১১:০০ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৫
ফিরে এলেন টিনা ফে–অ্যামি পোহলার—এসএনএলের ওপেনিংয়ে ক্যামিও–ঝড় আরেকজন দেশবিরোধীকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হলো পুরান ঢাকার অতীত দিনের কথা ( কিস্তি-১০৭) ওপেনএআই–কে দেওয়া ‘ডাটা সংরক্ষণ’ আদেশ সংকুচিত—প্রযুক্তি খাতের পাঠ কী নিউজিল্যান্ডের লক্ষ্য: ২০৫০–এর মধ্যে কৃষি–মিথেন ২৪% পর্যন্ত কমানো সাহারার দক্ষিণে আফ্রিকার প্রাণঘাতী সাপ বুমস্ল্যাং-এর জীবন, বিষ ও রহস্য প্রাচীন ভারতে গণিতচর্চা (পর্ব-৩০৫) এসএনএলের ভাইরাল ব্যঙ্গের পর কে জেতে? স্ট্রিমিংয়ের ‘মানডে বাম্প’ সমীকরণ অজগরের মতো নয়, কিন্তু ভয় আর কৌতূহলের প্রতীক—বাংলার লোককথায় ও বাস্তব জগতে সাপনী সাপের রহস্যময় জীবন হাডসন’স বে কোম্পানির অনন্য নিদর্শনের পেছনের গল্প

আরেকজন দেশবিরোধীকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হলো

এবার নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন মারিয়া ম্যাচাডো। মারিয়া ম্যাচাডো শুধু ভেনিজুয়েলায় আমেরিকান সমর্থক প্রার্থী হিসেবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করেননি—তিনি তার দেশের তেল-গ্যাস সম্পদ বিদেশি কোম্পানিকে দিয়ে দেওয়ার পক্ষে।

তার দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে তিনি ২০২৩ সালে ফিলিপো টোরোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, দেশের তেল-গ্যাস কোম্পানিগুলো যেহেতু সরকারি মালিকানায় চলছে, তার ভেতর দুর্নীতি আছে। তাই তিনি এটা প্রাইভেটাইজেশনের পক্ষে। যার মূল অর্থ দাঁড়ায় বিদেশি কোম্পানিকে দিয়ে দেওয়ার পক্ষে তিনি।

হুগো শ্যাভেজ যখন প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তখনও তার ওপর চাপ ছিল তেল-গ্যাস কোম্পানিগুলো প্রাইভেটাইজেশনের জন্যে। সে কারণে তাকে অনেক চাপ সহ্য করতে হয়েছে এবং সেই চাপ এখনও ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট মাদুরোকে সহ্য করতে হচ্ছে।

সম্প্রতি নিকারাগুয়ার প্রেসিডেন্ট দাবি করেছেন, আমেরিকা ভেনিজুয়েলার তেল সম্পদ নেওয়ার জন্যই সেনা সমাবেশ ঘটিয়েছে।

বাস্তবে পৃথিবীর বড় বড় তেল-গ্যাস কোম্পানিগুলো অনেক বেশি শক্তিধর। এবং বড় শক্তি, রাষ্ট্র ও রাষ্টক্ষমতা, রাজনীতি তারা দীর্ঘদিন ধরেই নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। এদের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে লড়া খুবই কঠিন বিষয়।

ভেনিজুয়েলার হুগো শ্যাভেজকে পশ্চিমা মিডিয়া অনেকটা ভিলেন হিসেবে তৈরি করেছে। এমনকি এটাও সত্য, তাঁর বিশাল তেল সম্পদ থাকা সত্ত্বেও তিনি দেশের উন্নতি ওইভাবে করতে পারেননি।

চিত্র:Emblem of Iran.svg - উইকিপিডিয়া

বাস্তবে এই তেল কোম্পানি ও বড় রাষ্ট্রগুলোর তেল-গ্যাস দখলের রাজনীতির বিপক্ষে লড়াই করা কত কঠিন বিষয় তা কোনো মতে একটা কলামে লেখা সম্ভব নয়। এবং এর সব কারণ খোঁজাও সম্ভব নয়, আবার কারণ খুঁজতে গিয়ে অনেক লেখক, সাংবাদিক অনেক বড় বিপদে পড়েছেন।

নিজ দেশের তেল সম্পদ রক্ষার জন্যে এই কোম্পানিগুলো এবং এদের পেছনে থাকা রাষ্ট্রগুলোর বিপক্ষে যারা দাঁড়িয়েছেন, এমন রাষ্ট্রনায়কদের অধিকাংশকেই ক্ষমতা হারাতে হয়েছে।অস্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে।

১৯৫১ সালে ইরানের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মোসাদ্দেক অ্যাংলো-ইরানি ওয়েল কোম্পানি (AIOC) কে জাতীয়করণ করেন। এরপরেই ১৯৫৩ সালে অ্যাংলো-ইরানি ওয়েল কোম্পানি যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের সহায়তায় মোহাম্মদ মোসাদ্দেককে ক্ষমতাচ্যুত করে। দীর্ঘদিন ধরে AIOC-এর সঙ্গে যুক্ত শাহকে ইরানের প্রেসিডেন্ট করা হয়। শাহ ক্ষমতায় এসেই আবার AIOC কে রাষ্ট্রীয়করণ থেকে পূর্বের মালিকানায় ফেরত দেন। তারপরের ইতিহাস সকলে জানেন—শাহর আমলে কীভাবে ইরানের তেল-গ্যাস লুটপাট হয়েছে।

ঠিক তেমনি আজকের যে ধ্বংসস্তূপ ইরাক এবং এর যে শক্তিশালী নেতা ছিলেন সাদ্দাম হোসেন—যে সাদ্দাম হোসেনের কথা মনে হলেই বাঙালি মাত্রই তাকে শ্রদ্ধা করা উচিত। কারণ, ১৯৭১ সালে মধ্যপ্রাচ্যের একমাত্র দেশ ইরাক ও তার নেতা সাদ্দাম হোসেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সর্বাত্মকভাবে সহযোগিতা করেছিলেন। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের সব রিজার্ভ তো ১৬ ডিসেম্বরের আগে পশ্চিম পাকিস্তানিরা, অর্থাৎ বর্তমানের পাকিস্তানিরা নিয়ে গিয়েছিল। এই শূন্য রিজার্ভের বাংলাদেশ ব্যাংক যাত্রা শুরু করে ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের দান হিসেবে দেওয়া ডলারের মাধ্যমে। (এই মুহূর্তে ডলারের পরিমাণটি মনে করতে পারছি না।) তাছাড়া ১৯৭১ সালের বিশ্বের পত্র-পত্রিকা দেখলে জানা যায়, ইরাকের আল আহরাম পত্রিকা কীভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে শুধু রিপোর্ট নয়, বারবার সম্পাদকীয় লিখেছিল। এমনকি পাকিস্তান জেলে থাকা বাংলাদেশের নির্বাচিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির দাবীতেও ওই পত্রিকা সম্পাদকীয় লেখে।

সাদ্দাম হোসেনের ক্যাপচার - উইকিপিডিয়া

এই ইরাক যখন আমেরিকা ও যুক্তরাজ্য মিলে আক্রমণ করে, তাদের বক্তব্য ছিল ইরাকে বায়োলজিক্যাল অস্ত্র আছে। তাদের এমবেডেড মিডিয়া শুধু সেটাই প্রচার করেনি, সঙ্গে সঙ্গে সাদ্দাম হোসেনকে দুর্নীতিবাজ হিসেবেও প্রচার করে। কিন্তু ওই সময়ে ব্রিটেনের ক্ষমতাসীন লেবার পার্টি—যার নেতা টনি ব্লেয়ার, যাকে আমেরিকান পুডল বলা হয়—তার দল থেকে একজন এমপি ওই যুদ্ধে ব্রিটেনের যোগদানের বিপক্ষে দাঁড়ান এবং পদত্যাগ করেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি গার্ডিয়ানে তার পদত্যাগের কারণ ও ওই যুদ্ধের মূল উদ্দেশ্য নিয়ে একটি নিবন্ধ লেখেন। ওই সময়ে ওই নিবন্ধটি অনুবাদ করে তখন যে পত্রিকায় কাজ করতাম সেখানে ছেপেছিলাম। তাই এখনো স্পষ্ট স্মৃতিতে আছে—তিনি ওই যুদ্ধের মূল কারণ দেখিয়েছিলেন ইরাকের তেল সম্পদ অবৈধ পথে সরিয়ে নেওয়ার জন্যই মূলত এ যুদ্ধ।

যাহোক, হুগো শ্যাভেজের কথায় ফিরে আসি। তিনি বিশাল তেল সম্পদ থাকা সত্ত্বেও তাঁর দেশকে অর্থনৈতিকভাবে উন্নত করতে পারেননি। কারণ, একটি ছোট দেশকে সিংহের সঙ্গে লড়াই করে—একদিকে নিজের সম্পদ রক্ষা করা, অন্যদিকে নিজের দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্বাভাবিকভাবে চালানো কত কঠিন, তা যারা এমন দেশপ্রেম নিয়ে রাষ্ট্র চালিয়েছেন তারা জানেন। তেমনি পাশাপাশি যেসব সাংবাদিক ভূরাজনীতি ও ভূসম্পদ দখলের রাজনীতির দিকে সামান্য চোখ রাখার সুযোগ পান, তারাও অতি সামান্য বুঝতে পারেন। যেমন যদিও খুব সামনে আসে না, তারপরেও ইন্দোনেশিয়ার তেল ও গ্যাস খনিগুলো নিয়ে বিদেশি কোম্পানি ও সে দেশের বিদেশি কোম্পানির এজেন্টরা কী করে এবং সেখানকার রাষ্ট্রক্ষমতা শুরু থেকেই কেন ভিন্ন খাতে গেল তা নিয়ে যথেষ্ট বই আছে। সেগুলো কিছুটা হলেও কিছু ছবি সামনে নিয়ে আসে।

এই সব পরাক্রমশালী ক্ষমতার বিপরীতে দাঁড়িয়ে হুগো শ্যাভেজ তার দেশের অর্থনীতিকে দাঁড় করিয়ে যেতে পারেননি। তবে তার সাফল্য—তিনি যখন মারা যান, সে সময়ে তিনি তার দেশের ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য যে পরিমাণ তেল-গ্যাস রেখে যান, তা সৌদি আরবের থেকেও বেশি।

আর এই তেল-গ্যাস রক্ষা করতে গিয়ে হুগো শ্যাভেজকে এক ধরনের সমাজতান্ত্রিক হতে হয়েছিল। আর এই সমাজতান্ত্রিক হুগো শ্যাভেজ যখন ২০০১-এ বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে বাংলাদেশে আসেন, ওই সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের এক সাংবাদিক বন্ধু বলেছিলেন, “তোমাদের সরকার যে শ্যাভেজকে আমন্ত্রণ করল—এর ধাক্কা সহ্য করতে পারবে?”

গণহত্যার অভিযোগ অস্বীকার করলেন সু চি - BBC News বাংলা

প্রথমে তার কথার পুরো অর্থ বুঝতে পারিনি। কিন্তু পরে ক্লিনটনের সফরের সময়ে তেল-গ্যাস নিয়ে কথা সামনে আসে। এমনকি নির্বাচন নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে যখন কার্টার এ দেশে আসেন, সে সময়েও মূল বিষয় ছিল তেল-গ্যাস।

যেমন আশির দশকে অনেকের মতো আমিও তৎকালীন বার্মার নেতা সুচির ভক্ত ছিলাম। তাঁর মুক্তির আন্দোলনের পক্ষে অনেক লিখেছি। আর যখন তাঁকে শান্তিতে নোবেল দেওয়া হলো, তখন অনেকের মতোই খুশি হয়েছিলাম। কিন্তু সুচি ক্ষমতায় আসার কয়েকদিন পরেই সেখানে উড়ে এলেন হিলারি ক্লিনটন। তিনি সেখান থেকে বাংলাদেশ হয়ে ভারতের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে গেলেন। কারণ, পশ্চিমবঙ্গ সেবার দীর্ঘ বাম শাসনের শুধু অবসান ঘটায়নি—পশ্চিমবঙ্গে যে আর খুব শিগগির কোনো শিল্প প্রতিষ্ঠান হবে না, তার নিশ্চয়তাও ততদিনে নিশ্চিত হয়ে গেছে।

অন্যদিকে শান্তিতে নোবেল পাওয়া সুচি ক্ষমতায় আসার পরপরই দেখা গেল, মিয়ানমারের বেশ কিছু বিদ্রোহী গ্রুপের সঙ্গে এসে পশ্চিমা অনেক অজানা লোক যোগ দিল। যা অনেক দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া বিশেষজ্ঞ সাংবাদিকের রিপোর্ট থেকে শুধু নয়, আরও অনেক সূত্র থেকে অনেক সাংবাদিক জানতে শুরু করলেন। প্রথমে অনেকেই ধারণা করেছিলেন এটা অস্ত্র ও ড্রাগের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। কিন্তু দেখা গেল, বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর মূল লক্ষ্য রেয়ার আর্থ। এছাড়া সাগরের তেল-গ্যাসের জন্য বড় কোম্পানিগুলো তো আছেই।

আর এই বিদ্রোহী গ্রুপগুলোকে শক্তিশালী করা ও মিয়ানমারকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেওয়ার জন্য বিদ্রোহী আর্মি শুধু নয়, পাকিস্তান, তুরস্কসহ অনেক পশ্চিমা দেশের প্রতিনিধিদলের গোপন কার্যক্রমের খবর পাওয়া যেতে থাকে। আর সে ফাঁদে বাংলাদেশের তৎকালীন সরকারও পা দেয়, যার ভার এখন বাংলাদেশ বইছে।

শান্তিতে নোবেল পেলেন মারিয়া কোরিনা মাচাদো!

আর সুচির পাঁচ বছরে বিদ্রোহী গ্রুপগুলো এতই শক্তিশালী হবার সুযোগ পায় যে পরবর্তীতে সামরিক শাসন জারি হবার পরেও এখনও মিয়ানমার একটি অশান্ত দেশ—গৃহযুদ্ধকবলিত দেশ। এর পরেও দেশটি তার রেয়ার আর্থ কিছুটা রক্ষা ও কিছুটা বৈধ পথে বিক্রি করতে পারছে- দেশটির ভৌগোলিক শক্তির কারণে। কিন্তু দেশটিকে যে খাদে শান্তির নোবেল লরিয়েট সুচি ফেলে দিয়েছেন, সেখান থেকে সহজে ওঠার কোনো পথ নেই।

হুগো শ্যাভেজের পরে মাদুরো এখনও ভেনিজুয়েলার তেল ও গ্যাস রক্ষা করছেন। কিন্তু এই সময়ে শান্তিতে নোবেল দেওয়া হলো মারিয়া ম্যাচাডোকে, যিনি প্রকাশ্যে তার দেশের তেল-গ্যাসকে প্রাইভেট কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়ার পক্ষে।

আর ট্রাম্পও তাঁর চরিত্র অনুযায়ী রাখঢাক কোনো বক্তব্য রাখেননি। তিনি সরাসরি বলেছেন, মারিয়া ম্যাচাডোকে শান্তিতে নোবেল দেওয়া হয়েছে—রাজনৈতিক কারণেই।

সৌদি আরবের থেকে বেশি তেল সম্পদের অধিকারী দক্ষিণ আমেরিকার এই দেশটির তেল-গ্যাস সম্পদ আর কতদিন সেদেশের মানুষ ধরে রাখতে পারবে, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিল।

লেখক: সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক, সারাক্ষণ, The Present World.

জনপ্রিয় সংবাদ

ফিরে এলেন টিনা ফে–অ্যামি পোহলার—এসএনএলের ওপেনিংয়ে ক্যামিও–ঝড়

আরেকজন দেশবিরোধীকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হলো

০৮:০০:০৮ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৫

এবার নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন মারিয়া ম্যাচাডো। মারিয়া ম্যাচাডো শুধু ভেনিজুয়েলায় আমেরিকান সমর্থক প্রার্থী হিসেবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করেননি—তিনি তার দেশের তেল-গ্যাস সম্পদ বিদেশি কোম্পানিকে দিয়ে দেওয়ার পক্ষে।

তার দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে তিনি ২০২৩ সালে ফিলিপো টোরোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, দেশের তেল-গ্যাস কোম্পানিগুলো যেহেতু সরকারি মালিকানায় চলছে, তার ভেতর দুর্নীতি আছে। তাই তিনি এটা প্রাইভেটাইজেশনের পক্ষে। যার মূল অর্থ দাঁড়ায় বিদেশি কোম্পানিকে দিয়ে দেওয়ার পক্ষে তিনি।

হুগো শ্যাভেজ যখন প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তখনও তার ওপর চাপ ছিল তেল-গ্যাস কোম্পানিগুলো প্রাইভেটাইজেশনের জন্যে। সে কারণে তাকে অনেক চাপ সহ্য করতে হয়েছে এবং সেই চাপ এখনও ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট মাদুরোকে সহ্য করতে হচ্ছে।

সম্প্রতি নিকারাগুয়ার প্রেসিডেন্ট দাবি করেছেন, আমেরিকা ভেনিজুয়েলার তেল সম্পদ নেওয়ার জন্যই সেনা সমাবেশ ঘটিয়েছে।

বাস্তবে পৃথিবীর বড় বড় তেল-গ্যাস কোম্পানিগুলো অনেক বেশি শক্তিধর। এবং বড় শক্তি, রাষ্ট্র ও রাষ্টক্ষমতা, রাজনীতি তারা দীর্ঘদিন ধরেই নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। এদের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে লড়া খুবই কঠিন বিষয়।

ভেনিজুয়েলার হুগো শ্যাভেজকে পশ্চিমা মিডিয়া অনেকটা ভিলেন হিসেবে তৈরি করেছে। এমনকি এটাও সত্য, তাঁর বিশাল তেল সম্পদ থাকা সত্ত্বেও তিনি দেশের উন্নতি ওইভাবে করতে পারেননি।

চিত্র:Emblem of Iran.svg - উইকিপিডিয়া

বাস্তবে এই তেল কোম্পানি ও বড় রাষ্ট্রগুলোর তেল-গ্যাস দখলের রাজনীতির বিপক্ষে লড়াই করা কত কঠিন বিষয় তা কোনো মতে একটা কলামে লেখা সম্ভব নয়। এবং এর সব কারণ খোঁজাও সম্ভব নয়, আবার কারণ খুঁজতে গিয়ে অনেক লেখক, সাংবাদিক অনেক বড় বিপদে পড়েছেন।

নিজ দেশের তেল সম্পদ রক্ষার জন্যে এই কোম্পানিগুলো এবং এদের পেছনে থাকা রাষ্ট্রগুলোর বিপক্ষে যারা দাঁড়িয়েছেন, এমন রাষ্ট্রনায়কদের অধিকাংশকেই ক্ষমতা হারাতে হয়েছে।অস্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে।

১৯৫১ সালে ইরানের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মোসাদ্দেক অ্যাংলো-ইরানি ওয়েল কোম্পানি (AIOC) কে জাতীয়করণ করেন। এরপরেই ১৯৫৩ সালে অ্যাংলো-ইরানি ওয়েল কোম্পানি যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের সহায়তায় মোহাম্মদ মোসাদ্দেককে ক্ষমতাচ্যুত করে। দীর্ঘদিন ধরে AIOC-এর সঙ্গে যুক্ত শাহকে ইরানের প্রেসিডেন্ট করা হয়। শাহ ক্ষমতায় এসেই আবার AIOC কে রাষ্ট্রীয়করণ থেকে পূর্বের মালিকানায় ফেরত দেন। তারপরের ইতিহাস সকলে জানেন—শাহর আমলে কীভাবে ইরানের তেল-গ্যাস লুটপাট হয়েছে।

ঠিক তেমনি আজকের যে ধ্বংসস্তূপ ইরাক এবং এর যে শক্তিশালী নেতা ছিলেন সাদ্দাম হোসেন—যে সাদ্দাম হোসেনের কথা মনে হলেই বাঙালি মাত্রই তাকে শ্রদ্ধা করা উচিত। কারণ, ১৯৭১ সালে মধ্যপ্রাচ্যের একমাত্র দেশ ইরাক ও তার নেতা সাদ্দাম হোসেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সর্বাত্মকভাবে সহযোগিতা করেছিলেন। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের সব রিজার্ভ তো ১৬ ডিসেম্বরের আগে পশ্চিম পাকিস্তানিরা, অর্থাৎ বর্তমানের পাকিস্তানিরা নিয়ে গিয়েছিল। এই শূন্য রিজার্ভের বাংলাদেশ ব্যাংক যাত্রা শুরু করে ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের দান হিসেবে দেওয়া ডলারের মাধ্যমে। (এই মুহূর্তে ডলারের পরিমাণটি মনে করতে পারছি না।) তাছাড়া ১৯৭১ সালের বিশ্বের পত্র-পত্রিকা দেখলে জানা যায়, ইরাকের আল আহরাম পত্রিকা কীভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে শুধু রিপোর্ট নয়, বারবার সম্পাদকীয় লিখেছিল। এমনকি পাকিস্তান জেলে থাকা বাংলাদেশের নির্বাচিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির দাবীতেও ওই পত্রিকা সম্পাদকীয় লেখে।

সাদ্দাম হোসেনের ক্যাপচার - উইকিপিডিয়া

এই ইরাক যখন আমেরিকা ও যুক্তরাজ্য মিলে আক্রমণ করে, তাদের বক্তব্য ছিল ইরাকে বায়োলজিক্যাল অস্ত্র আছে। তাদের এমবেডেড মিডিয়া শুধু সেটাই প্রচার করেনি, সঙ্গে সঙ্গে সাদ্দাম হোসেনকে দুর্নীতিবাজ হিসেবেও প্রচার করে। কিন্তু ওই সময়ে ব্রিটেনের ক্ষমতাসীন লেবার পার্টি—যার নেতা টনি ব্লেয়ার, যাকে আমেরিকান পুডল বলা হয়—তার দল থেকে একজন এমপি ওই যুদ্ধে ব্রিটেনের যোগদানের বিপক্ষে দাঁড়ান এবং পদত্যাগ করেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি গার্ডিয়ানে তার পদত্যাগের কারণ ও ওই যুদ্ধের মূল উদ্দেশ্য নিয়ে একটি নিবন্ধ লেখেন। ওই সময়ে ওই নিবন্ধটি অনুবাদ করে তখন যে পত্রিকায় কাজ করতাম সেখানে ছেপেছিলাম। তাই এখনো স্পষ্ট স্মৃতিতে আছে—তিনি ওই যুদ্ধের মূল কারণ দেখিয়েছিলেন ইরাকের তেল সম্পদ অবৈধ পথে সরিয়ে নেওয়ার জন্যই মূলত এ যুদ্ধ।

যাহোক, হুগো শ্যাভেজের কথায় ফিরে আসি। তিনি বিশাল তেল সম্পদ থাকা সত্ত্বেও তাঁর দেশকে অর্থনৈতিকভাবে উন্নত করতে পারেননি। কারণ, একটি ছোট দেশকে সিংহের সঙ্গে লড়াই করে—একদিকে নিজের সম্পদ রক্ষা করা, অন্যদিকে নিজের দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্বাভাবিকভাবে চালানো কত কঠিন, তা যারা এমন দেশপ্রেম নিয়ে রাষ্ট্র চালিয়েছেন তারা জানেন। তেমনি পাশাপাশি যেসব সাংবাদিক ভূরাজনীতি ও ভূসম্পদ দখলের রাজনীতির দিকে সামান্য চোখ রাখার সুযোগ পান, তারাও অতি সামান্য বুঝতে পারেন। যেমন যদিও খুব সামনে আসে না, তারপরেও ইন্দোনেশিয়ার তেল ও গ্যাস খনিগুলো নিয়ে বিদেশি কোম্পানি ও সে দেশের বিদেশি কোম্পানির এজেন্টরা কী করে এবং সেখানকার রাষ্ট্রক্ষমতা শুরু থেকেই কেন ভিন্ন খাতে গেল তা নিয়ে যথেষ্ট বই আছে। সেগুলো কিছুটা হলেও কিছু ছবি সামনে নিয়ে আসে।

এই সব পরাক্রমশালী ক্ষমতার বিপরীতে দাঁড়িয়ে হুগো শ্যাভেজ তার দেশের অর্থনীতিকে দাঁড় করিয়ে যেতে পারেননি। তবে তার সাফল্য—তিনি যখন মারা যান, সে সময়ে তিনি তার দেশের ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য যে পরিমাণ তেল-গ্যাস রেখে যান, তা সৌদি আরবের থেকেও বেশি।

আর এই তেল-গ্যাস রক্ষা করতে গিয়ে হুগো শ্যাভেজকে এক ধরনের সমাজতান্ত্রিক হতে হয়েছিল। আর এই সমাজতান্ত্রিক হুগো শ্যাভেজ যখন ২০০১-এ বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে বাংলাদেশে আসেন, ওই সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের এক সাংবাদিক বন্ধু বলেছিলেন, “তোমাদের সরকার যে শ্যাভেজকে আমন্ত্রণ করল—এর ধাক্কা সহ্য করতে পারবে?”

গণহত্যার অভিযোগ অস্বীকার করলেন সু চি - BBC News বাংলা

প্রথমে তার কথার পুরো অর্থ বুঝতে পারিনি। কিন্তু পরে ক্লিনটনের সফরের সময়ে তেল-গ্যাস নিয়ে কথা সামনে আসে। এমনকি নির্বাচন নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে যখন কার্টার এ দেশে আসেন, সে সময়েও মূল বিষয় ছিল তেল-গ্যাস।

যেমন আশির দশকে অনেকের মতো আমিও তৎকালীন বার্মার নেতা সুচির ভক্ত ছিলাম। তাঁর মুক্তির আন্দোলনের পক্ষে অনেক লিখেছি। আর যখন তাঁকে শান্তিতে নোবেল দেওয়া হলো, তখন অনেকের মতোই খুশি হয়েছিলাম। কিন্তু সুচি ক্ষমতায় আসার কয়েকদিন পরেই সেখানে উড়ে এলেন হিলারি ক্লিনটন। তিনি সেখান থেকে বাংলাদেশ হয়ে ভারতের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে গেলেন। কারণ, পশ্চিমবঙ্গ সেবার দীর্ঘ বাম শাসনের শুধু অবসান ঘটায়নি—পশ্চিমবঙ্গে যে আর খুব শিগগির কোনো শিল্প প্রতিষ্ঠান হবে না, তার নিশ্চয়তাও ততদিনে নিশ্চিত হয়ে গেছে।

অন্যদিকে শান্তিতে নোবেল পাওয়া সুচি ক্ষমতায় আসার পরপরই দেখা গেল, মিয়ানমারের বেশ কিছু বিদ্রোহী গ্রুপের সঙ্গে এসে পশ্চিমা অনেক অজানা লোক যোগ দিল। যা অনেক দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া বিশেষজ্ঞ সাংবাদিকের রিপোর্ট থেকে শুধু নয়, আরও অনেক সূত্র থেকে অনেক সাংবাদিক জানতে শুরু করলেন। প্রথমে অনেকেই ধারণা করেছিলেন এটা অস্ত্র ও ড্রাগের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। কিন্তু দেখা গেল, বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর মূল লক্ষ্য রেয়ার আর্থ। এছাড়া সাগরের তেল-গ্যাসের জন্য বড় কোম্পানিগুলো তো আছেই।

আর এই বিদ্রোহী গ্রুপগুলোকে শক্তিশালী করা ও মিয়ানমারকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেওয়ার জন্য বিদ্রোহী আর্মি শুধু নয়, পাকিস্তান, তুরস্কসহ অনেক পশ্চিমা দেশের প্রতিনিধিদলের গোপন কার্যক্রমের খবর পাওয়া যেতে থাকে। আর সে ফাঁদে বাংলাদেশের তৎকালীন সরকারও পা দেয়, যার ভার এখন বাংলাদেশ বইছে।

শান্তিতে নোবেল পেলেন মারিয়া কোরিনা মাচাদো!

আর সুচির পাঁচ বছরে বিদ্রোহী গ্রুপগুলো এতই শক্তিশালী হবার সুযোগ পায় যে পরবর্তীতে সামরিক শাসন জারি হবার পরেও এখনও মিয়ানমার একটি অশান্ত দেশ—গৃহযুদ্ধকবলিত দেশ। এর পরেও দেশটি তার রেয়ার আর্থ কিছুটা রক্ষা ও কিছুটা বৈধ পথে বিক্রি করতে পারছে- দেশটির ভৌগোলিক শক্তির কারণে। কিন্তু দেশটিকে যে খাদে শান্তির নোবেল লরিয়েট সুচি ফেলে দিয়েছেন, সেখান থেকে সহজে ওঠার কোনো পথ নেই।

হুগো শ্যাভেজের পরে মাদুরো এখনও ভেনিজুয়েলার তেল ও গ্যাস রক্ষা করছেন। কিন্তু এই সময়ে শান্তিতে নোবেল দেওয়া হলো মারিয়া ম্যাচাডোকে, যিনি প্রকাশ্যে তার দেশের তেল-গ্যাসকে প্রাইভেট কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়ার পক্ষে।

আর ট্রাম্পও তাঁর চরিত্র অনুযায়ী রাখঢাক কোনো বক্তব্য রাখেননি। তিনি সরাসরি বলেছেন, মারিয়া ম্যাচাডোকে শান্তিতে নোবেল দেওয়া হয়েছে—রাজনৈতিক কারণেই।

সৌদি আরবের থেকে বেশি তেল সম্পদের অধিকারী দক্ষিণ আমেরিকার এই দেশটির তেল-গ্যাস সম্পদ আর কতদিন সেদেশের মানুষ ধরে রাখতে পারবে, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিল।

লেখক: সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক, সারাক্ষণ, The Present World.