লিড:
কুড়িগ্রাম জেলার সীমান্তবর্তী ভূরুঙ্গামারী উপজেলায় গরুতে অ্যানথ্রাক্স শনাক্ত হয়েছে। প্রাণিসম্পদ বিভাগের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা বলছেন— এটি আপাতত একটি সীমিত ঘটনা হলেও স্থানীয় পর্যায়ে টিকা কার্যক্রম ও নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনই সতর্ক না হলে রোগ ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি রয়েছে। একই সঙ্গে জনগণকে আতঙ্কিত না হয়ে মাংস ব্যবহারে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার আহ্বান জানানো হয়েছে।
সীমান্ত অঞ্চলে শনাক্ত, আশপাশে নজরদারি বৃদ্ধি
কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী উপজেলার একটি খামারে সম্প্রতি একটি গরুর মৃতদেহ পরীক্ষার পর অ্যানথ্রাক্স ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি পাওয়া যায়।
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. নূরুল ইসলাম বলেন,
“নমুনা পরীক্ষায় গরুর দেহে Bacillus anthracis শনাক্ত হয়েছে। আমরা দ্রুত আক্রান্ত এলাকা চিহ্নিত করে টিকা প্রয়োগ শুরু করেছি। আপাতত আতঙ্কের কিছু নেই, তবে আশপাশের খামারগুলোকে নজরদারিতে আনা হয়েছে।”
ভূরুঙ্গামারী উপজেলার প্রাণিসম্পদ দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত ৮০টিরও বেশি গবাদি পশুকে জরুরি টিকা দেওয়া হয়েছে এবং স্থানীয় হাট-বাজারে গরু জবাইয়ে সতর্কতা জারি করা হয়েছে।
অ্যানথ্রাক্স কীভাবে ছড়ায়?
অ্যানথ্রাক্স একটি ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রামক রোগ, যা মূলত গরু, মহিষ, ছাগল ও ভেড়ার মতো তৃণভোজী প্রাণীতে দেখা যায়। Bacillus anthracis ব্যাকটেরিয়া “স্পোর” আকারে মাটিতে বছরের পর বছর লুকিয়ে থাকতে পারে। আক্রান্ত পশুর মৃতদেহ, রক্ত, চামড়া বা মাংসের সংস্পর্শে এলে মানুষও সংক্রমিত হতে পারে।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই রোগ মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায় না, অর্থাৎ সাধারণ সংস্পর্শে ঝুঁকি খুব কম।
জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)-এর সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. রুবাইয়া ইয়াসমিন বলেন,
“অ্যানথ্রাক্স ভয়ংকর নয়, কিন্তু অবহেলা করলে মারাত্মক হতে পারে। সাধারণত সংক্রমিত পশুর সংস্পর্শ বা অপর্যাপ্তভাবে রান্না করা মাংস খাওয়ার মাধ্যমেই মানুষ আক্রান্ত হয়।”
আগের প্রাদুর্ভাবের অভিজ্ঞতা
বাংলাদেশে সর্বশেষ বড় আকারের অ্যানথ্রাক্স প্রাদুর্ভাব দেখা গিয়েছিল ২০১০ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে। সে সময় সিরাজগঞ্জ, পাবনা, নাটোর ও রংপুর অঞ্চলে একাধিক ঘটনায় শতাধিক মানুষ আক্রান্ত হন। তবে দ্রুত চিকিৎসা ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়ায় মৃত্যুর হার ছিল খুবই কম।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে পশুর ঘনত্ব, খামারের দুর্বল স্বাস্থ্যব্যবস্থা, এবং মৃত পশুর অনিয়ন্ত্রিত নিষ্পত্তির কারণে সংক্রমণের ঝুঁকি থেকে যায়।
গরুর মাংস খাওয়া কতটা নিরাপদ?
অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত পশুর মাংস খাওয়া অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। তবে সঠিকভাবে রান্না করা, পরীক্ষিত উৎস থেকে সংগৃহীত মাংস সাধারণত নিরাপদ বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
রংপুর মেডিকেল কলেজের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. শাহনেওয়াজ আহমেদ বলেন,
“গরুর মাংস ভালোভাবে রান্না করলে জীবাণু ধ্বংস হয়। অন্তত ৭৫ °C তাপমাত্রায় সিদ্ধ করতে হবে। কাঁচা বা আধা সিদ্ধ মাংস খাওয়া এখন একেবারেই অনুচিত।”
মাংস ব্যবহারে এখনই যা করণীয়
১. সন্দেহভাজন পশুর মাংস না খাওয়া:
যেসব এলাকায় অ্যানথ্রাক্স শনাক্ত হয়েছে বা মৃত পশু হঠাৎ মারা গেছে, সেখানে মাংস বিক্রি বা কেনা বন্ধ রাখা উচিত।
২. রান্নার আগে ও পরে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা:
কাঁচা মাংস স্পর্শের পর সাবান ও গরম পানি দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলতে হবে। ছুরি, বোর্ড ও রান্নার টেবিল জীবাণুমুক্ত রাখতে হবে।
৩. মৃত পশু সঠিকভাবে নিষ্পত্তি:
আক্রান্ত পশুর দেহ খোলা জায়গায় ফেলা বা হাটে আনা যাবে না। সেটি পুড়িয়ে ফেলা বা গভীর গর্তে পুঁতে ফেলতে হবে।
৪. টিকা প্রয়োগ:
গবাদি পশুর নিয়মিত টিকা নিশ্চিত করা হলে রোগের ঝুঁকি অনেক কমে যায়।
৫. খামারে পরিচ্ছন্নতা ও নজরদারি:
খামারের আশপাশে জীবাণুনাশক ছিটানো ও মৃত পশুর বর্জ্য সঠিকভাবে নিষ্পত্তি করা জরুরি।
প্রশাসন ও স্বাস্থ্য বিভাগের প্রস্তুতি
কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক মো. আজগর আলী সারাক্ষণকে বলেন,
“আমরা জেলা প্রাণিসম্পদ অফিস ও স্বাস্থ্য বিভাগের সঙ্গে সমন্বয়ে আক্রান্ত এলাকায় নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম শুরু করেছি। হাট-বাজারে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে যেন কোনো অসুস্থ পশু বিক্রি না হয়।”
অন্যদিকে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জনসংযোগ কর্মকর্তা জানান, আক্রান্ত এলাকায় ফিল্ড টিম পাঠানো হয়েছে এবং স্থানীয় হাসপাতালগুলোতে অ্যানথ্রাক্স শনাক্তকরণ কিট সরবরাহ করা হচ্ছে।
চ্যালেঞ্জ: মাঠে সচেতনতার অভাব
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অ্যানথ্রাক্স নিয়ন্ত্রণের সবচেয়ে বড় বাধা হলো অবহেলা ও অজ্ঞতা। অনেক সময় পশুপালক বা কসাইরা সামান্য ক্ষতকে “সাধারণ চামড়া সমস্যা” মনে করে উপেক্ষা করেন, ফলে সংক্রমণ আরও ছড়ায়।
ডা. ইয়াসমিন বলেন,
“যদি কোনো পশুর হঠাৎ মৃত্যু হয়, সেটি অবশ্যই পরীক্ষার জন্য প্রাণিসম্পদ দপ্তরে জানাতে হবে। কারণ এমন দেহ খোলা জায়গায় ফেলে দিলে জীবাণু মাটিতে মিশে বহু বছর টিকে থাকতে পারে।”
ভবিষ্যৎ করণীয়
বিশেষজ্ঞদের মতে, অ্যানথ্রাক্স মোকাবিলায় “One Health” মডেল জরুরি—যেখানে পশু, মানুষ ও পরিবেশ—তিনটি ক্ষেত্রেই সমন্বিত নজরদারি থাকবে।
এর পাশাপাশি:
- ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ
- জনসচেতনতা বাড়াতে গণমাধ্যম ও স্থানীয় সরকারকে সম্পৃক্ত করা
- ভেটেরিনারি সেবা সহজলভ্য করা
- নিয়মিত টিকা কর্মসূচি চালু রাখা
অ্যানথ্রাক্স এখনো নিয়ন্ত্রণযোগ্য রোগ, যদি সময়মতো সনাক্ত ও প্রতিরোধ করা যায়। কুড়িগ্রামের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দেশজুড়ে সতর্কতা বাড়ানো প্রয়োজন, তবে আতঙ্ক নয়— সচেতনতা ও দায়িত্বশীলতা এখন সবচেয়ে কার্যকর প্রতিরোধ।
#অ্যানথ্রাক্স #কুড়িগ্রাম #পশুস্বাস্থ্য #জনস্বাস্থ্য #সারাক্ষণরিপোর্ট #OneHealth