এক শতাব্দী আগে ভারতের বাঘ ছিল বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে। তাদের সংখ্যা ধীরে ধীরে আবার বাড়ছে। তবে এই পরিবেশগত সাফল্য নতুন এক সমস্যা ডেকে এনেছে—এবং জেনেটিক অবক্ষয় থেকে তাদের বাঁচাতে নতুন দৌড় শুরু হয়েছে।
ভারতে বাঘের সংখ্যা আবার বাড়ছে আশার বিস্তারে। কিন্তু এক জেনেটিক অস্বাভাবিকতা বিচ্ছিন্ন বাঘদের পুনর্মিলনের প্রচেষ্টা জাগিয়ে তুলেছে।
২০১৪ সালে, ভারতের সিমলিপাল টাইগার রিজার্ভে বাঘ ছিল মাত্র চারটি। একমাত্র পুরুষ বাঘটি, টি–১২ (এখানে প্রদর্শিত), জন্মেছিল এক বিরল জিনগত মিউটেশন নিয়ে, যা তার গায়ের রঙে কালোর প্রাধান্য দিয়েছে। টি–১২ সিমলিপালের জনসংখ্যা ফিরিয়ে আনতে সহায়তা করায়, তার সেই গাঢ় লোম তার বংশধরদের মধ্যেও দেখা দিতে শুরু করে, যা ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের মধ্যে প্রজনন (ইনব্রিডিং) নিয়ে গুরুতর উদ্বেগ তৈরি করে।
সিমলিপাল সম্ভাব্যভাবে বাঘের জন্য এক স্বর্গে পরিণত হতে পারে—যদি বনব্যবস্থাপকরা আত্মীয়স্বজনের মধ্যে প্রজননের সমস্যা সামাল দিতে পারেন। জেনেটিক গবেষকদের সঙ্গে কাজ করে তারা চন্দ্রপুর জেলায় আশাজাগানিয়া একাধিক স্ত্রী বাঘ চিহ্নিত করেছেন। ‘জমুনা’ প্রথম বাঘিনী যাকে প্রশমিত করে স্থানান্তর করা হয়েছে।
“এর রংটা কালো,” রঘু ফিসফিস করে বলল জোর দিয়ে। সে উত্তেজিত ইশারায় দেখিয়ে আবার বলল, “রংটা কালো!”
টি–১২ বাঘটির গায়ে ছিল এমন গাঢ় লোম, যেন ছেঁড়াখোঁড়া কালো এক চাদর। সারা শরীরে কমলার আভা ফাঁকফোকর দিয়ে উঁকি দিচ্ছিল; মুখমণ্ডল ও সামনের পায়ে তুলনামূলক চওড়া দাগ। বাঘের ডোরার এই অস্বাভাবিক কালো-প্রসারণ, এক বিরল জেনেটিক পরিবর্তন—যা ‘সিউডো-মেলানিজম’ নামে পরিচিত—সিমলিপাল টাইগার রিজার্ভে বিচরণরত প্রায় ত্রিশটি বাঘের মধ্যে প্রায় অর্ধেকের শরীরে দেখা যায়। এটি একদিকে সংরক্ষণের সাফল্যের ইঙ্গিত, অন্যদিকে সম্ভাব্য জটিলতার সতর্কবার্তা। কারণ, সিমলিপালে বাঘের সংখ্যা কয়েক দশক আগের তুলনায় বেশি হলেও, এটি ভৌগোলিকভাবে অন্যান্য বাঘ-জনসংখ্যা থেকে বিচ্ছিন্ন—একটি ‘বাঘের দ্বীপ’—যেখানে জিনভাণ্ডার ক্রমশ সঙ্কুচিত হচ্ছে।
আমরা যখন সপ্তাহের পর সপ্তাহ রঘু আর আমি টি–১২-কে খুঁজতে ওই এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম, ঠিক তখনই অন্যত্র তাকে উপযুক্ত সঙ্গিনী খুঁজে বের করার কাজ চলছিল। বহু বছরের বিকাশমান লক্ষ্যভিত্তিক প্রজনন-পরিকল্পনার এ ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।
এটি এক যৌথ মিশন—সংরক্ষণ সংস্থা, উদ্ভাবনী মলিকিউলার ইকোলজি ও জেনেটিক্স বিশেষজ্ঞদের দল মিলে—সিমলিপালের বাঘদের আত্মীয়স্বজনের মধ্যে প্রজননের বিধ্বংসী ফাঁদ থেকে বাঁচাতে উদ্যোগী।
বহু দিক থেকে ভারতীয় বাঘ সেই একই চ্যালেঞ্জের মুখে, যা বিশ্বজুড়ে অন্যান্য বড় বিড়ালদেরও তাড়িয়ে বেড়ায়—অবিরাম আবাসভূমি ধ্বংস আর বিচ্ছিন্নতার চাপে শিকার হয়ে প্রায় বিলুপ্তির কাঁটায় ঠেকে যাওয়া। সত্তরের দশকে এই প্রতীকী প্রজাতির পতন নিয়ে উদ্বেগ থেকেই গড়ে ওঠে রাজ্য-পরিচালিত অভয়ারণ্যব্যবস্থা। কিন্তু ২০০৫ সাল পর্যন্ত সেই অভয়ারণ্যগুলোতে নিয়মিত নজরদারি আর কঠোর আইনপ্রয়োগ ছিল না—পরে ভারত কেন্দ্রীয় সংস্থা ‘ন্যাশনাল টাইগার কনজারভেশন অথরিটি’ (এনটিসিএ) গঠন করে। এখন এনটিসিএ পাহারাদার নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ দেয়, বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ পরিচালনা করে, এবং ৫৮টি অভয়ারণ্যে আবাসস্থল সংরক্ষণে দিকনির্দেশনা দেয়।
এই ব্যবস্থার মূল ধারণা—সংরক্ষিত বনাঞ্চলের মধ্যে স্বাভাবিক করিডর থাকলে বাঘ এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় যাতায়াত করতে পারে—সংযোগকারী বনপ্যাচ ও শিকারসমৃদ্ধ জমির ফিতেগুলি ধরে। এ থেকে নানা সুবিধা মিললেও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো—চারপাশের জনসংখ্যা একে অপরের সঙ্গে মিশে প্রজনন করতে পারে, ফলে জেনেটিক বৈচিত্র্য বাড়ে। প্রায় ২,৭৫০ বর্গকিলোমিটার জুড়ে থাকা সিমলিপাল ভারতের বৃহত্তম অভয়ারণ্যগুলোর একটি। এর নিকটতম প্রতিবেশী—পশ্চিম-দক্ষিণে সাটকোশিয়া আর পূর্বে সুন্দরবন—দুটিই প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূরে, যা কোনো বাঘের পক্ষে হেঁটে যাওয়া অসম্ভব নয়।
কিন্তু সাটকোশিয়ায় এখন আর কোনো বাঘ নেই। সিমলিপাল ও সুন্দরবনের মধ্যে কার্যকর কোনো করিডরও নেই। মাঝের ভূখণ্ডের বড় অংশই শহর বা কৃষিজমি। বাঘের জন্য সিমলিপালে ঢোকা বা বেরোনোর সহজ পথ নেই। ২০০৬ সালে এনটিসিএ সারা ভারতে বন্য বাঘের যে জরিপ চালায়, তাতে সংখ্যা ধরা পড়ে প্রায় ১,৪০০—এক শতাব্দী আগে আনুমানিক ৪০,০০০ থেকে নেমে। সিমলিপালে সংখ্যা সর্বনিম্নে নেমে এসেছিল চারটিতে; ২০১৪ সালে সেখানে ছিল মাত্র এক পুরুষ বাঘ। তবে ২০১৫ সালে, নিজের মৃত্যুর প্রায় এক বছর আগে, সেই পুরুষ বাঘই টি–১২-র জনক হয়—যার গায়ে ছিল কালো-প্রাধান্য ডোরা। পরবর্তীতে টি–১২ নিজেও কয়েকটি পুত্রসন্তানের জনক হয়েছে।
গত ২০ বছরে এনটিসিএ ও বনবিভাগের সংরক্ষণ প্রচেষ্টায় ভারতীয় বাঘের সংখ্যা পুনরুদ্ধার হয়েছে। ২০২২ সালের আনুমানিক হিসেবে, দেশে ৩,১০০-রও বেশি বাঘ রয়েছে।
গত এক দশকে সিমলিপালের জনসংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকায় শুরুতে এটি জাতীয় সাফল্যের ক্ষুদ্র প্রতিরূপের মতোই লাগছিল। কিন্তু খুব শিগগিরই অভয়ারণ্য ব্যবস্থাপকরা লক্ষ্য করেন—টি–১২–এর মতো গাঢ় লোমওয়ালা তরুণ বাঘের সংখ্যা বাড়ছে। বনকর্মী ও জেনেটিকবিদদের বোঝায়, এই মিউটেশন নিজে ক্ষতিকর নয়; এটি কেবল এক ধরনের বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য—ডিএনএ-র স্বাভাবিক, বিরল ওঠানামা। কিন্তু একইসঙ্গে এটি এক সতর্কবার্তাও—কারণ ছোট ও বিচ্ছিন্ন জনসংখ্যায় এমন বৈশিষ্ট্য দ্রুত ছড়ালে বোঝা যায় যে আত্মীয়স্বজনের মধ্যে প্রজনন বাড়ছে, যা গুরুতর জেনেটিক সমস্যার ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
এক শতকের ভেতর বন উজাড় ও উন্নয়নের চাপে বাঘের আবাসভূমি খণ্ডিত হয়েছে, প্রাকৃতিক করিডর ছিঁড়ে গেছে—যে করিডর ধরে আলাদা আলাদা জনসংখ্যা পরস্পরের সঙ্গে প্রজনন করে টিকে থাকতে পারে। কোথাও কোথাও করিডর টিকে আছে বা পুনর্গঠিত হচ্ছে, আবার অনেক জায়গায় তা এখনও বিচ্ছিন্ন।
বাঘের জনসংখ্যার মধ্যে স্থিতিশীল আদান-প্রদান বাড়াতে ভারত বন্যপ্রাণী ওভারপাস ও টানেল নির্মাণ করছে—যেমন পেঞ্চ ও কানহার অভয়ারণ্যের মাঝখানে। সেখানে দুইটি বাঘ সতর্কভাবে জাতীয় মহাসড়ক ৪৪-এর নিচ দিয়ে পার হচ্ছে।
কেবল তখনই বাঘ স্থানান্তরে অনুমোদন দেওয়া হয়, যখন দাতা-জনসংখ্যা প্রজননক্ষম এক স্ত্রী বাঘ হারিয়েও টিকে থাকতে পারে। চন্দ্রপুরে এটি কোনো ঝুঁকি নয়—সেখানে বাঘের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে, এবং বড় বিড়ালরা নিয়মিত শিকার খুঁজতে অভয়ারণ্য ছেড়ে আশপাশে বেরিয়ে পড়ে। কখনো কখনো সেই শিকার হয় গবাদিপশু।
তবু, যদি এই মিউটেশন সিমলিপালের জনসংখ্যায় এত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে—যার ফলে জিনগত গঠন আত্মীয়স্বজনের মধ্যে অতিমাত্রায় কাছাকাছি হয়ে যায়—তাহলে আরও গুরুতর অস্বাভাবিকতাও দেখা দিতে পারে। ফলে, ভারতের বাঘ কর্তৃপক্ষের কাজ কেবল সংখ্যা বাড়ানো থেকে সরে গিয়ে এখন এই আত্মীয়স্বজনের মধ্যে প্রজননের চক্র ভাঙার দিকে।
বাঘের জেনেটিক্সে ‘জোড়া লাগানো’ কঠিন কাজ। টি–১২ ও তার বংশধরদের জন্য আদর্শ জোড়া খুঁজতে হলে শুধু বর্তমানের বাঘদের মধ্যে পার্থক্য নয়, অতীতের বাঘদের মধ্যেকার পার্থক্যও বুঝতে হবে।
এই কারণেই সম্প্রতি মলিকিউলার ইকোলজিস্ট উমা রামকৃষ্ণন নিজেকে খুঁজে পেলেন মধ্য ভারতের ছোট শহর আকালতারার এক প্রাসাদোপম বাড়ির মৃদু আলোর ‘ট্রফি রুমে’। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক এক্সপ্লোরার ও বেঙ্গালুরুর ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োলজিক্যাল সায়েন্সেসের ল্যাবপ্রধান রামকৃষ্ণনকে সেখানে আমন্ত্রণ জানান অনুপম সিংহ সিসোদিয়া। সিসোদিয়া পরিবার একসময় আশপাশের ৫১টি গ্রাম, বন ও কৃষিজমির দায়িত্বে ছিলেন—মানুষকে বিপজ্জনক বন্যপ্রাণী থেকে রক্ষা করা ছিল তাদের দায়। পরিবারটি শিকারও করেছে—ঘরভরা ভারতীয় নীলগাই, স্লথ বিয়ার, চারশৃঙ্গ হরিণ—সবই ১৯২০ থেকে ১৯৭০-এর মধ্যে সংগৃহীত। রামকৃষ্ণনের সামনে টেবিলে ছিল দুইখানা বাঘের চামড়া—বড় বড় মাথা, যেন গর্জে উঠবে।
২০০৫ সাল থেকে রামকৃষ্ণন ও তার গবেষক-শিক্ষার্থীরা বাঘের ডিএনএ সংগ্রহ করছেন—ভারতীয় বাঘের জেনেটিক বৈচিত্র্যের মানচিত্র বানাতে। সিসোদিয়া পরিবারের মতো বহু ঐতিহাসিক জমিদারি থেকে প্রায় ২৫০টি নমুনা তার কাছে সংরক্ষিত। তিনি লন্ডনের ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের মতো জায়গার ট্যাক্সিডার্মি সংগ্রহ ঘেঁটেছেন, আবার ভারতের জঙ্গলে ঘুরে জীবিত বাঘের মল, রক্ত, লোম, লালার নমুনা সংগ্রহ করেছেন। এসব প্রমাণ তাকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বাঘের বদলে যাওয়ার গুরুত্বপূর্ণ সূত্র দিচ্ছে।
একটি বাঘের মাথার চামড়া ধীরে ধীরে পরীক্ষা করে রামকৃষ্ণন প্রায় ৮০ বছর পুরোনো চামড়ায় স্ক্যালপেল চালালেন। নিপুণভাবে এক টুকরো কেটে শিশিতে ভরে তুলে নিলেন। তিনি বললেন, “এই তো সত্যিকারের গুপ্তধন।” ডিএনএ ডেটাবেস গড়ার উদ্দেশ্য ছিল মাঠে দেখে উত্তর মেলে না—এমন প্রশ্নের জবাব খুঁজে বের করা। সংখ্যায় তীব্র পতনের সঙ্গে সঙ্গে বাঘ শুধু এলাকা হারায়নি, হারিয়েছে প্রয়োজনীয় জেনেটিক বৈচিত্র্যও। ডিএনএর ইতিহাস জানায়—জিনভাণ্ডারে আর কী কী লুকিয়ে থাকতে পারে।
২০১৭ সালে এনটিসিএ সিমলিপালের কালো-প্রবণ ডোরার বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে তার হাতে তুলে দিলে তার গবেষণা আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। বনকর্মীরা স্পষ্ট বুঝতে পারছিলেন—বিচ্ছিন্নতার প্রভাব মাপা যাচ্ছে। তারা চাইছিলেন, রামকৃষ্ণন যেন অস্বাভাবিকতার কারণ যাচাই করে পথ বাতলে দেন।
সিমলিপালের বাঘদের ঘনিষ্ঠভাবে বিশ্লেষণ করে তিনি দেখলেন—রিসেসিভ সিউডো-মেলানিজম জিনটি ওই জনসংখ্যায় ছড়িয়ে পড়েছে। জেনেটিক বিচ্ছিন্নতা অবহেলা করা হলে তা বাঘদের জন্য বিধ্বংসী হতে পারে।
বড় বিড়ালে জিনগত মিউটেশন কী জটিলতা আনে, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। তবে গৃহবিড়ালের (নিকটতম তুলনাযোগ্য) মিউটেশন ডেটাসেট বিশ্লেষণে তিনি ও সহকর্মীরা দেখলেন—রেটিনার ক্ষয় (অ্যাট্রফি), কিডনি রোগ, হাইপারথাইরয়েডিজমের মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে।
চন্দ্রপুরে বাঘের আবাসভূমি কৃষিজমি, ছোট শহর ও বড় শহর ছুঁয়ে গেছে। তবু ওই অঞ্চলের অভয়ারণ্যগুলোর মধ্যে প্রাকৃতিক করিডর আছে—ফলে ক্রমবর্ধমান বাঘেরা তুলনামূলক নিরাপদ পথে এই বিকশিত ভূদৃশ্য পেরোতে পারে।
গড়ে একটি স্ত্রী বাঘ প্রতি দুই থেকে তিন বছরে দুই থেকে তিনটি শাবক দেয়—এ অবস্থায় স্বাস্থ্যগত সমস্যা থাকলে তা খুব দ্রুত ও নাটকীয়ভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
তিনি বললেন, “আমরা এখনও আত্মীয়স্বজনের মধ্যে প্রজননের পূর্ণ প্রভাব বুঝতে চেষ্টা করছি। তবে একটি বিষয় নিশ্চিত—এই ধরনের জেনেটিক ক্ষয়ে কোনো উপকার নেই।” সিমলিপালের অন্য অভয়ারণ্যের সঙ্গে সংযোগের অভাব বিবেচনায় তিনি সুপারিশ করলেন—ভিন্ন অভয়ারণ্য থেকে কয়েকটি বাঘিনী চিহ্নিত করে সেখানে স্থানান্তর করা হোক। সিমলিপালে এলে বাঘিনীরা টি–১২ বা তার প্রাপ্তবয়স্ক পুত্রদের সঙ্গে মিলিত হবে—কারণ তারা বড় হয়ে টি–১২-এর এলাকার অংশ দখল করবে—এবং শাবক দেবে।
এতে দেরিতে হলেও সিমলিপালের জিনভাণ্ডারে বৈচিত্র্য ফিরতে শুরু করবে। সিমলিপালের ডিএনএ ডেটা নিজের বিশাল ডেটাবেসের সঙ্গে মিলিয়ে রামকৃষ্ণন দেখলেন—সবচেয়ে বেশি জেনেটিক বৈচিত্র্য ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মে নেতিবাচক জিন কম বয়ে আনার সম্ভাবনাসহ সেরা প্রার্থী বাঘিনীরা আছে ‘তাডোবা–আন্ধারি’ অভয়ারণ্যে, মধ্য ভারতের চন্দ্রপুর জেলায়।
অবশ্য, সঠিক অভয়ারণ্য শনাক্ত করা এক বিষয়; ১৪০ কিলোগ্রাম ওজনের বন্যপ্রাণীকে প্রায় এক হাজার কিলোমিটার দূরে দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে নিরাপদে স্থানান্তর করা আরেক বড় বিষয়।
এক শরৎসকালে, বন্যপ্রাণী চিকিৎসক রভিকান্ত খোবরাগাড়ে চন্দ্রপুরের ভূদৃশ্যের দিকে তাকালেন। তারপর দৃষ্টি ফেরালেন সামনে থাকা এক তরুণ বাঘিনীর দিকে।
‘জমুনা’ নামের সেই বাঘিনীর বয়স ২৮ মাস; জীবন কাটিয়েছে তাডোবা অভয়ারণ্যের ভেতরে–বাইরে। কম বয়স বলে সে এখনও নিজস্ব এলাকা ঠিক করেনি। তারও চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ—মানুষের সঙ্গে কোনো দ্বন্দ্বের ইতিহাস নেই। এই দুই কারণে সে স্থানান্তরের জন্য সেরা প্রার্থী।
চন্দ্রপুরে বাঘের সংখ্যা বাড়ায় অনেকে অভয়ারণ্য ছেড়ে নতুন জায়গা খুঁজতে যায়; এলাকা দখল নিয়ে লড়াইও হয়। কখনও কখনও বাঘ প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে লড়াইয়ে মারা পড়ে। ময়নাতদন্তের পর মৃতদেহ দাহ করা হয়।
স্থানান্তর—বিশেষ করে এমন সীমানা-সচেতন ও বিশাল প্রাণীর ক্ষেত্রে—সব সময়ই অত্যন্ত সংবেদনশীল কাজ। ভারতের টাইগার রিজার্ভে এ কাজে অগ্রসর হওয়ার আগে বহুস্তর যাচাই ও অনুমোদন লাগে। প্রধান বিবেচনা—দাতা এলাকার জনসংখ্যা কি প্রজননক্ষম এক বাঘিনী হারিয়েও টিকে থাকবে? তাডোবার ক্ষেত্রে এই প্রশ্নে উদ্বেগ নেই।
সিমলিপালের দুই-তৃতীয়াংশ আয়তনের হলেও তাডোবায় প্রায় ৯৫টি বাঘ আছে, আর এটি কোনো ‘বাঘের দ্বীপ’ নয়: প্রাকৃতিক করিডর তাডোবাকে উত্তরে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরের উমরেদ–করহান্ডলা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, উত্তর–পূর্বে ১১০ কিলোমিটার দূরের নবেংগাঁও–নাগঝিরা টাইগার রিজার্ভ, ও দক্ষিণ–পশ্চিমে ১১০ কিলোমিটার দূরের কাওয়াল টাইগার রিজার্ভের সঙ্গে যুক্ত করেছে। তাডোবার বাঘেরা নিয়মিত আরও বনভূমির খোঁজে বেরিয়ে পড়ে। গত এক দশকে সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই চলাচল মানে—বনের টুকরো–টুকরো প্যাচ, গ্রাম ও কৃষিজমির মোজাইকভূমিতে মানুষ–বাঘকে আবার সহাবস্থানের পথ শিখতে হচ্ছে। টি–১২ ও তার আত্মীয়দের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়—এই করিডর–সংযুক্ত নেটওয়ার্ক বাঘদের মধ্যে জিনের অবিরাম আদান–প্রদান নিশ্চিত করেছে।
জমুনা কয়েক সপ্তাহের মধ্যে তাডোবার দুটি স্থানান্তরিত বাঘিনীর প্রথমটি হতে চলেছিল। তবে তাকে প্রথমে বেহুঁশ করতে হবে।
জমুনাকে স্ট্রেচারে তুলতে ও ছায়াযুক্ত জায়গায় আনতে সাতজন মানুষের দরকার পড়ল। খোবরাগাড়ে আঘাত আছে কি না পরীক্ষা করলেন, রক্তের নমুনা নিলেন। গলায় জিপিএস কলার পরিয়ে তাকে ধাতব খাঁচায় তোলা হলো, যা ট্রাকের ওপর বসানো। তারপর জাগিয়ে তোলার ওষুধ দেওয়া হলো। কয়েক মিনিটের মধ্যে ধাতবে নখের আঁচড়, দমকা শব্দ, তারপর গর্জন শোনা গেল।
সিমলিপাল পর্যন্ত সড়কপথে যেতে ২৮ ঘণ্টা লেগেছে। ট্রাকের সঙ্গে ছিল ছোট এক সহায়ক কনভয়। বড় শহর ও শব্দপ্রবণ এলাকা এড়িয়ে রুট পরিকল্পিত ছিল, যাতে জমুনার ওপর শব্দচাপ না পড়ে। কয়েক ঘণ্টা পরপর থেমে বিরতিও দেওয়া হয়েছে। শেষমেশ, দরজা খুলতেই জমুনা লাফিয়ে ঢুকে পড়ল তার নতুন বাড়িতে—সিমলিপালে এক একর আয়তনের অভিযোজন–পেনে—যেখানে প্রায় দুই সপ্তাহ কাটিয়ে সে মানিয়ে নিল। এরপর আরেকবার দরজা খুলল—এবার খাঁচা ছাড়া—সে টি–১২–এর এলাকার দিকে মুক্তি পেল।
বন্য ভারতীয় বাঘের বৈচিত্র্য পুনরুদ্ধারে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ প্রকৃতির হাতে—মিলন। আর বাঘ মিলনের আগে বেছে নেয়।
নভেম্বরেই, জমুনার মুক্তির কম এক মাস পর, তাডোবা থেকে দ্বিতীয় বাঘিনী ‘জীনাত’কে বেহুঁশ করে সিমলিপালের পেনে আনা হলো। জমুনা যেখানে তুলনামূলক সহজে সিমলিপালের ভূদৃশ্যে মানিয়ে নিয়েছে, জীনাত সেখানে চাপ অনুভব করে দ্রুত রিজার্ভের সীমানা ছাড়িয়ে যায়। বনবিভাগের দল আবার তাকে প্রশমিত করে ফিরিয়ে আনে; আরও কয়েক সপ্তাহ পেনে অভ্যস্ত করিয়ে শেষে টি–১২–এর এলাকায় ছেড়ে দেওয়া হয়।
জমুনা ও জীনাত দুজনের গলায়ই জিপিএস কলার—বনকর্মীরা তাদের গতিবিধি ও আচরণ নজরদারি করছিলেন। টি–১২ বা অন্য কোনো পুরুষ বাঘের সঙ্গে তাদের মুখোমুখি হওয়া হচ্ছে কি না দেখছিলেন। মিলনসঙ্গী জুটি কখনও কখনও কয়েক সপ্তাহ একসঙ্গে ঘুরে বেড়ায়, বনের ভেতর হাঁটে, সুর তুলে ডাকে। তবু, বাঘিনীরা সিমলিপালে নিজেদের এলাকা গড়ে তোলার পরও টি–১২–এর সঙ্গে তাদের যোগাযোগের কোনো প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছিল না।
মে–র এক রাতে পর্যন্ত। তাপচিত্র ও দৃশ্যমান উভয় রকম ছবি নেওয়া ক্যামেরার ফিড দেখতে গিয়ে বনবিভাগ দেখল—জীনাত ও টি–১২ পাশাপাশি। অখণ্ড প্রমাণ—তাদের মিলনরীতি শুরু হয়েছে।
উমা রামকৃষ্ণন বললেন, “আমরা এখনও আত্মীয়স্বজনের মধ্যে প্রজননের পূর্ণ প্রভাব বুঝতে চেষ্টা করছি। তবে একটি বিষয় নিশ্চিত—এই ধরনের জেনেটিক ক্ষয় থেকে কোনো মৌলিক লাভ নেই।”
এই মিলনদৃশ্য দেখায়—জেনেটিক উদ্ধার মিশনটি পুরোপুরি সফল না হলেও আশার জায়গা আছে। এদিকে, এ গ্রীষ্মজুড়ে স্থানান্তর–দল জীনাতের প্রথম শাবকের অপেক্ষা করছে, আর রামকৃষ্ণন ও তার শিক্ষার্থীরা সিমলিপালের বাঘদের ফেলে যাওয়া লোম–মল থেকে আরও নমুনা জোগাড় করছেন—জনসংখ্যার ভেতরের বৈচিত্র্য বোঝার জন্য। সবাই আশা করছেন, জমুনাও শেষমেশ সঙ্গী খুঁজে পাবে। আর সবার কৌতূহল—জীনাতের শাবকদের গায়ে কি টি–১২–এর সিউডো–মেলানিজম দেখা যাবে?
আরও বাঘিনী আনা হবে কি না, হলে কবে—এ নিয়ে সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে, সিমলিপালকে অন্য বাঘ–অভয়ারণ্যের সঙ্গে করিডর না–জোড়া পর্যন্ত, আরও স্থানান্তরই হয়তো একমাত্র কার্যকর বিকল্প। সামনে, সিমলিপালের মাঠপরিচালক প্রকাশ চন্দ্র গোগিনেনি আশা করছেন—একদিন সিমলিপাল–ই বৈচিত্র্যময় এক ‘সোর্স–পপুলেশন’ হয়ে উঠবে, যেখান থেকে কাছের সাটকোশিয়ার মতো অভয়ারণ্যে বাঘ ফিরিয়ে নেওয়া যাবে।
সব কিছু সামনে থেকে দেখে—সংখ্যা বাড়তে শুরু করা ভারতীয় বাঘদের যে ফাঁদে পড়তে হয়, তা আমাকে শৈশবের কিছু মুহূর্তে ফিরিয়ে নেয়। আমার বড় হওয়া চন্দ্রপুরের কাছের এক খামারবাড়িতে; জীবন ঘুরেছে বন–প্রাণীদের চারপাশে, সুখ–দুঃখে। পোষা কুকুরকে নাম দেওয়াই ছিল কষ্টের—কারণ চিতাবাঘ প্রায়ই টানত। মাঝেমধ্যে আমরা এমন পায়ের ছাপও পেতাম, যা চিতাবাঘের মতো, কিন্তু অনেক বড়। সত্যিকারের শীর্ষ শিকারির সঙ্গে একই পরিসর ভাগ করে নেওয়ার ভয়–উত্তেজনায় বাতাস ঘন হয়ে থাকত।
এত শক্তিশালী ও ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকা কিছুর সঙ্গে সহাবস্থান আমাকে বন আর সেখানে আমার জায়গা সম্পর্কে ভাবতে শিখিয়েছে। আমাদের খামারে আমি কোনো বাঘ দেখিনি। কিন্তু প্রায়ই স্বপ্নে দেখেছি। বহু বছর পরে অসংখ্য বাঘ দেখেছি, পড়েছি, ছবি তুলেছি। তবু রঘুকে সঙ্গে নিয়ে ধীরে চলা ট্রাকে বসে সেদিন সিমলিপালে যে বাঘটিকে দেখলাম—তার মতো আর কেউ নয়। টি–১২–এর সঙ্গে কয়েক সেকেন্ডের চোখাচোখিতে আমি ক্যামেরা তুলিনি। নড়িনি। আমার সামনে দাঁড়ানো এক কালো বাঘ—মানব–সদিচ্ছার জটিলতার জীবন্ত দলিল। সিমলিপালের জন্য সেরা পরিস্থিতিতে একদিন এই প্রাণীটি হবে বিরল ও অবিস্মরণীয়—যে নতুন এক সংরক্ষণ–শাস্ত্রকে অনুপ্রাণিত করবে। সেই মুহূর্তে, রাস্তার উপর চার সেকেন্ডজুড়ে, সেটি ছিল প্রকৃতির এক নিঃশব্দ অলৌকিকতা। তারপর কোনো গর্জন ছাড়াই টি–১২ দৃঢ় পদক্ষেপে সবুজ অরণ্যের গভীরে মিলিয়ে গেল।
জমুনা চন্দ্রপুরের অভয়ারণ্য থেকে সিমলিপালে আনা দুই বাঘিনীর প্রথমটি। তাকে অভিযোজন–পেনে ছাড়া হয়েছিল। কর্তৃপক্ষ আশা করছে—দুজনেই সিমলিপালের পুরুষ বাঘদের সঙ্গে মিলিত হয়ে জেনেটিকভাবে আরও বৈচিত্র্যময় নতুন প্রজন্ম গড়ে তুলবে।