বিশিষ্ট বাংলাদেশি ফটোগ্রাফার ও লেখক শহিদুল আলম দাবি করেছেন, গাজার উদ্দেশ্যে যাত্রাকালে তাকে ইসরায়েলি বাহিনী অপহরণ করেছে। মানবিক সহায়তাবাহী একটি নৌবহরে (ফ্লোটিলা) থাকা অবস্থায় তিনি আটক হন বলে জানিয়েছেন শহিদুল।
ঘটনার সূচনা: সমুদ্রে আটক ও অপহরণের অভিযোগ
বাংলাদেশি ফটোগ্রাফার ও লেখক শহিদুল আলম জানিয়েছেন, গাজার উদ্দেশ্যে যাত্রার সময় তাকে ইসরায়েলি বাহিনী আটক করেছে। তিনি আন্তর্জাতিক মানবিক সহায়তা বহনকারী একটি ফ্লোটিলা (নৌবহর)-এর সদস্য ছিলেন, যা গাজার দিকে রওনা দিয়েছিল।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এক ভিডিও বার্তায় শহিদুল বলেন: “আমি শহিদুল আলম, বাংলাদেশ থেকে আগত একজন ফটোগ্রাফার ও লেখক। যদি আপনারা এই ভিডিওটি দেখে থাকেন, তবে জেনে নিন আমরা সমুদ্রে ইসরায়েলি দখলদার বাহিনীর হাতে আটক হয়েছি। গাজায় গণহত্যা চালাচ্ছে এই রাষ্ট্রটি যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা শক্তিগুলোর সক্রিয় সহযোগিতায় অপরাধ করে চলেছে।”
তিনি তার সহকর্মী ও বন্ধুদের আহ্বান জানান, যেন তারা ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম অব্যাহত রাখেন।
মানবাধিকারকর্মী হিসেবে শহিদুল আলম
শহিদুল আলম দীর্ঘদিন ধরে মানবাধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও ফিলিস্তিনের দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সক্রিয়ভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। মানবাধিকার বিষয়ে তার অবস্থান ও কর্মকাণ্ড বহু আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে আলোচিত হয়েছে। তবে বর্তমানে তিনি কোথায় আছেন বা তার সঙ্গে থাকা অন্যদের অবস্থা কী—তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশনের দাবি
প্রো-ফিলিস্তিনি কর্মীদের আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক ‘ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশন (FFC)’ জানায়, ইসরায়েলি বাহিনী তাদের সহায়তাবাহী নৌবহরে হামলা চালিয়ে কয়েকটি নৌযান দখল করেছে। ফ্লোটিলাটি গাজার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিল।
তাদের তথ্যমতে, ইসরায়েলি বাহিনী প্রথমে “দ্য কনসায়েন্স” নামের একটি জাহাজকে লক্ষ্যবস্তু করে, যেখানে ৯৩ জন সাংবাদিক, চিকিৎসক ও মানবাধিকারকর্মী ছিলেন। পরে আরও তিনটি ছোট নৌকা আটক করা হয়। সংগঠনটি জানায়, ফ্লোটিলার যাত্রীদের ‘অজানা স্থানে’ রাখা হয়েছে।
ইসরায়েলের ব্যাখ্যা
ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক্স (সাবেক টুইটার)-এ জানায়, তারা ফ্লোটিলায় অভিযান চালিয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়, “গাজায় প্রবেশের আরেকটি ব্যর্থ প্রচেষ্টা প্রতিহত করা হয়েছে। আটক জাহাজ ও যাত্রীদের ইসরায়েলি বন্দরে নিয়ে আসা হয়েছে। সবাই নিরাপদ ও সুস্থ আছেন, এবং শিগগিরই তাদের নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হবে।”
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম এ ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়ে মিশনে অংশ নেওয়া মালয়েশীয় কর্মীদের দ্রুত মুক্তি দাবি করেছেন। এছাড়া আয়ারল্যান্ড, ফ্রান্স, ডেনমার্কসহ আরও কয়েকটি দেশের কর্মীরাও ফ্লোটিলায় অংশ নিয়েছিলেন।
গাজার উদ্দেশ্যে মানবিক সহায়তা
ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশন জানিয়েছে, এই নৌবহরে প্রায় ১ লক্ষ ১০ হাজার ডলারের বেশি মূল্যের ওষুধ, শ্বাসযন্ত্র এবং পুষ্টিকর সরঞ্জাম ছিল, যা গাজার হাসপাতালগুলোতে পাঠানোর জন্য নেওয়া হয়েছিল।
তারা আরও জানায়, “ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর আন্তর্জাতিক জলসীমায় কোনো আইনি এখতিয়ার নেই। আমাদের ফ্লোটিলা সম্পূর্ণ মানবিক উদ্দেশ্যে পরিচালিত এবং কোনো ধরনের ক্ষতির কারণ নয়।”
পুনরাবৃত্তি হামলার অভিযোগ
এটি সাম্প্রতিক সপ্তাহে দ্বিতীয়বারের মতো ফ্লোটিলা আটক অভিযান। এর আগে, ‘গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা’র প্রায় ৪০টি নৌযান থামিয়ে ৪৫০ জনের বেশি মানবাধিকারকর্মীকে আটক করেছিল ইসরায়েলি বাহিনী। পরে তাদের অধিকাংশকে—এর মধ্যে সুইডিশ জলবায়ু কর্মী গ্রেটা থানবার্গও ছিলেন—দেশ থেকে বহিষ্কার করা হয়।
আটক কর্মীদের প্রতি নির্যাতনের অভিযোগ
আগের অভিযানে আটক কয়েকজন কর্মী ইসরায়েলি পুলিশের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের অভিযোগ তোলেন। ফরাসি-ফিলিস্তিনি ইউরোপীয় পার্লামেন্ট সদস্য রিমা হাসান জানান, তাকে প্রহৃত করা হয়েছে। অপরদিকে মার্কিন কর্মী ডেভিড অ্যাডলার অভিযোগ করেন, তাকে “বস্ত্রহীন করে, হাত-পা বেঁধে, চোখে কাপড় বেঁধে” ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইটামার বেন-গভিরের সঙ্গে জোরপূর্বক ছবি তুলতে বাধ্য করা হয়।
সহানুভূতি ও ঐক্যের আহ্বান
এই ঘটনায় বিশ্বব্যাপী মানবাধিকারকর্মীদের মধ্যে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে। নোবেলজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস শহিদুল আলম ও গাজার জনগণের প্রতি সংহতি জানিয়েছেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, আন্তর্জাতিক জলসীমায় এমন কর্মকাণ্ড শুধু মানবিক আইন লঙ্ঘন নয়, বরং ফিলিস্তিনে চলমান সংকটের প্রতি বিশ্ব বিবেকের পরীক্ষাও।
#গাজা #ইসরায়েল #শহিদুলআলম #ফ্লোটিলা #মানবাধিকার #সারাক্ষণরিপোর্ট