ভূমি মন্ত্রণালয়ের ‘গুচ্ছগ্রাম—তৃতীয় পর্যায় (ক্লাইমেট ভিকটিমস রিহ্যাবিলিটেশন)’ শীর্ষক ৭৭৭ কোটি টাকার প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) ফেরত দিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন (পিসি)। পণ্য–সেবায় অযৌক্তিক ব্যয়, অপ্রয়োজনীয় উপাদান সংযোজন এবং লক্ষ্যভোগী নির্ধারণে ঘাটতির কারণে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পিসির প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি (পিইসি) বলছে, প্রস্তাব সংশোধন করে খরচ যুক্তিসঙ্গত করা হলে প্রায় ২০০ কোটি টাকা কম ব্যয়ে ২০ হাজার ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবার পুনর্বাসন সম্ভব।
প্রকল্প নিয়ে পিসির মূল আপত্তি
লক্ষ্যভোগী তালিকা ও স্থান নির্ধারণে অস্পষ্টতা
পিসি বলছে, প্রস্তাবে কোন জেলা বা উপজেলায় কত পরিবার পুনর্বাসিত হবে, তা স্পষ্ট নয়। তারা জেলা ও উপজেলা–ভিত্তিক চাহিদা, খাসজমির প্রাপ্যতা এবং পুনর্বাসনযোগ্য পরিবারের সংখ্যা অনুযায়ী পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রস্তুতের নির্দেশ দিয়েছে।

অপ্রয়োজনীয় উপাদান বাতিলের পরামর্শ
প্রস্তাবিত ৭৭৭ কোটি টাকার মধ্যে প্রশিক্ষণ (২০ কোটি) ও ঋণ বিতরণ (৫০ কোটি) অংশ বাদ দেওয়ার সুপারিশ করেছে পিসি। কারণ, এসব সামাজিক উপাদান ভূমি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বসীমার বাইরে পড়ে। তাই এসব কার্যক্রম সংশ্লিষ্ট দপ্তর যেমন—সমন্বিত কর্মসূচি বা বিএআরডিবি (BRDB)-র মাধ্যমে বাস্তবায়নের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
নির্মাণ ব্যয় ও নকশায় যুক্তি চাওয়া
নদীভাঙনপ্রবণ এলাকা এড়িয়ে গ্রোথ সেন্টার–সংলগ্ন জায়গায় স্থাপনাগুলো করার নির্দেশনা দিয়েছে পিসি। পাশাপাশি প্রতিটি প্লটের দাগ ও খতিয়ান (ক্যাডাস্ট্রাল) তথ্য সংযোজন এবং নকশা উন্নয়নের নির্দেশও দেওয়া হয়েছে।
ইউনিট–খরচে অসঙ্গতি: আশ্রয়ণ প্রকল্পের চেয়ে বেশি
ডিপিপিতে সমতল এলাকায় সেমি–পাকা ঘর নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩,০৪,৫০০ টাকা, চরাঞ্চলে টিন–শেড ঘর ২,৮৪,৫০০ টাকা, আর পার্বত্য অঞ্চলে ‘মাচাং’ ঘর ২,৬৫,০০০ টাকা। পিসি বলছে, এই খরচ প্রধান উপদেষ্টা কার্যালয়ের আশ্রয়ণ প্রকল্পের ইউনিট–খরচের চেয়ে বেশি।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আশ্রয়ণের ঘর নির্মাণ ব্যয় ২.০ থেকে ২.৫৯ লাখ টাকার মধ্যে নির্ধারিত হয়েছে। পার্বত্য এলাকায় মাচাং ঘরের জন্য ২.৫ লাখ টাকার ব্যয় সরকারি মানদণ্ড হিসেবে গৃহীত আছে।

কেন ‘লোকেশন’ এত গুরুত্বপূর্ণ
পূর্ববর্তী পর্যায়ের অভিজ্ঞতা বলছে, অনুপযুক্ত স্থান বাছাইয়ের কারণে বহু আশ্রয়ণ ঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই নতুন প্রকল্পে সাইট–স্ক্রিনিং আরও কঠোর করার পরামর্শ দিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন। নদীভাঙন–ঝুঁকি এড়িয়ে গ্রোথ সেন্টারের সংলগ্ন জায়গা বাছাইয়ের বিষয়টি পিসির অন্যতম শর্ত।
গুচ্ছগ্রাম কর্মসূচির ধারাবাহিকতা
১৯৮৮ সালে শুরু হওয়া গুচ্ছগ্রাম কর্মসূচি এখন পর্যন্ত দুই দফায় বাস্তবায়িত হয়েছে। প্রথম দুই পর্যায়ে খাসজমিতে ভূমিহীন–গৃহহীন পরিবারকে ঘর, ঘাট, নিরাপদ পানি, স্যানিটেশন ও বিদ্যুৎ–সংযোগসহ নানা সুবিধা দেওয়া হয়েছে। জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল (NSSS)-এও গুচ্ছগ্রাম একটি গুরুত্বপূর্ণ থিম্যাটিক ক্লাস্টার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত। প্রস্তাবিত তৃতীয় পর্যায় মূলত সেই ধারাবাহিকতারই সম্প্রসারণ।
প্রস্তাব অনুযায়ী প্রকল্পের সারাংশ
- লক্ষ্য পরিবার: প্রায় ২০,০০০
- মূল কাঠামো: খাসজমিতে ঘর নির্মাণ, টয়লেট, টিউবওয়েল, বিদ্যুৎ সংযোগ
- সামাজিক সহায়তা: প্রশিক্ষণ ও সফট–লোন উপাদান সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সঙ্গে সমন্বয়ের প্রস্তাব
ব্যয় নিয়ন্ত্রণে কী করতে বলেছে পিসি
সাইট–স্ক্রিনিং বাধ্যতামূলক: দাগ–খতিয়ান–নির্ভর জমি নির্বাচন, ভাঙন–ঝুঁকি মূল্যায়ন এবং স্কুল, বাজার, স্বাস্থ্যকেন্দ্রের দূরত্ব বিবেচনায় স্থান নির্বাচন।
লোকেশন–উপযোগী ঘর ডিজাইন: চর, পার্বত্য ও সমতল অঞ্চলের জন্য আলাদা নকশা এবং প্রয়োজনে পোর্টেবল বা মাচাং টাইপ ঘর নির্মাণ।
খরচের যৌক্তিকতা: আশ্রয়ণ প্রকল্পের হালনাগাদ ইউনিট–খরচকে মানদণ্ড হিসেবে ব্যবহার করে প্রশাসনিক ব্যয় ও অপ্রয়োজনীয় খরচ ছাঁটাই।
সামাজিক উপাদানে আন্তঃদপ্তর সমন্বয়: প্রশিক্ষণ ও ঋণ বিতরণ কার্যক্রম সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা সংস্থার সঙ্গে একত্রে বাস্তবায়ন।
ঝুঁকি প্রশমন: নদীবিধৌত এলাকায় পুনর্বাসিত পরিবারগুলোর জন্য উঁচু বেড বা মাচাং ঘর এবং বাধ্যতামূলক ড্রেনেজ ডিজাইন।

বহু সংস্থা, এক লক্ষ্য
বর্তমানে ভূমি মন্ত্রণালয় ছাড়াও প্রধান উপদেষ্টা কার্যালয়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়—সবাই পুনর্বাসন কার্যক্রমে যুক্ত। পিসি মনে করে, এই বহুসংস্থার কার্যক্রমে ডুপ্লিকেশন এড়াতে একীভূত তথ্যভান্ডার (ইউনিফায়েড ডাটাবেস) গড়ে তোলা জরুরি।
পুনর্বাসনে জীবিকা সংযুক্তি কেন জরুরি
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টেকসই পুনর্বাসনের জন্য শুধু ঘর দেওয়া যথেষ্ট নয়। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে স্থানীয় জীবিকার সুযোগ যেমন কুমড়ো (পাম্পকিন)–স্যান্ডবার চাষ, হাঁস–মুরগি বা গবাদি পশুপালন, ক্ষুদ্রঋণ ও বাজার–সংযোগ—এসব উদ্যোগ দরকার। পিসিও মনে করে, এই উপাদানগুলো বাদ না দিয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের মাধ্যমে কার্যকরভাবে সংযুক্ত করাই বুদ্ধিমানের কাজ।
নীতিপরামর্শ সংক্ষেপে
- সংশোধিত ডিপিপি জমা দিয়ে ইউনিট–খরচ যুক্তিসঙ্গত করা
- অম্যান্ডেটেড উপাদান বাদ দিয়ে প্রস্তাব বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্য করা
- ভাঙন–ঝুঁকি ও অ্যাক্সেসিবিলিটি বিবেচনায় লোকেশন–প্রুফিং বাধ্যতামূলক
- প্রকল্প বাস্তবায়নে থার্ড–পার্টি মনিটরিং ও সামাজিক নিরীক্ষা নিশ্চিত করা
৭৭৭ কোটি টাকার এই গুচ্ছগ্রাম–৩ প্রকল্প নিয়ে পরিকল্পনা কমিশনের আপত্তি মূলত ব্যয়ের যুক্তিসঙ্গততা ও বাস্তবায়নযোগ্যতার প্রশ্নে। কমিশন মনে করে, প্রস্তাবিত ব্যয় কাঠামো যৌক্তিক করা গেলে প্রায় ২০০ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে এবং একই সঙ্গে টেকসইভাবে ২০ হাজারের বেশি পরিবার পুনর্বাসন সম্ভব।
#গুচ্ছগ্রাম #আশ্রয়ণ #ভূমি_মন্ত্রণালয় #পরিকল্পনা_কমিশন #নদীভাঙন #পুনর্বাসন #খাসজমি #সামাজিক_নিরাপত্তা
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















