বীরত্বের প্রতীক বিপিন জোশির মৃত্যু নিশ্চিত
দুই বছরের দীর্ঘ অনিশ্চয়তার পর অবশেষে নিশ্চিত হলো নেপালি ছাত্র বিপিন জোশির মৃত্যু। ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের আকস্মিক হামলার সময় সহপাঠীদের প্রাণ বাঁচাতে বীরত্ব দেখানো এই তরুণকে সেদিনই অপহরণ করা হয়েছিল। হামাসের হাতে দুই বছর বন্দি থাকার পর সোমবার রাতে তারা বিপিন জোশির মরদেহ ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করে।
ইসরায়েলে নিযুক্ত নেপালের রাষ্ট্রদূত ধনপ্রসাদ পাণ্ডে গণমাধ্যমকে জানান, “হামাস সোমবার রাতে বিপিন জোশির দেহ ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দিয়েছে। মরদেহ এখন তেল আবিবে নেওয়া হচ্ছে।” ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর মুখপাত্র ইফি ডেফরিনও বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। জোশির দেহ শনাক্তে ডিএনএ পরীক্ষা শেষে তা নেপালে পাঠানো হবে বলে জানা গেছে।
কৃষি প্রশিক্ষণে গিয়ে বন্দি হন নেপালি তরুণ
বিপিন জোশি ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ইসরায়েলে যান কৃষি প্রশিক্ষণ নিতে। গাজা সীমান্তের কাছে কিবুটজ আলুমিম নামে এক কৃষি কমিউনিটিতে ১৬ জন সহপাঠীর সঙ্গে তিনি মাঠ পর্যায়ের কৃষি প্রশিক্ষণে যোগ দেন। কিন্তু প্রশিক্ষণের স্বপ্ন রূপ নেয় বিভীষিকায়, যখন ৭ অক্টোবর সকালে হামাসের যোদ্ধারা আকস্মিক হামলা চালায়।
তারা বাংকারে আশ্রয় নিলে হামাস সদস্যরা সেখানে গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। সেই মুহূর্তে বিপিন নিজের প্রাণের পরোয়া না করে একটি জীবন্ত গ্রেনেড হাতে তুলে বাইরে ছুড়ে ফেলেন, ফলে সহপাঠীদের কয়েকজন প্রাণে রক্ষা পান। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি আহত অবস্থায় হামাস যোদ্ধাদের হাতে বন্দি হন এবং গাজায় নিয়ে যাওয়া হয়।
শেষ দেখা ও পরিবারের সংগ্রাম
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী পরবর্তীতে যে ভিডিও প্রকাশ করে, তাতে দেখা যায় হামাস সদস্যরা বিপিনকে গাজার আল-শিফা হাসপাতালে টেনে নিয়ে যাচ্ছে—এটাই ছিল তার শেষ দৃশ্য। এরপর দুই বছর ধরে তার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
এই সময় তার মা পদ্মা জোশি ও ছোট বোন পুষ্পা একাধিকবার কাঠমান্ডু, ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে তার মুক্তির দাবিতে আবেদন জানান। তারা ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট আইজ্যাক হারজগের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন এবং তেল আবিবের ‘হোস্টেজ স্কয়ার’-এ নিয়মিত বিক্ষোভে যোগ দেন। ২৬ অক্টোবর তার জন্মদিনে তার বয়স হতো ২৫ বছর।
যুদ্ধবিরতির অংশ হিসেবে ফেরত এলো মরদেহ
সোমবার রাতে গাজা যুদ্ধবিরতির চুক্তির অংশ হিসেবে হামাসের আল-কাসসাম ব্রিগেড চারজন মৃত বন্দির নাম প্রকাশ করে—বিপিন জোশি, গাই ইলুজ, যোসি শারাবি ও ড্যানিয়েল পেরেটজ। ওই চুক্তির অধীনে ২০ জন জীবিত জিম্মিকেও মুক্তি দেওয়া হয়, যাদের রেডক্রস ইসরায়েলে নিয়ে আসে।
ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ জানায়, ফরেনসিক ও গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে এখন পর্যন্ত ২৬ জন বন্দিকে আনুষ্ঠানিকভাবে মৃত ঘোষণা করা হয়েছে। বিপিন ছিলেন একমাত্র হিন্দু ও একমাত্র বিদেশি ছাত্র, যাকে এতদিন জীবিত বলে বিশ্বাস করা হচ্ছিল।
নেপাল ও ইসরায়েলে শোক ও শ্রদ্ধা
বিপিন জোশির সাহসিকতার কথা এখন দুই দেশেই শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হচ্ছে। হামলার দিন কিবুটজ আলুমিমে থাকা ১৭ জন নেপালি শিক্ষার্থীর মধ্যে ১০ জন নিহত হন। তাদের মধ্যে একমাত্র বিপিনই বন্দি অবস্থায় জীবিত ছিলেন বলে ধারণা করা হয়।
গত আগস্টে তার পরিবার ইসরায়েলি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বন্দিদের মুক্তির দাবি জানায়। কয়েক সপ্তাহ আগেই তারা বিপিনের বন্দিদশার সময় ধারণকৃত একটি ভিডিও প্রকাশ করেন, যেখানে তাকে মানসিক চাপে কথা বলতে দেখা যায়।
নেপালের প্রধানমন্ত্রী প্রণব আচার্য বিপিনের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে বলেন, “বিপিন জোশি নেপালের সাহসিকতা, ত্যাগ ও মানবতার এক অমর প্রতীক হয়ে থাকবেন।” ইসরায়েলও এই তরুণের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেছে, “তিনি ছিলেন এক সত্যিকারের নায়ক, যিনি জীবন দিয়ে অন্যদের বাঁচিয়েছেন।”
বিপিনের বীরত্ব ইতিহাসে অমর
ইসরায়েল ও নেপালের নাগরিকরা এখন তার বীরত্বকে স্মরণ করছে নানা আয়োজনে। তেল আবিবে ‘হোস্টেজ স্কয়ার’-এ ফুল ও মোমবাতি জ্বালিয়ে তার প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়েছে। তার মরদেহ শনাক্তের পর ইসরায়েলেই পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তার শেষকৃত্যের আয়োজন করা হবে, নেপাল দূতাবাসের সহযোগিতায়।
বিপিন জোশি হয়তো আর ফিরে এলেন না, কিন্তু সহপাঠীদের বাঁচাতে নিজের জীবন উৎসর্গ করা সেই তরুণ এখন দুই জাতির হৃদয়ে অমর হয়ে আছেন।
#বিপিন_জোশি #হামাস #ইসরায়েল #নেপাল #গাজা #অক্টোবর৭ #যুদ্ধবিরতি #মানবতা #বীরত্ব #সারাক্ষণরিপোর্ট