সম্পর্ক একসময় সহজেই সংজ্ঞায়িত করা যেত। যুক্তরাষ্ট্র ও চীন—প্রতিদ্বন্দ্বী। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও রাশিয়া—অস্বচ্ছ সম্পর্ক। সৌদি আরব ও ইরান—প্রতিপক্ষ। একইভাবে, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত—শীতল যুদ্ধ-পরবর্তী তিন দশকের বেশি সময় ধরে—একটি শব্দেই ধরা যেত: সম্ভাবনা।
কিন্তু নতুন ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত ঢুকেছে এক অস্থির সময়ে। এখন সম্ভাবনার অর্থ হচ্ছে—কোন পক্ষ কতদূর গিয়ে অপর পক্ষকে ক্ষুব্ধ করতে পারে। এই টানাপোড়েনকে আরও ঘনীভূত করছে দুই ঘটনা: ওয়াশিংটনের ইউরোপকে প্ররোচনা—ভারত (এবং চীনের) পণ্যে ১০০ শতাংশ শুল্ক বসাতে; আর ভারতের সেনাদের ২০২৫ সালের বেলারুসে ‘জাপাদ’ মহড়ায় অংশগ্রহণ, যেখানে মস্কো ও মিনস্ক একটি “শত্রু”র ওপর পারমাণবিক হামলার মহড়া চালিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত এখন এক অদ্ভুত নৃত্যে আবদ্ধ—যেখানে মতপার্থক্য সর্বত্র, আর যে আঠা দুই পক্ষকে বেঁধে রেখেছিল, তা ঢিলে হচ্ছে। দুই গণতান্ত্রিক মহাশক্তির ভবিষ্যৎ সম্পর্ক অনিশ্চয়তায় আচ্ছন্ন। তারা কি এখনও একে অপরকে চায়?
এই টানাপোড়েনের একটি বড় কেন্দ্রে আছে অভিবাসন, জ্বালানি ও বাণিজ্য—তিন চলককে নতুনভাবে জুড়ে দেওয়া। এইচ-১বি ভিসার জন্য ১ লাখ ডলার ফি—যার ৭০ শতাংশের বেশি ভারতীয়রা পায়—যুক্তরাষ্ট্র–ভারত সম্পর্ককে টেনে আলাদা করছে, যখন দুপক্ষ একটি বাণিজ্যচুক্তি নিয়ে আলোচনা করছে। এখন যুক্তরাষ্ট্র বলছে, ভারত যদি রুশ জ্বালানি আমদানি কমায়, তবে চুক্তি হবে ও শুল্কও কমতে পারে। এইভাবে অভিবাসন, জ্বালানি ও বাণিজ্য এক অচেনা সূত্রে বাঁধা পড়ছে।
হঠাৎই রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক নির্ধারণ করছে—আমেরিকার সঙ্গে সে কতদূর যেতে পারবে। অন্য অর্থনীতিগুলোরও এতে নজর দেওয়া উচিত। ভূরাজনৈতিক সঙ্গতি এখন বাণিজ্য ও কমার্সের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের পথে।

রাশিয়ার প্রসঙ্গ ছাড়াও, এইচ-১বি সীমিত থাকলে, যুক্তরাষ্ট্র–ভারত চুক্তি অর্থপ্রবাহ বাড়াতে পারে, কিন্তু অভিবাসনপ্রবাহ সংকুচিত করবে—এক নতুন বাস্তবতা।
আরেকটি মাথাব্যথা তৈরি হচ্ছে ব্রিকসকে ঘিরে। নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এনডিবি), আগের নাম ব্রিকস ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, রুপি-মূল্যমান বন্ড ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এটি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দুই বড় উদ্বেগকে একসঙ্গে জুড়ে দেয়: ব্রিকস ও ‘ডিডলারাইজেশন’ (ডলার-নির্ভরতা কমানো)। একই সময়ে, চীন তার ঘরোয়া বন্ডবাজার রাশিয়ার জন্য আবার খুলছে, যা ডলারে ইস্যুকৃত সিকিউরিটিজের ওপর আরও চাপ তৈরি করে।
অর্থাৎ, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যচুক্তির টেবিলে বসে ভারত—অর্থবাজারের টেবিলে ডিডলারাইজেশন এগিয়ে নিচ্ছে।
পরের সংঘাতের জায়গা হতে পারে ব্রিকসে ভারতের ভূমিকা—যেমন রুপির বিশ্বায়ন—যা আমেরিকার পছন্দ না-ও হতে পারে। ব্রিকস নিয়ে ক্ষোভ ‘কোয়াড’-কেও (অস্ট্রেলিয়া, ভারত, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের সমন্বয়) বিপথে নিতে পারে; ট্রাম্প আসন্ন ভারত-সভায় যোগ দেবেন কি না, তা নিয়েও সংশয় আছে। অপ্রত্যাশিতভাবে, যুক্তরাষ্ট্র–ভারতের এই ‘নাচ’ প্রতিদ্বন্দ্বী জোটগুলোকেও নাড়া দিতে পারে।
সবচেয়ে বড় হাতি—রক্ষা ও প্রতিরক্ষা। যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত যেখানে নতুন ১০ বছরের প্রতিরক্ষা কাঠামো খুঁজছে, সেখানে ভারত সরকার আপাতত নতুন আমেরিকান প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম কেনা স্থগিত রেখেছে। একই সময়ে ভারত রাশিয়ার সর্বাধুনিক সু-৫৭ যুদ্ধবিমানের ডজনখানেক ইউনিটের চুক্তি খতিয়ে দেখছে—যার উৎপাদন ভারতের ভেতরেই হতে পারে।
ভারতের প্রায় ৭০ শতাংশ সামরিক সরঞ্জাম রুশ নির্মিত—যা নয়াদিল্লিকে কঠিন অবস্থায় ফেলে। নতুন রুশ সরঞ্জামে সই করলেই যুক্তরাষ্ট্র রেগে যেতে পারে। তবে রূপালি রেখা থাকতে পারে—ভারত কি প্রতিরক্ষায় রাশিয়া থেকে ধীরে ধীরে সরে এসে বাণিজ্যে আমেরিকার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে পারে?
জ্বালানিতে যেমন সুযোগ কম—ভারতের দৈনিক তেলের চাহিদার প্রায় ৪০ শতাংশই রাশিয়া জোগায়—প্রতিরক্ষা ক্রয়ে ভবিষ্যৎ হয়তো অনেক বেশি নমনীয়।
বহু ফ্রন্টে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত মুখোমুখি—বা মুখোমুখির পথে। এই নতুন নাচে আছে বহু হিসাব-নিকাশ।
প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্রকে চীন ও রাশিয়াকে মাথায় রাখতে হবে। অন্তত এক দশক ধরে আমেরিকা এমন নীতির সমালোচনা করেছে—যা বেইজিং ও মস্কোকে একসঙ্গে এনেছে। অথচ, বাস্তবে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানই এখন ভারতকে চীন–রাশিয়া জোটের চারপাশে ঘোরাতে পারে। যদি যুক্তরাষ্ট্র–ভারতের বিরোধ বাড়ে—যেমন আগামী মাসগুলোতে অতিরিক্ত শুল্ক—তবে নয়াদিল্লি বেইজিং ও মস্কোর আরও কাছে যেতে পারে—যা অনেকেই আরেকটি মার্কিন ভুল হিসেবে দেখবেন।
দ্বিতীয়ত, ‘নিরপেক্ষতা’—এতদিন যা যুক্তরাষ্ট্র–চীন সম্পর্কের প্রসঙ্গে শোনা যেত—এখন যুক্তরাষ্ট্র–ভারত সম্পর্কেও প্রযোজ্য। জাপান, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইন্দোনেশিয়াসহ বহু দেশের ওপর চাপ বাড়ছে—তারা ভারতের সঙ্গে কতদূর যাবে। বিশেষ করে, জাপানের ভারতের দিকে দ্বিগুণ বিনিয়োগ কৌশল—এমন পটভূমিতে ঘটতে পারে, যখন আমেরিকা তার মিত্রদের ভারতীয় অর্থনীতি থেকে দূরে টেনে নিতে পারে।
তৃতীয়ত, ভারত ছাড়া পশ্চিমা করপোরেট জগতের জন্য প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা ম্লান। চীনকে ‘অফসেট’ করতে পারে একমাত্র ভারত। যদি চীন ও ভারত দুজনই পশ্চিমের নিশানায় থাকে, পশ্চিমা কোম্পানিগুলো বিনিয়োগ করবে কোথায়? ফলে দৃষ্টি যাবে মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়া ও আফ্রিকায়—যা যুক্তরাষ্ট্র–ভারতের নতুন নাচ থেকে ধারাবাহিক প্রভাবের ঢেউ তুলবে।

চতুর্থত, আদর্শগত প্রশ্নগুলো ফিরে আসছে—কারণ বিশ্বের দুই বৃহত্তম গণতন্ত্র মুখোমুখি। ভারত যদি চীন–রাশিয়া জোটের দিকে ঝোঁকে, যুক্তরাষ্ট্র অদ্ভুত পরিস্থিতিতে পড়বে। তখন আর ‘বিকল্প বিশ্বব্যবস্থা’কে সহজে কর্তৃত্ববাদী বা কমিউনিস্ট বলে আখ্যা দেওয়া যাবে না। গণতন্ত্রের মর্মে দেশ ‘পাল্টে’ দেওয়ার যুক্তরাষ্ট্রের সক্ষমতাও সীমায় ঠেকতে পারে—যদি ভারত সেই সমীকরণ থেকে বেরিয়ে যায়।
এই নতুন নাচ দুই রাজধানীর জন্য আলাদা প্রশ্ন তোলে। নয়াদিল্লিতে—আমেরিকার জন্য লড়াই করা কি সার্থক? ওয়াশিংটনে—ভারতের সঙ্গে লড়াই করা কি সার্থক?
একসময় এসব প্রশ্নের উত্তর স্পষ্ট ছিল। আজ সেগুলো আত্মসমালোচনা ও বিতর্ক দাবি করে। আমদানিকৃত সিনেমায় ১০০ শতাংশ শুল্ক (বলিউডকে প্রান্তে ঠেলে দেওয়া) বা হোয়াইট হাউসের পরিচ্ছন্ন জ্বালানির প্রকল্প থামানো (ভারতের সৌর স্বপ্নের সঙ্গে সংঘাতে)—এসবই যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতকে আরও দূরে ঠেলে দিচ্ছে।
তার ওপর, পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ঘনিষ্ঠতাও পরিস্থিতি আরও কঠিন করে তুলছে।
শুরু হচ্ছে এমন এক যুগ, যেখানে দুই পক্ষই একে অপরকে আরও ‘লেনদেন-কেন্দ্রিক’ চোখে দেখবে—যেখানে স্বল্পমেয়াদি লাভ দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তার চেয়ে বেশি গুরুত্ব পাবে।
যারা এখনও শতাব্দী-নির্ধারক অংশীদারিত্ব খোঁজেন, তাদের জন্য আলো ক্ষীণ হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত আপস করলেও, পুরোনো রোমান্স ফিরে আসবে না—সঙ্গে বিশ্বাস ও নির্ভরযোগ্যতাও না। নতুন বাস্তবতায় দুই দেশ সতর্ক পায়ে পাশাপাশি হাঁটবে—জেনে যে একসময় যেখানে পথ মিলত, এখন সেগুলো স্থায়ীভাবে আলাদা হয়ে যাচ্ছে।
এটি এমন এক সম্পর্ক, যেখানে দুই দেশের ব্যবধান—কখনও নিয়ন্ত্রণযোগ্য ছিল, কখনও উপেক্ষিত—সম্ভবত সমাধানের সীমা ছাড়িয়ে গেছে।
আবিশুর প্রকাশ 



















