ফ্রান্সের ছোট্ট গ্রাম লেরেতে ১০২ বছরের চার্লট শোপাঁ প্রতিদিনই ইয়োগচর্চা চালিয়ে যাচ্ছেন। শতবর্ষ পেরিয়েও তিনি অনায়াসে শরীর বাঁকিয়ে, ভারসাম্য রেখে ‘ওয়ারিয়ার পোজ’-এ দাঁড়িয়ে বিস্মিত করেন তরুণদেরও। শান্ত স্বভাব, নিয়মিত জীবন আর ইয়োগার অনুশীলনই তাঁর দীর্ঘ জীবনের গোপন রহস্য।
চার্লট শোপাঁ: শতবর্ষ পার করা এক ইয়োগগুরু
ফ্রান্সের লেরে নামের ছোট্ট গ্রামে ১০২ বছরের চার্লট শোপাঁ প্রতিদিনই শরীর বাঁকিয়ে, টানটান করে ইয়োগচর্চা চালিয়ে যাচ্ছেন। ঢিলেঢালা পোশাক, সাদা ছোট চুল ও শান্ত স্বভাবের এই নারীকে প্রথম দেখায় দুর্বল মনে হতে পারে; কিন্তু যখন তিনি ‘ওয়ারিয়ার পোজ’-এ দাঁড়ান, তখন তাঁর দৃঢ়তা ও ভারসাম্য যে কাউকে বিস্মিত করে।
১৯৮২ সাল থেকে তিনি লেরে গ্রামের একটি পুরোনো পুলিশ স্টেশন ভবনে ইয়োগা শেখাচ্ছেন। এখন সেটি তাঁর ছোট স্টুডিও—চার দশকেরও বেশি সময় ধরে স্থানীয় নারীদের মিলনস্থল হয়ে উঠেছে এটি।
সাধারণ জীবন, অসাধারণ অধ্যবসায়
শোপাঁর ক্লাসে বয়স ৩৫ থেকে ৬০-এর মধ্যে চারজন স্থানীয় নারী নিয়মিত ইয়োগাচর্চায় অংশ নেন। এক সন্ধ্যায় লেখকও তাঁর সঙ্গে একটি স্ট্রেচিং অনুশীলনে যোগ দেন। প্রথমে শঙ্কা ছিল, ১০২ বছরের বৃদ্ধা কি ভারসাম্য রাখতে পারবেন? কিন্তু শোপাঁ নিখুঁতভাবে প্রতিটি পদক্ষেপে দৃঢ়তা দেখান।
যখন একজন নতুন শিক্ষার্থী ভয় পেয়ে একটি জটিল আসন করতে অস্বীকার করলেন, শোপাঁ নিজেই তা করে দেখালেন, তারপর হাসতে হাসতে বললেন, “ভয় নয়!”
টেলিভিশন থেকে প্রধানমন্ত্রী—সবাই মুগ্ধ
২০২২ সালে ‘লা ফ্রান্স আ আন ইনক্রোয়াবল ট্যালেন্ট’ অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে শোপাঁ জাতীয় খ্যাতি পান। তখন তাঁর বয়স ছিল ৯৯। মঞ্চে তিনি নিখুঁতভাবে একাধিক ইয়োগভঙ্গি দেখান, যা দর্শকদের অভিভূত করে।
পরের বছর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাঁকে “ইয়োগার অসাধারণ দূত” হিসেবে নাগরিক সম্মাননা দেন। এরপর থেকেই গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার ও অনুষ্ঠান—সব জায়গাতেই তিনি আলোচিত মুখ। তাঁর ছেলে ক্লদ শোপাঁ (৬৯), যিনি নিজেও ইয়োগাচর্চায় পারদর্শী, এখন মায়ের অনানুষ্ঠানিক ম্যানেজার হিসেবে কাজ করছেন।
ইয়োগা নয়, শান্তির অনুশীলন
শোপাঁ ইয়োগকে কখনও ধর্ম বা গুরুমন্ত্র হিসেবে প্রচার করেন না। তিনি বলেন, ইয়োগ তাঁকে দিয়েছে “শান্তি”। জীবনের দীর্ঘতা সম্পর্কে তাঁর ব্যাখ্যা খুব সরল—“ভাগ্য ভালো, আর আমি যা করি তা ভালোবাসি।”
৫০ বছর বয়সে এক বান্ধবীর উৎসাহে প্রথম ইয়োগ শেখা শুরু করেন তিনি। ৬০ বছরে এসে শেখাতে শুরু করেন একঘেয়েমি কাটানোর উপায় হিসেবে।
দুর্ঘটনার পরও অবিচল
১০০ বছর বয়সে একদিন ক্লাস শেষে গাড়ি চালিয়ে ফেরার পথে তিনি জ্ঞান হারিয়ে দুর্ঘটনায় পড়েন। বুকের হাড় ভেঙে গেলেও মাত্র তিন মাস পরই তিনি আবার ইয়োগ শেখাতে শুরু করেন—আগের মতোই উদ্যমে।
জীবনের ছন্দে ইয়োগা
শোপাঁ প্রতিদিন সকালে কফি, টোস্ট, মাখন, মধু বা জ্যাম দিয়ে প্রাতরাশ করেন। এটাই তাঁর দিনের প্রিয় সময়। হাসতে হাসতে বলেন, “সকাল ছাড়া আমি ১০২ বছরের মতো বোধ করি না।”
তিনি জানান, তাঁর জীবনে সবচেয়ে বড় প্রেরণা ছাত্রছাত্রীরা। তাঁদের সঙ্গে ইয়োগের বন্ধনই তাঁকে তরতাজা রাখে। গবেষণাতেও দেখা গেছে, দীর্ঘায়ু ব্যক্তিদের জীবনে সামাজিক সম্পর্ক ও মানসিক সংযোগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
শিক্ষার্থীদের চোখে শিক্ষক
শোপাঁর ক্লাসে ইয়োগ দেন কারখানার কর্মী, মুদি দোকানের কর্মচারী, গৃহিণী, অবসরপ্রাপ্ত কর্মী—সবাই। তাঁদের মতে, “ম্যাডাম শোপাঁ নিখুঁত শিক্ষক, কিন্তু সবসময় অনুপ্রেরণাদায়ী।”
একজন শিক্ষার্থী বলেন, “তিনি আমাকে বার্ধক্যকে ভালোবাসতে শিখিয়েছেন।”
বয়স শুধু সংখ্যা
এখন তিনি সপ্তাহে তিন দিন ইয়োগ শেখান। আগের মতো প্রতিদিন অনুশীলন না করলেও আজও সহজেই পা স্পর্শ করতে পারেন। হাতের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়ানো আসন তিনি ছেড়ে দিয়েছেন, তবে ভারসাম্য ও স্থিরতায় তাঁর গতি তরুণদের মতোই।
শোপাঁর নিজের ভাষায়, “আমি সবসময় একইভাবে ক্লাস নিই, কারণ আসন তো একই।”
ইয়োগায় দীর্ঘায়ুর পাঠ
চার্লট শোপাঁর জীবন এক জীবন্ত উদাহরণ—বয়স নয়, মন ও শরীরের ভারসাম্যই জীবনের প্রকৃত শক্তি। তাঁর জীবনের মন্ত্র সহজ: নিয়মিত অনুশীলন, প্রিয় কাজের প্রতি ভালোবাসা, আর মানুষের সঙ্গে বন্ধন—এই তিনেই লুকিয়ে আছে সুখ ও দীর্ঘ জীবনের রহস্য।
#চার্লট_শোপাঁ #ইয়োগাচর্চা #দীর্ঘায়ু #ফ্রান্স #সুস্থ_জীবন #সারাক্ষণ_রিপোর্ট