০১:৩৯ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ০৯ অক্টোবর ২০২৫
চ্যানেল ও ব্ল্যাজির সংগ্রহ: আধুনিক ফ্যাশনের নতুন দিগন্ত প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর কেরালার দুগ্ধ খামারে সফর: ‘আলিয়া ভাট’ নামের গরুর সাথে দেখা ক্রিস্টি টলিভারের কোচিং দক্ষতা ও খেলোয়াড়দের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষমতা বাঘ যে বদলে ফেলছে ডোরা: এক অদ্ভুত কাহিনি আফরান নিশো: অভিনয়ের সীমানা পেরিয়ে এক জীবন পেন্টাগনের হেগসেথের অনুমোদন, মার্কিন নৌবাহিনীর পরবর্তী প্রজন্মের ফাইটার বিমান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ঢাকা (পর্ব-৩১) ১৯ বছরে দৃষ্টিসেবায় ব্র্যাকের অগ্রযাত্রা: সারা দেশে পৌঁছেছে ১ কোটি ৭৭ লাখ মানুষ টানা তিন দিনে শেয়ারবাজারে পতন, কমেছে লেনদেনের পরিমাণ গাজা থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক উদ্ধার: যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইল ও জর্ডানের যৌথ অপারেশন

বাঘ যে বদলে ফেলছে ডোরা: এক অদ্ভুত কাহিনি

এক শতাব্দী আগে ভারতের বাঘ ছিল বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে। তাদের সংখ্যা ধীরে ধীরে আবার বাড়ছে। তবে এই পরিবেশগত সাফল্য নতুন এক সমস্যা ডেকে এনেছেএবং জেনেটিক অবক্ষয় থেকে তাদের বাঁচাতে নতুন দৌড় শুরু হয়েছে।

ভারতে বাঘের সংখ্যা আবার বাড়ছে আশার বিস্তারে। কিন্তু এক জেনেটিক অস্বাভাবিকতা বিচ্ছিন্ন বাঘদের পুনর্মিলনের প্রচেষ্টা জাগিয়ে তুলেছে।

২০১৪ সালেভারতের সিমলিপাল টাইগার রিজার্ভে বাঘ ছিল মাত্র চারটি। একমাত্র পুরুষ বাঘটিটি১২ (এখানে প্রদর্শিত)জন্মেছিল এক বিরল জিনগত মিউটেশন নিয়েযা তার গায়ের রঙে কালোর প্রাধান্য দিয়েছে। টি১২ সিমলিপালের জনসংখ্যা ফিরিয়ে আনতে সহায়তা করায়তার সেই গাঢ় লোম তার বংশধরদের মধ্যেও দেখা দিতে শুরু করেযা ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের মধ্যে প্রজনন (ইনব্রিডিং) নিয়ে গুরুতর উদ্বেগ তৈরি করে।

সিমলিপাল সম্ভাব্যভাবে বাঘের জন্য এক স্বর্গে পরিণত হতে পারেযদি বনব্যবস্থাপকরা আত্মীয়স্বজনের মধ্যে প্রজননের সমস্যা সামাল দিতে পারেন। জেনেটিক গবেষকদের সঙ্গে কাজ করে তারা চন্দ্রপুর জেলায় আশাজাগানিয়া একাধিক স্ত্রী বাঘ চিহ্নিত করেছেন। জমুনা’ প্রথম বাঘিনী যাকে প্রশমিত করে স্থানান্তর করা হয়েছে।

এর রংটা কালো,” রঘু ফিসফিস করে বলল জোর দিয়ে। সে উত্তেজিত ইশারায় দেখিয়ে আবার বলল, “রংটা কালো!

টি১২ বাঘটির গায়ে ছিল এমন গাঢ় লোমযেন ছেঁড়াখোঁড়া কালো এক চাদর। সারা শরীরে কমলার আভা ফাঁকফোকর দিয়ে উঁকি দিচ্ছিলমুখমণ্ডল ও সামনের পায়ে তুলনামূলক চওড়া দাগ। বাঘের ডোরার এই অস্বাভাবিক কালো-প্রসারণএক বিরল জেনেটিক পরিবর্তনযা সিউডো-মেলানিজম’ নামে পরিচিতসিমলিপাল টাইগার রিজার্ভে বিচরণরত প্রায় ত্রিশটি বাঘের মধ্যে প্রায় অর্ধেকের শরীরে দেখা যায়। এটি একদিকে সংরক্ষণের সাফল্যের ইঙ্গিতঅন্যদিকে সম্ভাব্য জটিলতার সতর্কবার্তা। কারণসিমলিপালে বাঘের সংখ্যা কয়েক দশক আগের তুলনায় বেশি হলেওএটি ভৌগোলিকভাবে অন্যান্য বাঘ-জনসংখ্যা থেকে বিচ্ছিন্নএকটি বাঘের দ্বীপ’—যেখানে জিনভাণ্ডার ক্রমশ সঙ্কুচিত হচ্ছে।

আমরা যখন সপ্তাহের পর সপ্তাহ রঘু আর আমি টি১২-কে খুঁজতে ওই এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছিলামঠিক তখনই অন্যত্র তাকে উপযুক্ত সঙ্গিনী খুঁজে বের করার কাজ চলছিল। বহু বছরের বিকাশমান লক্ষ্যভিত্তিক প্রজনন-পরিকল্পনার এ ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।

এটি এক যৌথ মিশনসংরক্ষণ সংস্থাউদ্ভাবনী মলিকিউলার ইকোলজি ও জেনেটিক্স বিশেষজ্ঞদের দল মিলেসিমলিপালের বাঘদের আত্মীয়স্বজনের মধ্যে প্রজননের বিধ্বংসী ফাঁদ থেকে বাঁচাতে উদ্যোগী।

বহু দিক থেকে ভারতীয় বাঘ সেই একই চ্যালেঞ্জের মুখেযা বিশ্বজুড়ে অন্যান্য বড় বিড়ালদেরও তাড়িয়ে বেড়ায়অবিরাম আবাসভূমি ধ্বংস আর বিচ্ছিন্নতার চাপে শিকার হয়ে প্রায় বিলুপ্তির কাঁটায় ঠেকে যাওয়া। সত্তরের দশকে এই প্রতীকী প্রজাতির পতন নিয়ে উদ্বেগ থেকেই গড়ে ওঠে রাজ্য-পরিচালিত অভয়ারণ্যব্যবস্থা। কিন্তু ২০০৫ সাল পর্যন্ত সেই অভয়ারণ্যগুলোতে নিয়মিত নজরদারি আর কঠোর আইনপ্রয়োগ ছিল নাপরে ভারত কেন্দ্রীয় সংস্থা ন্যাশনাল টাইগার কনজারভেশন অথরিটি’ (এনটিসিএ) গঠন করে। এখন এনটিসিএ পাহারাদার নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ দেয়বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ পরিচালনা করেএবং ৫৮টি অভয়ারণ্যে আবাসস্থল সংরক্ষণে দিকনির্দেশনা দেয়।

এই ব্যবস্থার মূল ধারণাসংরক্ষিত বনাঞ্চলের মধ্যে স্বাভাবিক করিডর থাকলে বাঘ এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় যাতায়াত করতে পারেসংযোগকারী বনপ্যাচ ও শিকারসমৃদ্ধ জমির ফিতেগুলি ধরে। এ থেকে নানা সুবিধা মিললেও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলোচারপাশের জনসংখ্যা একে অপরের সঙ্গে মিশে প্রজনন করতে পারেফলে জেনেটিক বৈচিত্র্য বাড়ে। প্রায় ২,৭৫০ বর্গকিলোমিটার জুড়ে থাকা সিমলিপাল ভারতের বৃহত্তম অভয়ারণ্যগুলোর একটি। এর নিকটতম প্রতিবেশীপশ্চিম-দক্ষিণে সাটকোশিয়া আর পূর্বে সুন্দরবনদুটিই প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূরেযা কোনো বাঘের পক্ষে হেঁটে যাওয়া অসম্ভব নয়।

কিন্তু সাটকোশিয়ায় এখন আর কোনো বাঘ নেই। সিমলিপাল ও সুন্দরবনের মধ্যে কার্যকর কোনো করিডরও নেই। মাঝের ভূখণ্ডের বড় অংশই শহর বা কৃষিজমি। বাঘের জন্য সিমলিপালে ঢোকা বা বেরোনোর সহজ পথ নেই। ২০০৬ সালে এনটিসিএ সারা ভারতে বন্য বাঘের যে জরিপ চালায়তাতে সংখ্যা ধরা পড়ে প্রায় ১,৪০০এক শতাব্দী আগে আনুমানিক ৪০,০০০ থেকে নেমে। সিমলিপালে সংখ্যা সর্বনিম্নে নেমে এসেছিল চারটিতে২০১৪ সালে সেখানে ছিল মাত্র এক পুরুষ বাঘ। তবে ২০১৫ সালেনিজের মৃত্যুর প্রায় এক বছর আগেসেই পুরুষ বাঘই টি১২-র জনক হয়যার গায়ে ছিল কালো-প্রাধান্য ডোরা। পরবর্তীতে টি১২ নিজেও কয়েকটি পুত্রসন্তানের জনক হয়েছে।

গত ২০ বছরে এনটিসিএ ও বনবিভাগের সংরক্ষণ প্রচেষ্টায় ভারতীয় বাঘের সংখ্যা পুনরুদ্ধার হয়েছে। ২০২২ সালের আনুমানিক হিসেবেদেশে ৩,১০০-রও বেশি বাঘ রয়েছে।

গত এক দশকে সিমলিপালের জনসংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকায় শুরুতে এটি জাতীয় সাফল্যের ক্ষুদ্র প্রতিরূপের মতোই লাগছিল। কিন্তু খুব শিগগিরই অভয়ারণ্য ব্যবস্থাপকরা লক্ষ্য করেনটি১২এর মতো গাঢ় লোমওয়ালা তরুণ বাঘের সংখ্যা বাড়ছে। বনকর্মী ও জেনেটিকবিদদের বোঝায়এই মিউটেশন নিজে ক্ষতিকর নয়এটি কেবল এক ধরনের বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যডিএনএ-র স্বাভাবিকবিরল ওঠানামা। কিন্তু একইসঙ্গে এটি এক সতর্কবার্তাওকারণ ছোট ও বিচ্ছিন্ন জনসংখ্যায় এমন বৈশিষ্ট্য দ্রুত ছড়ালে বোঝা যায় যে আত্মীয়স্বজনের মধ্যে প্রজনন বাড়ছেযা গুরুতর জেনেটিক সমস্যার ঝুঁকি বাড়াতে পারে।

এক শতকের ভেতর বন উজাড় ও উন্নয়নের চাপে বাঘের আবাসভূমি খণ্ডিত হয়েছেপ্রাকৃতিক করিডর ছিঁড়ে গেছেযে করিডর ধরে আলাদা আলাদা জনসংখ্যা পরস্পরের সঙ্গে প্রজনন করে টিকে থাকতে পারে। কোথাও কোথাও করিডর টিকে আছে বা পুনর্গঠিত হচ্ছেআবার অনেক জায়গায় তা এখনও বিচ্ছিন্ন।

বাঘের জনসংখ্যার মধ্যে স্থিতিশীল আদান-প্রদান বাড়াতে ভারত বন্যপ্রাণী ওভারপাস ও টানেল নির্মাণ করছেযেমন পেঞ্চ ও কানহার অভয়ারণ্যের মাঝখানে। সেখানে দুইটি বাঘ সতর্কভাবে জাতীয় মহাসড়ক ৪৪-এর নিচ দিয়ে পার হচ্ছে।

কেবল তখনই বাঘ স্থানান্তরে অনুমোদন দেওয়া হয়যখন দাতা-জনসংখ্যা প্রজননক্ষম এক স্ত্রী বাঘ হারিয়েও টিকে থাকতে পারে। চন্দ্রপুরে এটি কোনো ঝুঁকি নয়সেখানে বাঘের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছেএবং বড় বিড়ালরা নিয়মিত শিকার খুঁজতে অভয়ারণ্য ছেড়ে আশপাশে বেরিয়ে পড়ে। কখনো কখনো সেই শিকার হয় গবাদিপশু।

তবুযদি এই মিউটেশন সিমলিপালের জনসংখ্যায় এত দ্রুত ছড়িয়ে পড়েযার ফলে জিনগত গঠন আত্মীয়স্বজনের মধ্যে অতিমাত্রায় কাছাকাছি হয়ে যায়তাহলে আরও গুরুতর অস্বাভাবিকতাও দেখা দিতে পারে। ফলেভারতের বাঘ কর্তৃপক্ষের কাজ কেবল সংখ্যা বাড়ানো থেকে সরে গিয়ে এখন এই আত্মীয়স্বজনের মধ্যে প্রজননের চক্র ভাঙার দিকে।

বাঘের জেনেটিক্সে জোড়া লাগানো’ কঠিন কাজ। টি১২ ও তার বংশধরদের জন্য আদর্শ জোড়া খুঁজতে হলে শুধু বর্তমানের বাঘদের মধ্যে পার্থক্য নয়অতীতের বাঘদের মধ্যেকার পার্থক্যও বুঝতে হবে।

এই কারণেই সম্প্রতি মলিকিউলার ইকোলজিস্ট উমা রামকৃষ্ণন নিজেকে খুঁজে পেলেন মধ্য ভারতের ছোট শহর আকালতারার এক প্রাসাদোপম বাড়ির মৃদু আলোর ট্রফি রুমে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক এক্সপ্লোরার ও বেঙ্গালুরুর ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োলজিক্যাল সায়েন্সেসের ল্যাবপ্রধান রামকৃষ্ণনকে সেখানে আমন্ত্রণ জানান অনুপম সিংহ সিসোদিয়া। সিসোদিয়া পরিবার একসময় আশপাশের ৫১টি গ্রামবন ও কৃষিজমির দায়িত্বে ছিলেনমানুষকে বিপজ্জনক বন্যপ্রাণী থেকে রক্ষা করা ছিল তাদের দায়। পরিবারটি শিকারও করেছেঘরভরা ভারতীয় নীলগাইস্লথ বিয়ারচারশৃঙ্গ হরিণসবই ১৯২০ থেকে ১৯৭০-এর মধ্যে সংগৃহীত। রামকৃষ্ণনের সামনে টেবিলে ছিল দুইখানা বাঘের চামড়াবড় বড় মাথাযেন গর্জে উঠবে।

২০০৫ সাল থেকে রামকৃষ্ণন ও তার গবেষক-শিক্ষার্থীরা বাঘের ডিএনএ সংগ্রহ করছেনভারতীয় বাঘের জেনেটিক বৈচিত্র্যের মানচিত্র বানাতে। সিসোদিয়া পরিবারের মতো বহু ঐতিহাসিক জমিদারি থেকে প্রায় ২৫০টি নমুনা তার কাছে সংরক্ষিত। তিনি লন্ডনের ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের মতো জায়গার ট্যাক্সিডার্মি সংগ্রহ ঘেঁটেছেনআবার ভারতের জঙ্গলে ঘুরে জীবিত বাঘের মলরক্তলোমলালার নমুনা সংগ্রহ করেছেন। এসব প্রমাণ তাকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বাঘের বদলে যাওয়ার গুরুত্বপূর্ণ সূত্র দিচ্ছে।

একটি বাঘের মাথার চামড়া ধীরে ধীরে পরীক্ষা করে রামকৃষ্ণন প্রায় ৮০ বছর পুরোনো চামড়ায় স্ক্যালপেল চালালেন। নিপুণভাবে এক টুকরো কেটে শিশিতে ভরে তুলে নিলেন। তিনি বললেন, “এই তো সত্যিকারের গুপ্তধন।” ডিএনএ ডেটাবেস গড়ার উদ্দেশ্য ছিল মাঠে দেখে উত্তর মেলে নাএমন প্রশ্নের জবাব খুঁজে বের করা। সংখ্যায় তীব্র পতনের সঙ্গে সঙ্গে বাঘ শুধু এলাকা হারায়নিহারিয়েছে প্রয়োজনীয় জেনেটিক বৈচিত্র্যও। ডিএনএর ইতিহাস জানায়জিনভাণ্ডারে আর কী কী লুকিয়ে থাকতে পারে।

২০১৭ সালে এনটিসিএ সিমলিপালের কালো-প্রবণ ডোরার বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে তার হাতে তুলে দিলে তার গবেষণা আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। বনকর্মীরা স্পষ্ট বুঝতে পারছিলেনবিচ্ছিন্নতার প্রভাব মাপা যাচ্ছে। তারা চাইছিলেনরামকৃষ্ণন যেন অস্বাভাবিকতার কারণ যাচাই করে পথ বাতলে দেন।

সিমলিপালের বাঘদের ঘনিষ্ঠভাবে বিশ্লেষণ করে তিনি দেখলেনরিসেসিভ সিউডো-মেলানিজম জিনটি ওই জনসংখ্যায় ছড়িয়ে পড়েছে। জেনেটিক বিচ্ছিন্নতা অবহেলা করা হলে তা বাঘদের জন্য বিধ্বংসী হতে পারে।

বড় বিড়ালে জিনগত মিউটেশন কী জটিলতা আনেতা নিশ্চিত করে বলা যায় না। তবে গৃহবিড়ালের (নিকটতম তুলনাযোগ্য) মিউটেশন ডেটাসেট বিশ্লেষণে তিনি ও সহকর্মীরা দেখলেনরেটিনার ক্ষয় (অ্যাট্রফি)কিডনি রোগহাইপারথাইরয়েডিজমের মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে।

চন্দ্রপুরে বাঘের আবাসভূমি কৃষিজমিছোট শহর ও বড় শহর ছুঁয়ে গেছে। তবু ওই অঞ্চলের অভয়ারণ্যগুলোর মধ্যে প্রাকৃতিক করিডর আছেফলে ক্রমবর্ধমান বাঘেরা তুলনামূলক নিরাপদ পথে এই বিকশিত ভূদৃশ্য পেরোতে পারে।

গড়ে একটি স্ত্রী বাঘ প্রতি দুই থেকে তিন বছরে দুই থেকে তিনটি শাবক দেয়এ অবস্থায় স্বাস্থ্যগত সমস্যা থাকলে তা খুব দ্রুত ও নাটকীয়ভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারে।

তিনি বললেন, “আমরা এখনও আত্মীয়স্বজনের মধ্যে প্রজননের পূর্ণ প্রভাব বুঝতে চেষ্টা করছি। তবে একটি বিষয় নিশ্চিতএই ধরনের জেনেটিক ক্ষয়ে কোনো উপকার নেই।” সিমলিপালের অন্য অভয়ারণ্যের সঙ্গে সংযোগের অভাব বিবেচনায় তিনি সুপারিশ করলেনভিন্ন অভয়ারণ্য থেকে কয়েকটি বাঘিনী চিহ্নিত করে সেখানে স্থানান্তর করা হোক। সিমলিপালে এলে বাঘিনীরা টি১২ বা তার প্রাপ্তবয়স্ক পুত্রদের সঙ্গে মিলিত হবেকারণ তারা বড় হয়ে টি১২-এর এলাকার অংশ দখল করবেএবং শাবক দেবে।

এতে দেরিতে হলেও সিমলিপালের জিনভাণ্ডারে বৈচিত্র্য ফিরতে শুরু করবে। সিমলিপালের ডিএনএ ডেটা নিজের বিশাল ডেটাবেসের সঙ্গে মিলিয়ে রামকৃষ্ণন দেখলেনসবচেয়ে বেশি জেনেটিক বৈচিত্র্য ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মে নেতিবাচক জিন কম বয়ে আনার সম্ভাবনাসহ সেরা প্রার্থী বাঘিনীরা আছে তাডোবাআন্ধারি’ অভয়ারণ্যেমধ্য ভারতের চন্দ্রপুর জেলায়।

অবশ্যসঠিক অভয়ারণ্য শনাক্ত করা এক বিষয়১৪০ কিলোগ্রাম ওজনের বন্যপ্রাণীকে প্রায় এক হাজার কিলোমিটার দূরে দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে নিরাপদে স্থানান্তর করা আরেক বড় বিষয়।

এক শরৎসকালেবন্যপ্রাণী চিকিৎসক রভিকান্ত খোবরাগাড়ে চন্দ্রপুরের ভূদৃশ্যের দিকে তাকালেন। তারপর দৃষ্টি ফেরালেন সামনে থাকা এক তরুণ বাঘিনীর দিকে।

জমুনা’ নামের সেই বাঘিনীর বয়স ২৮ মাসজীবন কাটিয়েছে তাডোবা অভয়ারণ্যের ভেতরেবাইরে। কম বয়স বলে সে এখনও নিজস্ব এলাকা ঠিক করেনি। তারও চেয়ে গুরুত্বপূর্ণমানুষের সঙ্গে কোনো দ্বন্দ্বের ইতিহাস নেই। এই দুই কারণে সে স্থানান্তরের জন্য সেরা প্রার্থী।

চন্দ্রপুরে বাঘের সংখ্যা বাড়ায় অনেকে অভয়ারণ্য ছেড়ে নতুন জায়গা খুঁজতে যায়এলাকা দখল নিয়ে লড়াইও হয়। কখনও কখনও বাঘ প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে লড়াইয়ে মারা পড়ে। ময়নাতদন্তের পর মৃতদেহ দাহ করা হয়।

স্থানান্তরবিশেষ করে এমন সীমানা-সচেতন ও বিশাল প্রাণীর ক্ষেত্রেসব সময়ই অত্যন্ত সংবেদনশীল কাজ। ভারতের টাইগার রিজার্ভে এ কাজে অগ্রসর হওয়ার আগে বহুস্তর যাচাই ও অনুমোদন লাগে। প্রধান বিবেচনাদাতা এলাকার জনসংখ্যা কি প্রজননক্ষম এক বাঘিনী হারিয়েও টিকে থাকবেতাডোবার ক্ষেত্রে এই প্রশ্নে উদ্বেগ নেই।

সিমলিপালের দুই-তৃতীয়াংশ আয়তনের হলেও তাডোবায় প্রায় ৯৫টি বাঘ আছেআর এটি কোনো বাঘের দ্বীপ’ নয়: প্রাকৃতিক করিডর তাডোবাকে উত্তরে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরের উমরেদকরহান্ডলা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যউত্তরপূর্বে ১১০ কিলোমিটার দূরের নবেংগাঁওনাগঝিরা টাইগার রিজার্ভও দক্ষিণপশ্চিমে ১১০ কিলোমিটার দূরের কাওয়াল টাইগার রিজার্ভের সঙ্গে যুক্ত করেছে। তাডোবার বাঘেরা নিয়মিত আরও বনভূমির খোঁজে বেরিয়ে পড়ে। গত এক দশকে সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই চলাচল মানেবনের টুকরোটুকরো প্যাচগ্রাম ও কৃষিজমির মোজাইকভূমিতে মানুষবাঘকে আবার সহাবস্থানের পথ শিখতে হচ্ছে। টি১২ ও তার আত্মীয়দের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়এই করিডরসংযুক্ত নেটওয়ার্ক বাঘদের মধ্যে জিনের অবিরাম আদানপ্রদান নিশ্চিত করেছে।

জমুনা কয়েক সপ্তাহের মধ্যে তাডোবার দুটি স্থানান্তরিত বাঘিনীর প্রথমটি হতে চলেছিল। তবে তাকে প্রথমে বেহুঁশ করতে হবে।

জমুনাকে স্ট্রেচারে তুলতে ও ছায়াযুক্ত জায়গায় আনতে সাতজন মানুষের দরকার পড়ল। খোবরাগাড়ে আঘাত আছে কি না পরীক্ষা করলেনরক্তের নমুনা নিলেন। গলায় জিপিএস কলার পরিয়ে তাকে ধাতব খাঁচায় তোলা হলোযা ট্রাকের ওপর বসানো। তারপর জাগিয়ে তোলার ওষুধ দেওয়া হলো। কয়েক মিনিটের মধ্যে ধাতবে নখের আঁচড়দমকা শব্দতারপর গর্জন শোনা গেল।

সিমলিপাল পর্যন্ত সড়কপথে যেতে ২৮ ঘণ্টা লেগেছে। ট্রাকের সঙ্গে ছিল ছোট এক সহায়ক কনভয়। বড় শহর ও শব্দপ্রবণ এলাকা এড়িয়ে রুট পরিকল্পিত ছিলযাতে জমুনার ওপর শব্দচাপ না পড়ে। কয়েক ঘণ্টা পরপর থেমে বিরতিও দেওয়া হয়েছে। শেষমেশদরজা খুলতেই জমুনা লাফিয়ে ঢুকে পড়ল তার নতুন বাড়িতেসিমলিপালে এক একর আয়তনের অভিযোজনপেনেযেখানে প্রায় দুই সপ্তাহ কাটিয়ে সে মানিয়ে নিল। এরপর আরেকবার দরজা খুললএবার খাঁচা ছাড়াসে টি১২এর এলাকার দিকে মুক্তি পেল।

বন্য ভারতীয় বাঘের বৈচিত্র্য পুনরুদ্ধারে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ প্রকৃতির হাতেমিলন। আর বাঘ মিলনের আগে বেছে নেয়।

নভেম্বরেইজমুনার মুক্তির কম এক মাস পরতাডোবা থেকে দ্বিতীয় বাঘিনী জীনাতকে বেহুঁশ করে সিমলিপালের পেনে আনা হলো। জমুনা যেখানে তুলনামূলক সহজে সিমলিপালের ভূদৃশ্যে মানিয়ে নিয়েছেজীনাত সেখানে চাপ অনুভব করে দ্রুত রিজার্ভের সীমানা ছাড়িয়ে যায়। বনবিভাগের দল আবার তাকে প্রশমিত করে ফিরিয়ে আনেআরও কয়েক সপ্তাহ পেনে অভ্যস্ত করিয়ে শেষে টি১২এর এলাকায় ছেড়ে দেওয়া হয়।

জমুনা ও জীনাত দুজনের গলায়ই জিপিএস কলারবনকর্মীরা তাদের গতিবিধি ও আচরণ নজরদারি করছিলেন। টি১২ বা অন্য কোনো পুরুষ বাঘের সঙ্গে তাদের মুখোমুখি হওয়া হচ্ছে কি না দেখছিলেন। মিলনসঙ্গী জুটি কখনও কখনও কয়েক সপ্তাহ একসঙ্গে ঘুরে বেড়ায়বনের ভেতর হাঁটেসুর তুলে ডাকে। তবুবাঘিনীরা সিমলিপালে নিজেদের এলাকা গড়ে তোলার পরও টি১২এর সঙ্গে তাদের যোগাযোগের কোনো প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছিল না।

মের এক রাতে পর্যন্ত। তাপচিত্র ও দৃশ্যমান উভয় রকম ছবি নেওয়া ক্যামেরার ফিড দেখতে গিয়ে বনবিভাগ দেখলজীনাত ও টি১২ পাশাপাশি। অখণ্ড প্রমাণতাদের মিলনরীতি শুরু হয়েছে।

উমা রামকৃষ্ণন বললেন, “আমরা এখনও আত্মীয়স্বজনের মধ্যে প্রজননের পূর্ণ প্রভাব বুঝতে চেষ্টা করছি। তবে একটি বিষয় নিশ্চিতএই ধরনের জেনেটিক ক্ষয় থেকে কোনো মৌলিক লাভ নেই।

এই মিলনদৃশ্য দেখায়জেনেটিক উদ্ধার মিশনটি পুরোপুরি সফল না হলেও আশার জায়গা আছে। এদিকেএ গ্রীষ্মজুড়ে স্থানান্তরদল জীনাতের প্রথম শাবকের অপেক্ষা করছেআর রামকৃষ্ণন ও তার শিক্ষার্থীরা সিমলিপালের বাঘদের ফেলে যাওয়া লোমমল থেকে আরও নমুনা জোগাড় করছেনজনসংখ্যার ভেতরের বৈচিত্র্য বোঝার জন্য। সবাই আশা করছেনজমুনাও শেষমেশ সঙ্গী খুঁজে পাবে। আর সবার কৌতূহলজীনাতের শাবকদের গায়ে কি টি১২এর সিউডোমেলানিজম দেখা যাবে?

আরও বাঘিনী আনা হবে কি নাহলে কবেএ নিয়ে সিদ্ধান্ত হয়নি। তবেসিমলিপালকে অন্য বাঘঅভয়ারণ্যের সঙ্গে করিডর নাজোড়া পর্যন্তআরও স্থানান্তরই হয়তো একমাত্র কার্যকর বিকল্প। সামনেসিমলিপালের মাঠপরিচালক প্রকাশ চন্দ্র গোগিনেনি আশা করছেনএকদিন সিমলিপালই বৈচিত্র্যময় এক সোর্সপপুলেশন’ হয়ে উঠবেযেখান থেকে কাছের সাটকোশিয়ার মতো অভয়ারণ্যে বাঘ ফিরিয়ে নেওয়া যাবে।

সব কিছু সামনে থেকে দেখেসংখ্যা বাড়তে শুরু করা ভারতীয় বাঘদের যে ফাঁদে পড়তে হয়তা আমাকে শৈশবের কিছু মুহূর্তে ফিরিয়ে নেয়। আমার বড় হওয়া চন্দ্রপুরের কাছের এক খামারবাড়িতেজীবন ঘুরেছে বনপ্রাণীদের চারপাশেসুখদুঃখে। পোষা কুকুরকে নাম দেওয়াই ছিল কষ্টেরকারণ চিতাবাঘ প্রায়ই টানত। মাঝেমধ্যে আমরা এমন পায়ের ছাপও পেতামযা চিতাবাঘের মতোকিন্তু অনেক বড়। সত্যিকারের শীর্ষ শিকারির সঙ্গে একই পরিসর ভাগ করে নেওয়ার ভয়উত্তেজনায় বাতাস ঘন হয়ে থাকত।

এত শক্তিশালী ও ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকা কিছুর সঙ্গে সহাবস্থান আমাকে বন আর সেখানে আমার জায়গা সম্পর্কে ভাবতে শিখিয়েছে। আমাদের খামারে আমি কোনো বাঘ দেখিনি। কিন্তু প্রায়ই স্বপ্নে দেখেছি। বহু বছর পরে অসংখ্য বাঘ দেখেছিপড়েছিছবি তুলেছি। তবু রঘুকে সঙ্গে নিয়ে ধীরে চলা ট্রাকে বসে সেদিন সিমলিপালে যে বাঘটিকে দেখলামতার মতো আর কেউ নয়। টি১২এর সঙ্গে কয়েক সেকেন্ডের চোখাচোখিতে আমি ক্যামেরা তুলিনি। নড়িনি। আমার সামনে দাঁড়ানো এক কালো বাঘমানবসদিচ্ছার জটিলতার জীবন্ত দলিল। সিমলিপালের জন্য সেরা পরিস্থিতিতে একদিন এই প্রাণীটি হবে বিরল ও অবিস্মরণীয়যে নতুন এক সংরক্ষণশাস্ত্রকে অনুপ্রাণিত করবে। সেই মুহূর্তেরাস্তার উপর চার সেকেন্ডজুড়েসেটি ছিল প্রকৃতির এক নিঃশব্দ অলৌকিকতা। তারপর কোনো গর্জন ছাড়াই টি১২ দৃঢ় পদক্ষেপে সবুজ অরণ্যের গভীরে মিলিয়ে গেল।

জমুনা চন্দ্রপুরের অভয়ারণ্য থেকে সিমলিপালে আনা দুই বাঘিনীর প্রথমটি। তাকে অভিযোজনপেনে ছাড়া হয়েছিল। কর্তৃপক্ষ আশা করছেদুজনেই সিমলিপালের পুরুষ বাঘদের সঙ্গে মিলিত হয়ে জেনেটিকভাবে আরও বৈচিত্র্যময় নতুন প্রজন্ম গড়ে তুলবে।

জনপ্রিয় সংবাদ

চ্যানেল ও ব্ল্যাজির সংগ্রহ: আধুনিক ফ্যাশনের নতুন দিগন্ত

বাঘ যে বদলে ফেলছে ডোরা: এক অদ্ভুত কাহিনি

১০:০০:৩৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ৮ অক্টোবর ২০২৫

এক শতাব্দী আগে ভারতের বাঘ ছিল বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে। তাদের সংখ্যা ধীরে ধীরে আবার বাড়ছে। তবে এই পরিবেশগত সাফল্য নতুন এক সমস্যা ডেকে এনেছেএবং জেনেটিক অবক্ষয় থেকে তাদের বাঁচাতে নতুন দৌড় শুরু হয়েছে।

ভারতে বাঘের সংখ্যা আবার বাড়ছে আশার বিস্তারে। কিন্তু এক জেনেটিক অস্বাভাবিকতা বিচ্ছিন্ন বাঘদের পুনর্মিলনের প্রচেষ্টা জাগিয়ে তুলেছে।

২০১৪ সালেভারতের সিমলিপাল টাইগার রিজার্ভে বাঘ ছিল মাত্র চারটি। একমাত্র পুরুষ বাঘটিটি১২ (এখানে প্রদর্শিত)জন্মেছিল এক বিরল জিনগত মিউটেশন নিয়েযা তার গায়ের রঙে কালোর প্রাধান্য দিয়েছে। টি১২ সিমলিপালের জনসংখ্যা ফিরিয়ে আনতে সহায়তা করায়তার সেই গাঢ় লোম তার বংশধরদের মধ্যেও দেখা দিতে শুরু করেযা ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের মধ্যে প্রজনন (ইনব্রিডিং) নিয়ে গুরুতর উদ্বেগ তৈরি করে।

সিমলিপাল সম্ভাব্যভাবে বাঘের জন্য এক স্বর্গে পরিণত হতে পারেযদি বনব্যবস্থাপকরা আত্মীয়স্বজনের মধ্যে প্রজননের সমস্যা সামাল দিতে পারেন। জেনেটিক গবেষকদের সঙ্গে কাজ করে তারা চন্দ্রপুর জেলায় আশাজাগানিয়া একাধিক স্ত্রী বাঘ চিহ্নিত করেছেন। জমুনা’ প্রথম বাঘিনী যাকে প্রশমিত করে স্থানান্তর করা হয়েছে।

এর রংটা কালো,” রঘু ফিসফিস করে বলল জোর দিয়ে। সে উত্তেজিত ইশারায় দেখিয়ে আবার বলল, “রংটা কালো!

টি১২ বাঘটির গায়ে ছিল এমন গাঢ় লোমযেন ছেঁড়াখোঁড়া কালো এক চাদর। সারা শরীরে কমলার আভা ফাঁকফোকর দিয়ে উঁকি দিচ্ছিলমুখমণ্ডল ও সামনের পায়ে তুলনামূলক চওড়া দাগ। বাঘের ডোরার এই অস্বাভাবিক কালো-প্রসারণএক বিরল জেনেটিক পরিবর্তনযা সিউডো-মেলানিজম’ নামে পরিচিতসিমলিপাল টাইগার রিজার্ভে বিচরণরত প্রায় ত্রিশটি বাঘের মধ্যে প্রায় অর্ধেকের শরীরে দেখা যায়। এটি একদিকে সংরক্ষণের সাফল্যের ইঙ্গিতঅন্যদিকে সম্ভাব্য জটিলতার সতর্কবার্তা। কারণসিমলিপালে বাঘের সংখ্যা কয়েক দশক আগের তুলনায় বেশি হলেওএটি ভৌগোলিকভাবে অন্যান্য বাঘ-জনসংখ্যা থেকে বিচ্ছিন্নএকটি বাঘের দ্বীপ’—যেখানে জিনভাণ্ডার ক্রমশ সঙ্কুচিত হচ্ছে।

আমরা যখন সপ্তাহের পর সপ্তাহ রঘু আর আমি টি১২-কে খুঁজতে ওই এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছিলামঠিক তখনই অন্যত্র তাকে উপযুক্ত সঙ্গিনী খুঁজে বের করার কাজ চলছিল। বহু বছরের বিকাশমান লক্ষ্যভিত্তিক প্রজনন-পরিকল্পনার এ ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।

এটি এক যৌথ মিশনসংরক্ষণ সংস্থাউদ্ভাবনী মলিকিউলার ইকোলজি ও জেনেটিক্স বিশেষজ্ঞদের দল মিলেসিমলিপালের বাঘদের আত্মীয়স্বজনের মধ্যে প্রজননের বিধ্বংসী ফাঁদ থেকে বাঁচাতে উদ্যোগী।

বহু দিক থেকে ভারতীয় বাঘ সেই একই চ্যালেঞ্জের মুখেযা বিশ্বজুড়ে অন্যান্য বড় বিড়ালদেরও তাড়িয়ে বেড়ায়অবিরাম আবাসভূমি ধ্বংস আর বিচ্ছিন্নতার চাপে শিকার হয়ে প্রায় বিলুপ্তির কাঁটায় ঠেকে যাওয়া। সত্তরের দশকে এই প্রতীকী প্রজাতির পতন নিয়ে উদ্বেগ থেকেই গড়ে ওঠে রাজ্য-পরিচালিত অভয়ারণ্যব্যবস্থা। কিন্তু ২০০৫ সাল পর্যন্ত সেই অভয়ারণ্যগুলোতে নিয়মিত নজরদারি আর কঠোর আইনপ্রয়োগ ছিল নাপরে ভারত কেন্দ্রীয় সংস্থা ন্যাশনাল টাইগার কনজারভেশন অথরিটি’ (এনটিসিএ) গঠন করে। এখন এনটিসিএ পাহারাদার নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ দেয়বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ পরিচালনা করেএবং ৫৮টি অভয়ারণ্যে আবাসস্থল সংরক্ষণে দিকনির্দেশনা দেয়।

এই ব্যবস্থার মূল ধারণাসংরক্ষিত বনাঞ্চলের মধ্যে স্বাভাবিক করিডর থাকলে বাঘ এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় যাতায়াত করতে পারেসংযোগকারী বনপ্যাচ ও শিকারসমৃদ্ধ জমির ফিতেগুলি ধরে। এ থেকে নানা সুবিধা মিললেও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলোচারপাশের জনসংখ্যা একে অপরের সঙ্গে মিশে প্রজনন করতে পারেফলে জেনেটিক বৈচিত্র্য বাড়ে। প্রায় ২,৭৫০ বর্গকিলোমিটার জুড়ে থাকা সিমলিপাল ভারতের বৃহত্তম অভয়ারণ্যগুলোর একটি। এর নিকটতম প্রতিবেশীপশ্চিম-দক্ষিণে সাটকোশিয়া আর পূর্বে সুন্দরবনদুটিই প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূরেযা কোনো বাঘের পক্ষে হেঁটে যাওয়া অসম্ভব নয়।

কিন্তু সাটকোশিয়ায় এখন আর কোনো বাঘ নেই। সিমলিপাল ও সুন্দরবনের মধ্যে কার্যকর কোনো করিডরও নেই। মাঝের ভূখণ্ডের বড় অংশই শহর বা কৃষিজমি। বাঘের জন্য সিমলিপালে ঢোকা বা বেরোনোর সহজ পথ নেই। ২০০৬ সালে এনটিসিএ সারা ভারতে বন্য বাঘের যে জরিপ চালায়তাতে সংখ্যা ধরা পড়ে প্রায় ১,৪০০এক শতাব্দী আগে আনুমানিক ৪০,০০০ থেকে নেমে। সিমলিপালে সংখ্যা সর্বনিম্নে নেমে এসেছিল চারটিতে২০১৪ সালে সেখানে ছিল মাত্র এক পুরুষ বাঘ। তবে ২০১৫ সালেনিজের মৃত্যুর প্রায় এক বছর আগেসেই পুরুষ বাঘই টি১২-র জনক হয়যার গায়ে ছিল কালো-প্রাধান্য ডোরা। পরবর্তীতে টি১২ নিজেও কয়েকটি পুত্রসন্তানের জনক হয়েছে।

গত ২০ বছরে এনটিসিএ ও বনবিভাগের সংরক্ষণ প্রচেষ্টায় ভারতীয় বাঘের সংখ্যা পুনরুদ্ধার হয়েছে। ২০২২ সালের আনুমানিক হিসেবেদেশে ৩,১০০-রও বেশি বাঘ রয়েছে।

গত এক দশকে সিমলিপালের জনসংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকায় শুরুতে এটি জাতীয় সাফল্যের ক্ষুদ্র প্রতিরূপের মতোই লাগছিল। কিন্তু খুব শিগগিরই অভয়ারণ্য ব্যবস্থাপকরা লক্ষ্য করেনটি১২এর মতো গাঢ় লোমওয়ালা তরুণ বাঘের সংখ্যা বাড়ছে। বনকর্মী ও জেনেটিকবিদদের বোঝায়এই মিউটেশন নিজে ক্ষতিকর নয়এটি কেবল এক ধরনের বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যডিএনএ-র স্বাভাবিকবিরল ওঠানামা। কিন্তু একইসঙ্গে এটি এক সতর্কবার্তাওকারণ ছোট ও বিচ্ছিন্ন জনসংখ্যায় এমন বৈশিষ্ট্য দ্রুত ছড়ালে বোঝা যায় যে আত্মীয়স্বজনের মধ্যে প্রজনন বাড়ছেযা গুরুতর জেনেটিক সমস্যার ঝুঁকি বাড়াতে পারে।

এক শতকের ভেতর বন উজাড় ও উন্নয়নের চাপে বাঘের আবাসভূমি খণ্ডিত হয়েছেপ্রাকৃতিক করিডর ছিঁড়ে গেছেযে করিডর ধরে আলাদা আলাদা জনসংখ্যা পরস্পরের সঙ্গে প্রজনন করে টিকে থাকতে পারে। কোথাও কোথাও করিডর টিকে আছে বা পুনর্গঠিত হচ্ছেআবার অনেক জায়গায় তা এখনও বিচ্ছিন্ন।

বাঘের জনসংখ্যার মধ্যে স্থিতিশীল আদান-প্রদান বাড়াতে ভারত বন্যপ্রাণী ওভারপাস ও টানেল নির্মাণ করছেযেমন পেঞ্চ ও কানহার অভয়ারণ্যের মাঝখানে। সেখানে দুইটি বাঘ সতর্কভাবে জাতীয় মহাসড়ক ৪৪-এর নিচ দিয়ে পার হচ্ছে।

কেবল তখনই বাঘ স্থানান্তরে অনুমোদন দেওয়া হয়যখন দাতা-জনসংখ্যা প্রজননক্ষম এক স্ত্রী বাঘ হারিয়েও টিকে থাকতে পারে। চন্দ্রপুরে এটি কোনো ঝুঁকি নয়সেখানে বাঘের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছেএবং বড় বিড়ালরা নিয়মিত শিকার খুঁজতে অভয়ারণ্য ছেড়ে আশপাশে বেরিয়ে পড়ে। কখনো কখনো সেই শিকার হয় গবাদিপশু।

তবুযদি এই মিউটেশন সিমলিপালের জনসংখ্যায় এত দ্রুত ছড়িয়ে পড়েযার ফলে জিনগত গঠন আত্মীয়স্বজনের মধ্যে অতিমাত্রায় কাছাকাছি হয়ে যায়তাহলে আরও গুরুতর অস্বাভাবিকতাও দেখা দিতে পারে। ফলেভারতের বাঘ কর্তৃপক্ষের কাজ কেবল সংখ্যা বাড়ানো থেকে সরে গিয়ে এখন এই আত্মীয়স্বজনের মধ্যে প্রজননের চক্র ভাঙার দিকে।

বাঘের জেনেটিক্সে জোড়া লাগানো’ কঠিন কাজ। টি১২ ও তার বংশধরদের জন্য আদর্শ জোড়া খুঁজতে হলে শুধু বর্তমানের বাঘদের মধ্যে পার্থক্য নয়অতীতের বাঘদের মধ্যেকার পার্থক্যও বুঝতে হবে।

এই কারণেই সম্প্রতি মলিকিউলার ইকোলজিস্ট উমা রামকৃষ্ণন নিজেকে খুঁজে পেলেন মধ্য ভারতের ছোট শহর আকালতারার এক প্রাসাদোপম বাড়ির মৃদু আলোর ট্রফি রুমে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক এক্সপ্লোরার ও বেঙ্গালুরুর ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োলজিক্যাল সায়েন্সেসের ল্যাবপ্রধান রামকৃষ্ণনকে সেখানে আমন্ত্রণ জানান অনুপম সিংহ সিসোদিয়া। সিসোদিয়া পরিবার একসময় আশপাশের ৫১টি গ্রামবন ও কৃষিজমির দায়িত্বে ছিলেনমানুষকে বিপজ্জনক বন্যপ্রাণী থেকে রক্ষা করা ছিল তাদের দায়। পরিবারটি শিকারও করেছেঘরভরা ভারতীয় নীলগাইস্লথ বিয়ারচারশৃঙ্গ হরিণসবই ১৯২০ থেকে ১৯৭০-এর মধ্যে সংগৃহীত। রামকৃষ্ণনের সামনে টেবিলে ছিল দুইখানা বাঘের চামড়াবড় বড় মাথাযেন গর্জে উঠবে।

২০০৫ সাল থেকে রামকৃষ্ণন ও তার গবেষক-শিক্ষার্থীরা বাঘের ডিএনএ সংগ্রহ করছেনভারতীয় বাঘের জেনেটিক বৈচিত্র্যের মানচিত্র বানাতে। সিসোদিয়া পরিবারের মতো বহু ঐতিহাসিক জমিদারি থেকে প্রায় ২৫০টি নমুনা তার কাছে সংরক্ষিত। তিনি লন্ডনের ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের মতো জায়গার ট্যাক্সিডার্মি সংগ্রহ ঘেঁটেছেনআবার ভারতের জঙ্গলে ঘুরে জীবিত বাঘের মলরক্তলোমলালার নমুনা সংগ্রহ করেছেন। এসব প্রমাণ তাকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বাঘের বদলে যাওয়ার গুরুত্বপূর্ণ সূত্র দিচ্ছে।

একটি বাঘের মাথার চামড়া ধীরে ধীরে পরীক্ষা করে রামকৃষ্ণন প্রায় ৮০ বছর পুরোনো চামড়ায় স্ক্যালপেল চালালেন। নিপুণভাবে এক টুকরো কেটে শিশিতে ভরে তুলে নিলেন। তিনি বললেন, “এই তো সত্যিকারের গুপ্তধন।” ডিএনএ ডেটাবেস গড়ার উদ্দেশ্য ছিল মাঠে দেখে উত্তর মেলে নাএমন প্রশ্নের জবাব খুঁজে বের করা। সংখ্যায় তীব্র পতনের সঙ্গে সঙ্গে বাঘ শুধু এলাকা হারায়নিহারিয়েছে প্রয়োজনীয় জেনেটিক বৈচিত্র্যও। ডিএনএর ইতিহাস জানায়জিনভাণ্ডারে আর কী কী লুকিয়ে থাকতে পারে।

২০১৭ সালে এনটিসিএ সিমলিপালের কালো-প্রবণ ডোরার বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে তার হাতে তুলে দিলে তার গবেষণা আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। বনকর্মীরা স্পষ্ট বুঝতে পারছিলেনবিচ্ছিন্নতার প্রভাব মাপা যাচ্ছে। তারা চাইছিলেনরামকৃষ্ণন যেন অস্বাভাবিকতার কারণ যাচাই করে পথ বাতলে দেন।

সিমলিপালের বাঘদের ঘনিষ্ঠভাবে বিশ্লেষণ করে তিনি দেখলেনরিসেসিভ সিউডো-মেলানিজম জিনটি ওই জনসংখ্যায় ছড়িয়ে পড়েছে। জেনেটিক বিচ্ছিন্নতা অবহেলা করা হলে তা বাঘদের জন্য বিধ্বংসী হতে পারে।

বড় বিড়ালে জিনগত মিউটেশন কী জটিলতা আনেতা নিশ্চিত করে বলা যায় না। তবে গৃহবিড়ালের (নিকটতম তুলনাযোগ্য) মিউটেশন ডেটাসেট বিশ্লেষণে তিনি ও সহকর্মীরা দেখলেনরেটিনার ক্ষয় (অ্যাট্রফি)কিডনি রোগহাইপারথাইরয়েডিজমের মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে।

চন্দ্রপুরে বাঘের আবাসভূমি কৃষিজমিছোট শহর ও বড় শহর ছুঁয়ে গেছে। তবু ওই অঞ্চলের অভয়ারণ্যগুলোর মধ্যে প্রাকৃতিক করিডর আছেফলে ক্রমবর্ধমান বাঘেরা তুলনামূলক নিরাপদ পথে এই বিকশিত ভূদৃশ্য পেরোতে পারে।

গড়ে একটি স্ত্রী বাঘ প্রতি দুই থেকে তিন বছরে দুই থেকে তিনটি শাবক দেয়এ অবস্থায় স্বাস্থ্যগত সমস্যা থাকলে তা খুব দ্রুত ও নাটকীয়ভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারে।

তিনি বললেন, “আমরা এখনও আত্মীয়স্বজনের মধ্যে প্রজননের পূর্ণ প্রভাব বুঝতে চেষ্টা করছি। তবে একটি বিষয় নিশ্চিতএই ধরনের জেনেটিক ক্ষয়ে কোনো উপকার নেই।” সিমলিপালের অন্য অভয়ারণ্যের সঙ্গে সংযোগের অভাব বিবেচনায় তিনি সুপারিশ করলেনভিন্ন অভয়ারণ্য থেকে কয়েকটি বাঘিনী চিহ্নিত করে সেখানে স্থানান্তর করা হোক। সিমলিপালে এলে বাঘিনীরা টি১২ বা তার প্রাপ্তবয়স্ক পুত্রদের সঙ্গে মিলিত হবেকারণ তারা বড় হয়ে টি১২-এর এলাকার অংশ দখল করবেএবং শাবক দেবে।

এতে দেরিতে হলেও সিমলিপালের জিনভাণ্ডারে বৈচিত্র্য ফিরতে শুরু করবে। সিমলিপালের ডিএনএ ডেটা নিজের বিশাল ডেটাবেসের সঙ্গে মিলিয়ে রামকৃষ্ণন দেখলেনসবচেয়ে বেশি জেনেটিক বৈচিত্র্য ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মে নেতিবাচক জিন কম বয়ে আনার সম্ভাবনাসহ সেরা প্রার্থী বাঘিনীরা আছে তাডোবাআন্ধারি’ অভয়ারণ্যেমধ্য ভারতের চন্দ্রপুর জেলায়।

অবশ্যসঠিক অভয়ারণ্য শনাক্ত করা এক বিষয়১৪০ কিলোগ্রাম ওজনের বন্যপ্রাণীকে প্রায় এক হাজার কিলোমিটার দূরে দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে নিরাপদে স্থানান্তর করা আরেক বড় বিষয়।

এক শরৎসকালেবন্যপ্রাণী চিকিৎসক রভিকান্ত খোবরাগাড়ে চন্দ্রপুরের ভূদৃশ্যের দিকে তাকালেন। তারপর দৃষ্টি ফেরালেন সামনে থাকা এক তরুণ বাঘিনীর দিকে।

জমুনা’ নামের সেই বাঘিনীর বয়স ২৮ মাসজীবন কাটিয়েছে তাডোবা অভয়ারণ্যের ভেতরেবাইরে। কম বয়স বলে সে এখনও নিজস্ব এলাকা ঠিক করেনি। তারও চেয়ে গুরুত্বপূর্ণমানুষের সঙ্গে কোনো দ্বন্দ্বের ইতিহাস নেই। এই দুই কারণে সে স্থানান্তরের জন্য সেরা প্রার্থী।

চন্দ্রপুরে বাঘের সংখ্যা বাড়ায় অনেকে অভয়ারণ্য ছেড়ে নতুন জায়গা খুঁজতে যায়এলাকা দখল নিয়ে লড়াইও হয়। কখনও কখনও বাঘ প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে লড়াইয়ে মারা পড়ে। ময়নাতদন্তের পর মৃতদেহ দাহ করা হয়।

স্থানান্তরবিশেষ করে এমন সীমানা-সচেতন ও বিশাল প্রাণীর ক্ষেত্রেসব সময়ই অত্যন্ত সংবেদনশীল কাজ। ভারতের টাইগার রিজার্ভে এ কাজে অগ্রসর হওয়ার আগে বহুস্তর যাচাই ও অনুমোদন লাগে। প্রধান বিবেচনাদাতা এলাকার জনসংখ্যা কি প্রজননক্ষম এক বাঘিনী হারিয়েও টিকে থাকবেতাডোবার ক্ষেত্রে এই প্রশ্নে উদ্বেগ নেই।

সিমলিপালের দুই-তৃতীয়াংশ আয়তনের হলেও তাডোবায় প্রায় ৯৫টি বাঘ আছেআর এটি কোনো বাঘের দ্বীপ’ নয়: প্রাকৃতিক করিডর তাডোবাকে উত্তরে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরের উমরেদকরহান্ডলা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যউত্তরপূর্বে ১১০ কিলোমিটার দূরের নবেংগাঁওনাগঝিরা টাইগার রিজার্ভও দক্ষিণপশ্চিমে ১১০ কিলোমিটার দূরের কাওয়াল টাইগার রিজার্ভের সঙ্গে যুক্ত করেছে। তাডোবার বাঘেরা নিয়মিত আরও বনভূমির খোঁজে বেরিয়ে পড়ে। গত এক দশকে সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই চলাচল মানেবনের টুকরোটুকরো প্যাচগ্রাম ও কৃষিজমির মোজাইকভূমিতে মানুষবাঘকে আবার সহাবস্থানের পথ শিখতে হচ্ছে। টি১২ ও তার আত্মীয়দের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়এই করিডরসংযুক্ত নেটওয়ার্ক বাঘদের মধ্যে জিনের অবিরাম আদানপ্রদান নিশ্চিত করেছে।

জমুনা কয়েক সপ্তাহের মধ্যে তাডোবার দুটি স্থানান্তরিত বাঘিনীর প্রথমটি হতে চলেছিল। তবে তাকে প্রথমে বেহুঁশ করতে হবে।

জমুনাকে স্ট্রেচারে তুলতে ও ছায়াযুক্ত জায়গায় আনতে সাতজন মানুষের দরকার পড়ল। খোবরাগাড়ে আঘাত আছে কি না পরীক্ষা করলেনরক্তের নমুনা নিলেন। গলায় জিপিএস কলার পরিয়ে তাকে ধাতব খাঁচায় তোলা হলোযা ট্রাকের ওপর বসানো। তারপর জাগিয়ে তোলার ওষুধ দেওয়া হলো। কয়েক মিনিটের মধ্যে ধাতবে নখের আঁচড়দমকা শব্দতারপর গর্জন শোনা গেল।

সিমলিপাল পর্যন্ত সড়কপথে যেতে ২৮ ঘণ্টা লেগেছে। ট্রাকের সঙ্গে ছিল ছোট এক সহায়ক কনভয়। বড় শহর ও শব্দপ্রবণ এলাকা এড়িয়ে রুট পরিকল্পিত ছিলযাতে জমুনার ওপর শব্দচাপ না পড়ে। কয়েক ঘণ্টা পরপর থেমে বিরতিও দেওয়া হয়েছে। শেষমেশদরজা খুলতেই জমুনা লাফিয়ে ঢুকে পড়ল তার নতুন বাড়িতেসিমলিপালে এক একর আয়তনের অভিযোজনপেনেযেখানে প্রায় দুই সপ্তাহ কাটিয়ে সে মানিয়ে নিল। এরপর আরেকবার দরজা খুললএবার খাঁচা ছাড়াসে টি১২এর এলাকার দিকে মুক্তি পেল।

বন্য ভারতীয় বাঘের বৈচিত্র্য পুনরুদ্ধারে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ প্রকৃতির হাতেমিলন। আর বাঘ মিলনের আগে বেছে নেয়।

নভেম্বরেইজমুনার মুক্তির কম এক মাস পরতাডোবা থেকে দ্বিতীয় বাঘিনী জীনাতকে বেহুঁশ করে সিমলিপালের পেনে আনা হলো। জমুনা যেখানে তুলনামূলক সহজে সিমলিপালের ভূদৃশ্যে মানিয়ে নিয়েছেজীনাত সেখানে চাপ অনুভব করে দ্রুত রিজার্ভের সীমানা ছাড়িয়ে যায়। বনবিভাগের দল আবার তাকে প্রশমিত করে ফিরিয়ে আনেআরও কয়েক সপ্তাহ পেনে অভ্যস্ত করিয়ে শেষে টি১২এর এলাকায় ছেড়ে দেওয়া হয়।

জমুনা ও জীনাত দুজনের গলায়ই জিপিএস কলারবনকর্মীরা তাদের গতিবিধি ও আচরণ নজরদারি করছিলেন। টি১২ বা অন্য কোনো পুরুষ বাঘের সঙ্গে তাদের মুখোমুখি হওয়া হচ্ছে কি না দেখছিলেন। মিলনসঙ্গী জুটি কখনও কখনও কয়েক সপ্তাহ একসঙ্গে ঘুরে বেড়ায়বনের ভেতর হাঁটেসুর তুলে ডাকে। তবুবাঘিনীরা সিমলিপালে নিজেদের এলাকা গড়ে তোলার পরও টি১২এর সঙ্গে তাদের যোগাযোগের কোনো প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছিল না।

মের এক রাতে পর্যন্ত। তাপচিত্র ও দৃশ্যমান উভয় রকম ছবি নেওয়া ক্যামেরার ফিড দেখতে গিয়ে বনবিভাগ দেখলজীনাত ও টি১২ পাশাপাশি। অখণ্ড প্রমাণতাদের মিলনরীতি শুরু হয়েছে।

উমা রামকৃষ্ণন বললেন, “আমরা এখনও আত্মীয়স্বজনের মধ্যে প্রজননের পূর্ণ প্রভাব বুঝতে চেষ্টা করছি। তবে একটি বিষয় নিশ্চিতএই ধরনের জেনেটিক ক্ষয় থেকে কোনো মৌলিক লাভ নেই।

এই মিলনদৃশ্য দেখায়জেনেটিক উদ্ধার মিশনটি পুরোপুরি সফল না হলেও আশার জায়গা আছে। এদিকেএ গ্রীষ্মজুড়ে স্থানান্তরদল জীনাতের প্রথম শাবকের অপেক্ষা করছেআর রামকৃষ্ণন ও তার শিক্ষার্থীরা সিমলিপালের বাঘদের ফেলে যাওয়া লোমমল থেকে আরও নমুনা জোগাড় করছেনজনসংখ্যার ভেতরের বৈচিত্র্য বোঝার জন্য। সবাই আশা করছেনজমুনাও শেষমেশ সঙ্গী খুঁজে পাবে। আর সবার কৌতূহলজীনাতের শাবকদের গায়ে কি টি১২এর সিউডোমেলানিজম দেখা যাবে?

আরও বাঘিনী আনা হবে কি নাহলে কবেএ নিয়ে সিদ্ধান্ত হয়নি। তবেসিমলিপালকে অন্য বাঘঅভয়ারণ্যের সঙ্গে করিডর নাজোড়া পর্যন্তআরও স্থানান্তরই হয়তো একমাত্র কার্যকর বিকল্প। সামনেসিমলিপালের মাঠপরিচালক প্রকাশ চন্দ্র গোগিনেনি আশা করছেনএকদিন সিমলিপালই বৈচিত্র্যময় এক সোর্সপপুলেশন’ হয়ে উঠবেযেখান থেকে কাছের সাটকোশিয়ার মতো অভয়ারণ্যে বাঘ ফিরিয়ে নেওয়া যাবে।

সব কিছু সামনে থেকে দেখেসংখ্যা বাড়তে শুরু করা ভারতীয় বাঘদের যে ফাঁদে পড়তে হয়তা আমাকে শৈশবের কিছু মুহূর্তে ফিরিয়ে নেয়। আমার বড় হওয়া চন্দ্রপুরের কাছের এক খামারবাড়িতেজীবন ঘুরেছে বনপ্রাণীদের চারপাশেসুখদুঃখে। পোষা কুকুরকে নাম দেওয়াই ছিল কষ্টেরকারণ চিতাবাঘ প্রায়ই টানত। মাঝেমধ্যে আমরা এমন পায়ের ছাপও পেতামযা চিতাবাঘের মতোকিন্তু অনেক বড়। সত্যিকারের শীর্ষ শিকারির সঙ্গে একই পরিসর ভাগ করে নেওয়ার ভয়উত্তেজনায় বাতাস ঘন হয়ে থাকত।

এত শক্তিশালী ও ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকা কিছুর সঙ্গে সহাবস্থান আমাকে বন আর সেখানে আমার জায়গা সম্পর্কে ভাবতে শিখিয়েছে। আমাদের খামারে আমি কোনো বাঘ দেখিনি। কিন্তু প্রায়ই স্বপ্নে দেখেছি। বহু বছর পরে অসংখ্য বাঘ দেখেছিপড়েছিছবি তুলেছি। তবু রঘুকে সঙ্গে নিয়ে ধীরে চলা ট্রাকে বসে সেদিন সিমলিপালে যে বাঘটিকে দেখলামতার মতো আর কেউ নয়। টি১২এর সঙ্গে কয়েক সেকেন্ডের চোখাচোখিতে আমি ক্যামেরা তুলিনি। নড়িনি। আমার সামনে দাঁড়ানো এক কালো বাঘমানবসদিচ্ছার জটিলতার জীবন্ত দলিল। সিমলিপালের জন্য সেরা পরিস্থিতিতে একদিন এই প্রাণীটি হবে বিরল ও অবিস্মরণীয়যে নতুন এক সংরক্ষণশাস্ত্রকে অনুপ্রাণিত করবে। সেই মুহূর্তেরাস্তার উপর চার সেকেন্ডজুড়েসেটি ছিল প্রকৃতির এক নিঃশব্দ অলৌকিকতা। তারপর কোনো গর্জন ছাড়াই টি১২ দৃঢ় পদক্ষেপে সবুজ অরণ্যের গভীরে মিলিয়ে গেল।

জমুনা চন্দ্রপুরের অভয়ারণ্য থেকে সিমলিপালে আনা দুই বাঘিনীর প্রথমটি। তাকে অভিযোজনপেনে ছাড়া হয়েছিল। কর্তৃপক্ষ আশা করছেদুজনেই সিমলিপালের পুরুষ বাঘদের সঙ্গে মিলিত হয়ে জেনেটিকভাবে আরও বৈচিত্র্যময় নতুন প্রজন্ম গড়ে তুলবে।