আগুনের ছাই থেকে পুনর্গঠনের স্বপ্ন
ক্যালিফোর্নিয়ার আলতাদেনা শহরের সকালটা ছিল মেঘলা। দাবানলে পোড়া একখণ্ড জমিতে কয়েকজন বিনিয়োগকারী নতুন কেনা জমি পরিদর্শন করছিলেন। পাশের বাসিন্দা এক নারী কৌতূহলভরে জানতে চাইলেন, “আপনারা কারা?”
উত্তরে দলের একজন বললেন, “এডউইন।”
এই নামটা শুনেই মহিলার মুখে ফুটে উঠল স্বস্তির হাসি। তিনি জানতেন, এই এডউইন কাস্ত্রোই ২০২২ সালে স্থানীয় এক গ্যাস স্টেশন থেকে ২ বিলিয়ন ডলারের পাওয়ারবল লটারি জেতা সেই ব্যক্তি।
১৫টি জমি কিনে পুনর্নির্মাণের উদ্যোগ
মাত্র ৩৩ বছর বয়সী কাস্ত্রো এখন নিজ শহর আলতাদেনার অন্যতম বড় জমি ক্রেতা। জানুয়ারির ভয়াবহ ইটন দাবানলের পর তিনি প্রায় ১ কোটি ডলার খরচ করে ১৫টি পোড়া জমি কিনেছেন। তাঁর লক্ষ্য—এলাকাটি আবারও প্রাণবন্ত করে তোলা।
দাবানলে ৩১ জন নিহত হয়েছিলেন এবং প্রায় ১৬ হাজার ভবন ধ্বংস হয়েছিল। কাস্ত্রো বলছেন, “এই ঘরগুলো এমন পরিবারগুলোর জন্য, যারা সত্যিই আবার এখানে ফিরতে চায়।”
স্থানীয়দের উদ্বেগ: ‘দ্বিতীয় দুর্যোগ’
আলতাদেনার অনেক বাসিন্দা নতুন বিনিয়োগকারীদের এই ঢেউয়ে উদ্বিগ্ন। প্রায় ৪২ হাজার জনসংখ্যার এই শহরে ১,৫০০-এর বেশি মানুষ স্বাক্ষর করেছেন এমন এক পিটিশনে, যা বহিরাগত বিনিয়োগকারীদের জমি কেনা বন্ধ করার দাবি জানায়।
তাদের আশঙ্কা, ঐতিহ্যবাহী ছোট শহরের চেহারা হারিয়ে যাবে। কারণ, ক্যালিফোর্নিয়ার সাম্প্রতিক আইন পরিবর্তনে এখন একক বাড়ির জায়গায় ডুপ্লেক্স বা অ্যাপার্টমেন্ট নির্মাণ সহজ হয়ে গেছে।
স্থানীয় বাসিন্দা শওনা ডসন বিয়ার বলেন, “আমরা শুধু পুনর্গঠন নয়, ঘনবসতি আর জেন্ট্রিফিকেশন নিয়েও লড়ছি।”
লাভ নয়, টেকসই পুনর্গঠন—কাস্ত্রোর দাবি
কাস্ত্রো জানালেন, তাঁর পরিকল্পনা দাতব্য নয়; তিনি বাজারদরে ঘর বিক্রি করতে চান, তবে সীমিত লাভে।
“আমি এমন পরিবারগুলোকে বিক্রি করতে চাই যারা এখানে থেকে জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু করবে,” তিনি বলেন।
নিজের জন্যও একটি বাড়ি নির্মাণের ইচ্ছা তাঁর আছে—দুটি জমি মিলিয়ে তিনি এমন এক বাড়ি গড়তে চান যেখানে থাকবে গোপন ভূগর্ভস্থ কক্ষ, কিছুটা ‘উইলি ওয়াঙ্কা’-র মতো রহস্যময় নকশা।
“আমি পরিবার গঠন করতে চাই—এটা আমার কাছে জীবনের মূল বিষয়,” বলেন অবিবাহিত কাস্ত্রো।
শৈশবের শহরে ফেরার প্রেরণা
কাস্ত্রোর বাবা ছিলেন নির্মাণশ্রমিক। গেটি মিউজিয়ামসহ নানা স্থাপনা নিয়ে বাবার গর্বের কথা এখনো তাঁর মনে আছে।
এই প্রেরণাই তাঁকে নিজ শহরকে পুনর্গঠনের সুযোগ দিয়েছে। তাঁর ইচ্ছে—আগামী প্রজন্মকে দেখানো, কীভাবে তিনি নিজের শহরকে নতুন প্রাণ দিয়েছেন।
সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া: আশার আলো ও সংশয়
কিছু বাসিন্দা কাস্ত্রোর উদ্যোগে আশাবাদী। “তিনি এখানকার সন্তান, তাই তাঁর প্রতি আমার আস্থা আছে,” বলেন স্থানীয় ঠিকাদার জোয়েল ব্রায়ান্ট।
তবে অন্যরা সন্দিহান। “শেষ পর্যন্ত সেও লাভের জন্য কাজ করছে,” মন্তব্য করেন বাসিন্দা সেরিনা কোভারুবিয়াস।
১০ বছরের পরিকল্পনা ও নতুন দল
রিয়েল এস্টেট উন্নয়নে নবাগত কাস্ত্রো একদল বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করেছেন—ডিজাইন কনসালট্যান্ট আরভিন শিরিনইয়ান্স তাঁর হয়ে স্থাপত্য নকশা ও অনুমোদনের কাজ দেখছেন।
প্রথম দুটি ছোট লটে তিন শোবার ঘরের ক্র্যাফ্টসম্যান-স্টাইল বাড়ির পরিকল্পনা জমা দেওয়া হয়েছে। পুরো প্রকল্পটি শেষ হতে প্রায় ১০ বছর লাগবে বলে অনুমান।
“আপনি যদি খুব তাড়াতাড়ি শেষ করেন, তখন চারপাশে নির্মাণকাজ চলতে থাকে,” বলেন কাস্ত্রো। “শেষে বিক্রি করলেই সবার ঘর তখন পূর্ণমূল্যে বিকোবে।”
দাবানলের পর জীবনের নতুন লড়াই
আলতাদেনা ও প্যাসিফিক প্যালিসেডসের অনেক পরিবার এখনও অস্থায়ী আবাসে রয়েছেন। কেউ কেউ বীমা সংস্থার সঙ্গে ক্ষতিপূরণ নিয়ে লড়ছেন, আবার কেউ পরিবেশগত পরীক্ষার ফলাফলের অপেক্ষায়।
৭৬ বছর বয়সী অবসরপ্রাপ্ত কার্ল ফ্রম্ম বলেন, “এমন অবস্থায় আগে কখনো পড়িনি—ধীরে ধীরে প্রতিটি পদক্ষেপই নতুনভাবে শিখছি।”
লটারির অর্থ থেকে পুনর্গঠন
কাস্ত্রো ছিলেন মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেওয়া এক সাধারণ তরুণ, যিনি একসময় পড়াশোনার বাধা পেরিয়ে আর্কিটেকচার কনসালট্যান্ট হিসেবে কাজ করছিলেন। তখনই ভাগ্য বদলে যায়—৭৬৮ মিলিয়ন ডলার নগদ তুলে নেন তিনি।
এরপর ক্রয় করেন বিলাসবহুল বাড়ি, পুরোনো পোরশে গাড়ি, এমনকি বাবা-মায়ের জন্যও ৪ মিলিয়ন ডলারের একটি বাড়ি। দুর্ভাগ্যবশত, জানুয়ারির আগুনে সেটিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
সামাজিক বৈচিত্র্যের আশঙ্কা
গত দুই দশকে আলতাদেনার বাড়ির দাম এত বেড়েছে যে অনেক পুরোনো বাসিন্দাই এলাকা ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। বর্তমানে গড় বাড়ির মূল্য প্রায় ১.১৫ মিলিয়ন ডলার।
এলাকাটি একসময় আফ্রিকান-আমেরিকান সম্প্রদায়ের আশ্রয়স্থল ছিল। কিন্তু ক্রমবর্ধমান দামে তাদের উপস্থিতি কমছে। স্থানীয়রা আশঙ্কা করছেন, আগুনের ধ্বংসস্তূপ এই পরিবর্তন আরও ত্বরান্বিত করবে।
জায়ার ক্যালভিন বলেন, “আমাদের বহু প্রজন্মের ঘরবাড়ি যদি এইভাবে হারিয়ে যায়, সেটি ভয় নয়—অভিশাপ।”
তাঁর পরিবার দুটি ঘর হারিয়েছে, এমনকি তাঁর বোন ইভলিনও আগুনে মারা গেছেন। এখন তিনি ভাড়া থাকছেন গ্লেনডেলে, আর মায়ের আশ্রয় একটি নার্সিং হোমে।
বিনিয়োগকারীদের ভিড় ও বাজারের পরিবর্তন
স্থানীয় এজেন্ট তেরেসা ফুলার জানান, আগস্টে আলতাদেনায় মাঝারি দামের সম্পত্তি বিক্রি হয়েছে ৬ লাখ ডলারে—ফেব্রুয়ারির তুলনায় প্রায় ২০% কম। অধিকাংশ লটই এখন বিনিয়োগকারীদের হাতে।
সান ডিয়েগোভিত্তিক নির্মাতা প্রতিষ্ঠান নিউ পয়েন্ট কমিউনিটিজ ১৫টি জমিতে একক বাড়ি নির্মাণ করছে। তাদের মতে, স্থানীয়রা মোটামুটি ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দিচ্ছেন।
‘আলতাদেনা ২.০’: নতুন ভাবনা
আরেক বিনিয়োগকারী, হসপিস ব্যবসায়ী অ্যালেক্স আগাজারিয়ান চারটি পোড়া জমি কিনে সেখানে একক ও বহুতল ভাড়াবাড়ি নির্মাণের পরিকল্পনা করছেন। তিনি বলেন, “এটা হতে পারে এক নতুন সূচনা—‘আলতাদেনা ২.০’। ”
কাস্ত্রো জানালেন, তিনি আর নতুন জমি কিনবেন না। “এটাই যথেষ্ট—দশ বছরের কাজ, জীবনের বড় এক অংশ,” বলেন তিনি।
তবু তাঁর আশা, এই দীর্ঘ যাত্রা শেষে আলতাদেনা আবারও ফিরে পাবে তার আগের রূপ—একটি উষ্ণ, পারিবারিক, ছোট্ট আমেরিকান শহর।
#এডউইন_কাস্ত্রো #পাওয়ারবল #ক্যালিফোর্নিয়া_দাবানল #আলতাদেনা_পুনর্গঠন #যুক্তরাষ্ট্র #সারাক্ষণ_রিপোর্ট