাঁধ ও স্লুইসগেটগুলোতে বাড়তি নজরদারি চলছে।
এছাড়া রেড ক্রিসেন্ট ও স্বেচ্ছাসেবক দলগুলো প্রস্তুত রাখা হয়েছে যাতে প্রয়োজনে উদ্ধার তৎপরতা চালানো যায়।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব
পরিবেশবিদরা বলছেন, অক্টোবর মাসে এ ধরনের বন্যা জলবায়ু পরিবর্তনেরই প্রভাব।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জলবায়ু গবেষক ড. মাহবুব হোসেন বলেন,
“অতীতে অক্টোবর মাসে এত ভারি বৃষ্টি দেখা যেত না। এখন বর্ষার সময় দীর্ঘ হচ্ছে, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত নতুনভাবে নদী ও ভূমি ব্যবস্থাকে চাপে ফেলছে।”
তিনি আরও বলেন, “যদি তিস্তা মহাপরিকল্পনা দ্রুত বাস্তবায়ন না হয়, তাহলে প্রতিবছর এই অঞ্চল এমন দুর্যোগের মুখে পড়বে।”
মানুষের প্রতিক্রিয়া
কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার বাসিন্দা তসলিমা বেগম বলেন,
“আমাদের জীবন এখন নদীর মর্জির ওপর নির্ভর করে। সকালে ঘরে পানি না থাকলেও বিকেলে হাঁটু পানিতে হাঁটতে হয়।”
অনেকে গবাদিপশু, চাল-ডাল ও গৃহস্থালি জিনিস নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে বের হয়েছেন। সরকারি ত্রাণ এখনো পৌঁছায়নি, তবে স্থানীয় সংগঠনগুলো কিছু খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানি বিতরণ শুরু করেছে।
সামনে কী অপেক্ষা করছে
বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্রের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগামী ২৪ ঘণ্টায় উত্তরাঞ্চলের অধিকাংশ নদ-নদীর পানি আরও বাড়তে পারে। তবে বৃষ্টিপাত কমলে ধীরে ধীরে পানি নামবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, “এটি কেবল সাময়িক বন্যা নয়। নদী দখল, খনন না হওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব—সব মিলেই উত্তরাঞ্চল এখন বার্ষিক বন্যার চক্রে আটকে পড়ছে।”
উত্তরাঞ্চলের আকাশে এখনো মেঘের ঘনঘটা। নদীর স্রোতের শব্দে মানুষ ঘুম থেকে জেগে উঠছে—বৃষ্টির প্রতিটি শব্দ যেন নতুন অনিশ্চয়তার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
বাংলাদেশের নদীমাতৃক ভূখণ্ডে বন্যা অচেনা নয়, কিন্তু এ বছরের মতো অনিয়মিত ও হঠাৎ বন্যা ভবিষ্যতের বড় বিপদের সংকেত দিচ্ছে।
সচেতনতা, পরিকল্পনা ও মানবিক সহায়তা—এই তিন শক্তিই পারে এই দুর্যোগ মোকাবিলা করতে।
#বন্যা #অতিবৃষ্টি #উত্তরবাংলা #তিস্তা #ধরলা #দুধকুমার #লালমনিরহাট #নীলফামারী #রংপুর #কুড়িগ্রাম #জলবায়ুপরিবর্তন #বন্যাপূর্বাভাস #বাংলাদেশ