আফগানিস্তানের বিপক্ষে তিন ম্যাচের সিরিজের প্রতিটি ম্যাচেই পরাজিত হয়ে ৩-০ ব্যবধানে হোয়াইটওয়াশ হয়েছে বাংলাদেশ দল। তৃতীয় ও শেষ ম্যাচে পরাজয়ের ব্যবধান ছিল ২০০ রানের।
এই পরাজয়ের মাধ্যমে ওয়ানডে ফরম্যাটে বাংলাদেশের বর্তমান সংকট আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
এই সিরিজে ব্যাটিং, বোলিং এবং ফিল্ডিং- তিন বিভাগেই বাংলাদেশ ছিল ছন্নছাড়া। আফগানিস্তানের বোলাররা নিয়মিত ব্যবধানে উইকেট তুলে নিয়ে বাংলাদেশের ব্যাটিং লাইনআপকে গুঁড়িয়ে দেয়।
তৃতীয় ম্যাচে ২৯৪ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে মাত্র ৯৩ রানে অলআউট হয় টাইগাররা, যা সাম্প্রতিক সময়ের অন্যতম বড় পরাজয়।
দলীয় সমন্বয়ের অভাব, দায়িত্বহীন শট খেলা এবং ব্যাটারদের টেকনিক্যাল দুর্বলতা এই ব্যর্থতার মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে।
শুধু এই সিরিজ নয়, আফগানিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশের পরপর তৃতীয় ওয়ানডে সিরিজ হার এটি।
এর আগে ২০২৩ এবং ২০২৪ সালেও আফগানদের বিপক্ষে বাংলাদেশ পরাজিত হয়েছিল।
এক সময় যাদের বিপক্ষে অন্তত ওয়ানডে ফরম্যাটে বাংলাদেশ সহজেই জয় পেত, সেই আফগানিস্তান এখন বাংলাদেশের জন্য এক কঠিন প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তাদের স্পিন আক্রমণ এবং টপ অর্ডারের ধারাবাহিক পারফরম্যান্স বাংলাদেশের জন্য বড় হুমকি তৈরি করছে।
শেষ ১২টি ওয়ানডে ম্যাচে বাংলাদেশ মাত্র একটি জিততে পেরেছে, যা দলের পারফরম্যান্স গ্রাফের নিন্মমুখী অবস্থানকে তুলে ধরে। এই ১১ হারের মধ্যে আফগানিস্তানের বিপক্ষেই চারটি ম্যাচে হেরেছে বাংলাদেশ।
ধারাবাহিক ব্যর্থতায় ওয়ানডে র্যাংকিংয়েও বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়েছে, বর্তমানে তারা দশম স্থানে অবস্থান করছে। বাংলাদেশ এমনিতে খুব ভালো জায়গায় ছিল না কখনওই কিন্তু ২০১৫ ওয়ানডে বিশ্বকাপের পর থেকে ৭-৮ নম্বর জায়গাতেই ঘুরে ফিরে ছিল ওয়ানডে ক্রিকেটে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই পতন শুধু খেলোয়াড়দের ফর্মের কারণে নয়, বরং টিম ম্যানেজমেন্টের পরিকল্পনার অভাবও বড় কারণ। নিয়মিত দল পরিবর্তন, স্থায়ী অধিনায়কত্বের অভাব, এবং ব্যাটিং অর্ডারে বিভ্রান্তি দলের স্থিতিশীলতা নষ্ট করছে।
নতুন অধিনায়ক মেহেদি হাসান মিরাজের অধীনে ১২ ম্যাচের ১১ টিতেই হেরেছে বাংলাদেশ।
ভরসাযোগ্য ক্রিকেটারদের বিদায় নেয়া, অভিজ্ঞ খেলোয়াড়দের ফর্মহীনতা ও তরুণদের অনভিজ্ঞতাও একসঙ্গে কাজ করছে দলের এই পরিস্থিতির পেছনে।
এই পরিস্থিতিতে দলের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হলো নিজেদের আত্মবিশ্বাস ফিরে পাওয়া এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে দলকে পুনর্গঠন করা।
আফগানিস্তানের বিপক্ষে তিন ম্যাচের সিরিজের প্রতিটি ম্যাচেই পরাজিত হয়ে ৩-০ ব্যবধানে হোয়াইটওয়াশ হয়েছে বাংলাদেশ দল।
বাংলাদেশ শেষ কবে এভাবে টানা হেরেছে?
বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের ওয়ানডে পারফরম্যান্সের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এই দল একদিকে যেমন মাঝে মাঝে বড় দলকে হারিয়ে বিশ্ব ক্রিকেটে চমক দেখিয়েছে, অন্যদিকে ধারাবাহিকতার অভাবে বহুবার টানা পরাজয়ের মুখে পড়েছে।
২০০৭ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপকে বাংলাদেশের ওয়ানডে ক্রিকেট ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ল্যান্ডমার্ক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সেই বিশ্বকাপে ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দলকে হারিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বমঞ্চে নিজেদের শক্তিমত্তার জানান দেয়।
সেই টুর্নামেন্ট থেকেই বাংলাদেশ ওয়ানডে ক্রিকেটে ‘জায়ান্ট কিলার’ পরিচয়ে পরিচিত হতে শুরু করে।
এরপর ২০১১ ও ২০১৫ সালের বিশ্বকাপেও ইংল্যান্ডের মতো দলকে হারিয়ে বাংলাদেশ প্রমাণ করে যে তারা কেবল অনিয়মিত চমক দেখানো দল নয়, বরং একটি শক্তিশালী প্রতিযোগী।
২০১৫ সালের বিশ্বকাপে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো কোয়ার্টার ফাইনাল খেলেছিল।
তবে এই সাফল্যের মাঝেও রয়েছে দুঃসময় ও ধারাবাহিক ব্যর্থতার একাধিক অধ্যায়।
বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সংকটগুলোর একটি দেখা যায় ২০১৪ সালে, যখন দল টানা ১৩ ম্যাচের ১২টিতেই হারে।
এর আগে ২০১০ ও ২০০৭ সালেও বাংলাদেশ পৃথকভাবে টানা ১৪টি ওয়ানডে ম্যাচে পরাজয়ের রেকর্ড গড়েছিল। বাংলাদেশ ওয়ানডে খেলার যোগ্যতা অর্জনের পর প্রথম জয় পেতে ২৩টি ম্যাচ অপেক্ষা করতে হয়েছিল। তার আগে দল টানা ২২ ম্যাচে হেরে যায়, যা নতুন ক্রিকেট খেলুড়ে দেশ হিসেবে খুব একটা চমক দেয়নি।
তবে সবচেয়ে দীর্ঘ হারের ধারা দেখা যায় ১৯৯৯ থেকে ২০০৪ সালের মধ্যে।
সেই সময় বাংলাদেশ টানা ৪৮ ম্যাচে জয়হীন থাকে, যার মধ্যে ৪৫টি ম্যাচে হার এবং ৩টি ম্যাচে কোনো ফলাফল আসেনি।
এ সময়েই বাংলাদেশ টেস্ট স্ট্যাটাস পেলেও মাঠের পারফরম্যান্সে সেই মর্যাদা প্রতিফলিত হয়নি।
এই পরিস্থিতির পেছনে কী কারণ দেখছেন অধিনায়ক ও কোচ
আফগানিস্তানের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজে ব্যাটিং ব্যর্থতাই পরাজয়ের মূল কারণ বলে স্বীকার করেছেন বাংলাদেশের অধিনায়ক মেহেদী হাসান মিরাজ।
তিন ম্যাচের সিরিজে বাংলাদেশ একবারও ৫০ ওভার খেলতে পারেনি, প্রথম ম্যাচে ২২১, দ্বিতীয়তে ১০৯ এবং তৃতীয় ম্যাচে মাত্র ৯৩ রানেই অলআউট হয় দল। মিরাজ বলেন, “আমরা স্বীকার করছি, এই সিরিজে ভালো খেলতে পারিনি। সুযোগ পেয়েও কাজে লাগাতে পারিনি।”
বাংলাদেশ ২০২৫ সালে ৮টি ম্যাচ খেলে ওয়ানডেতে একবারও ২৫০ রান স্পর্শ করতে পারেনি।
এবারের সিরিজে বাংলাদেশ রশিদ খানের বলে ভুগেছে অনেক, রশিদ খানের বলে একের পর এক ব্যাটার আউট হয়ে মিডল অর্ডার ভেঙে পড়ে, তিনি একাই নেন ১১ উইকেট।
ব্যাটারদের দায় নিয়েই মিরাজ বলেন, “যদি রান করতে না পারি, জেতা সম্ভব নয়। শুরু থেকে মাঝ পর্যন্ত সবাইকে দায়িত্ব নিতে হবে।”
তিনি আরও জানান, দল এখন পরের সিরিজের দিকে নজর দিচ্ছে, তবে প্রথম লক্ষ্য হবে ৫০ ওভার টিকে খেলার সক্ষমতা ফিরিয়ে আনা।
এই ভাবনা থেকে বলা যায় বাংলাদেশ আবারও ২০০০ সালের দিকের ভাবনায় ফেরত গিয়েছে, যখন ম্যাচ জয়ের চেয়ে ৫০ ওভার টিকে থাকাকেই স্বার্থকতা ভাবা হতো।
বাংলাদেশ দলের স্পিন বোলিং কোচ ও সাবেক পাকিস্তানি লেগ স্পিনার মুশতাক আহমেদ বলেছেন, আফগান স্পিনার রশিদ খানের ধারাবাহিক লাইন ও লেন্থের পাশাপাশি বাংলাদেশের ব্যাটাররাও ভুল করেছেন, তারা বলের বদলে রশিদের নামকে ভয় পেয়েছে বলছেন তিনি।
মুশতাক বলেন, “রশিদ খুবই অভিজ্ঞ ও ধারাবাহিক। আমাদের বুঝতে হবে, বল খেলতে হয়, বোলারকে নয়। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে মানসিক দৃঢ়তা থাকলে যেকোনো বোলারের বিপক্ষেই খেলা যায়।”
তিনি মনে করেন, বাংলাদেশের মিডল অর্ডার ব্যাটারদের আরও সক্রিয় হতে হবে স্পিনারদের বিপক্ষে। আফগানিস্তান সিরিজে ১১ থেকে ৪০ ওভারের মধ্যে বাংলাদেশ গড়ে ১৮.৭০ রান করেছে, যেখানে আফগানরা করেছে ২৯.৩৭। “আমাদের বাস্তবতা হলো, ব্যাটিং ঠিক করতে হবে। ছেলেরা ভালো ব্যাটার, কিন্তু রশিদের মতো পরিণত স্পিনারদের বিপক্ষে দ্রুত মানিয়ে নিতে হবে,” বলেন মুশতাক।
তার মতে, মিডল ওভারে সিঙ্গেল-ডাবল ঘুরিয়ে স্ট্রাইক রোটেট করতে না পারার কারণেই বাংলাদেশ ব্যর্থ হচ্ছে। “যখন বেশি ডট বল হয়, তখন বড় শট খেলতে গিয়ে উইকেট পড়ে। সিঙ্গেলস-ডাবলস নিতে পারলে চাপটা বোলারের উপর পড়ে, নিজের নয়,” বলেন তিনি।
মুশতাক আরও বলেন, সাম্প্রতিক টি–টোয়েন্টি সাফল্য বাংলাদেশকে আত্মবিশ্বাসী করলেও সেই মানসিকতা ওয়ানডেতে সমস্যা তৈরি করছে।
“টি–টোয়েন্টি থেকে ওয়ানডেতে আসার সময় ব্যাটিংয়ে মানিয়ে নিতে না পারা বড় সমস্যা। ফিল্ডিং, ফিটনেস, বোলিং সব ভালো চলছে, কিন্তু ৫০ ওভারের ব্যাটিং উন্নত করাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।”
২০২৫ সালে বাংলাদেশের হয়ে অন্তত ৫ ম্যাচ খেলা ব্যাটারদের মধ্যে মাত্র ২ জন ৩০ এর বেশি গড়ে ব্যাট করেছেন, তৌহিদ হৃদয় ও জাকের আলি অনিক।
তানজিদ হাসান তামিমের গড় ছিল ২০.৭১, নাজমুল হোসেন শান্তর ১৫, মেহেদি হাসান মিরাজেরও ১৫ গড় চলতি বছর।
মাত্র শেষ হওয়া আফগানিস্তান সিরিজের ৩ ম্যাচ মিলিয়ে বাংলাদেশের কোনও ব্যাটার ১০০ রানও স্পর্শ করতে পারেননি।
তানজিদ হাসান তামিম ২০২৩ সাল থেকে নিয়মিত সুযোগ পেয়ে ২৮ ওয়ানডে খেলে এখনও ২০ গড়েই আটকে আছেন, নাইম শেখ দলে ফিরে করছেন ২৪ বলে ৭ রান।
বিবিসি নিউজ বাংলা