পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে আবারও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের সূচনা হয়েছে। তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) ও আফগান তালেবানকে ঘিরে দীর্ঘদিনের উত্তেজনা নতুন করে বিস্ফোরিত হয়েছে সীমান্তে, যেখানে উভয় পক্ষের সৈন্য নিহত হয়েছে এবং বিমান হামলার পাল্টা প্রতিশোধে পরিস্থিতি দ্রুত অবনতি ঘটেছে।
সংঘাতের নতুন পর্ব
একটি বিপজ্জনক ধারা এখন স্পষ্ট হচ্ছে। পাকিস্তানি তালেবান নামে পরিচিত টিটিপি দেশজুড়ে হামলা বাড়াচ্ছে। এর প্রতিক্রিয়ায় ইসলামাবাদ দাবি করছে, আফগানিস্তানে ক্ষমতাসীন তালেবান যেন টিটিপির আশ্রয়স্থলগুলোতে অভিযান চালায়। কিন্তু আফগান তালেবান তা অস্বীকার করছে। হতাশ হয়ে পাকিস্তান আফগান সীমান্তের ভেতরে বিমান হামলা চালায়, আর এর জবাবে আফগান বাহিনী পাকিস্তানের ওপর পাল্টা আঘাত হানে। এই সহিংস চক্র বারবার ঘটছে—শেষ হয়েও শেষ হয় না।
সবশেষ সহিংসতাটি ছিল সবচেয়ে তীব্র। ১১ অক্টোবর পাকিস্তান-আফগানিস্তানের ২,৬০০ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্তজুড়ে অন্তত সাতটি স্থানে টিটিপি ও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মধ্যে লড়াই ছড়িয়ে পড়ে। উভয়পক্ষের সীমান্তচৌকি দখল হয়ে যায়, গোলাবর্ষণ ও ছোট অস্ত্র ব্যবহার হয়, পাকিস্তান যুদ্ধবিমান মোতায়েন করে। ইসলামাবাদের দাবি, তারা ২০০-রও বেশি টিটিপি সদস্যকে হত্যা করেছে, যদিও নিজেরাও ২০ জনের বেশি সৈন্য হারিয়েছে।

হত্যাকাণ্ড থেকে প্রতিশোধ
এই সংঘাতের সূচনা চার দিন আগের এক টিটিপি হামলা থেকে, যেখানে ১১ পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়, তাদের মধ্যে একজন লেফটেন্যান্ট কর্নেলও ছিলেন। এর প্রতিশোধে পাকিস্তান কাবুলে বিমান হামলা চালায়, লক্ষ্য ছিল টিটিপি নেতা নূর ওয়ালি মেহসুদ। তাঁর কাবুলে অবস্থান ইঙ্গিত দেয় যে টিটিপি ও আফগান তালেবানের সম্পর্ক আরও গভীর হচ্ছে।
১৫ অক্টোবর, পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় টিভিতে কাবুলে নতুন হামলার দাবি প্রকাশের পর সীমান্তে আবারও লড়াই শুরু হয়। পরে ৪৮ ঘণ্টার একটি অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হয়। পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ সতর্ক করে বলেন, “সংঘর্ষ যেকোনো সময় আবার শুরু হতে পারে।”
পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সংকট
পাকিস্তানের ক্ষোভের যথেষ্ট কারণ আছে। স্থানীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজ জানিয়েছে, ২০২৫ সালে এখন পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা গত বছরের তুলনায় বেশি, আর ২০২৪ সালই ছিল গত দশকের সবচেয়ে রক্তাক্ত বছর। বর্তমানে সহিংসতা মূলত খাইবার পাখতুনখোয়ার দক্ষিণাঞ্চল ও সাবেক উপজাতি এলাকায় কেন্দ্রীভূত। তবে টিটিপি নেতৃত্বের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের হামলা সংগঠনটিকে আরও ভয়াবহ প্রতিশোধমূলক হামলার পথে ঠেলে দিতে পারে।
স্টিমসন সেন্টারের বিশ্লেষক এলিজাবেথ থ্রেলকেল্ডের মতে, “এটি টিটিপিকে শহরাঞ্চলের বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুতে নজর দিতে প্ররোচিত করতে পারে।” ২০০৭ থেকে ২০১৪ সালের ভয়াবহ জঙ্গি হামলার স্মৃতি আবারও জেগে উঠতে পারে। যদি সহিংসতা শহরে ছড়িয়ে পড়ে, পাকিস্তান হয়তো আফগান ভূখণ্ডে আরও গভীর হামলায় যেতে বাধ্য হবে।

আন্তর্জাতিক উদ্বেগ
সহিংসতার আশঙ্কায় মিত্র দেশগুলো ইতিমধ্যে হস্তক্ষেপ শুরু করেছে। সৌদি আরব ও কাতার দুই দেশকেই সংলাপের আহ্বান জানিয়েছে। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, “চীন পাকিস্তান-আফগানিস্তান সম্পর্ক উন্নয়নে গঠনমূলক ভূমিকা রাখতে প্রস্তুত।”
কিন্তু নতুন জটিলতাও দেখা দিয়েছে। সাম্প্রতিক লড়াইয়ের বেশিরভাগ সংঘটিত হয়েছে পূর্ব আফগানিস্তানের হাক্কানি নেটওয়ার্কের ঘাঁটিতে—যারা দীর্ঘদিন পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিল। এখন পাকিস্তান অভিযোগ করছে, হাক্কানি নেটওয়ার্ক দ্বিমুখী আচরণ করছে।
রাজনীতি ও কূটনীতির বিভাজন
দেশীয় রাজনীতি পরিস্থিতিকে আরও জটিল করছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মুখপাত্র আহমেদ শরিফ চৌধুরী খাইবার পাখতুনখোয়ার প্রাদেশিক সরকার—যা ইমরান খানের পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই)-এর নেতৃত্বাধীন—তাদের “নিরাপত্তার জন্য আফগানিস্তানের কাছে ভিক্ষা চাওয়া” বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন।
অন্যদিকে, যখন সীমান্তে গুলি বিনিময় চলছে, তখন আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি ছিলেন ভারতের ছয় দিনের সফরে। ভারত ঘোষণা করেছে, তারা কাবুলে ২০২১ সালে বন্ধ হয়ে যাওয়া তাদের দূতাবাস আবার খুলবে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণমাধ্যম শাখা এই সময়কে “উদ্বেগজনক” হিসেবে উল্লেখ করেছে এবং বলেছে, সীমান্তে লড়াই এমন সময়ে হচ্ছে যখন ভারত—যাকে তারা “অঞ্চলের সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসের পৃষ্ঠপোষক”—আফগানিস্তানের সঙ্গে নতুন সম্পর্ক গড়ছে।

পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে এই সংঘর্ষ কেবল সীমান্তের লড়াই নয়; এটি গভীর রাজনৈতিক, নিরাপত্তা ও কূটনৈতিক বিরোধের প্রতিচ্ছবি। ইতিহাস যেমন দেখিয়েছে, তালেবান ও টিটিপি—দুই পক্ষের জটিল সম্পর্ক দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতার জন্য আবারও এক বড় হুমকি হয়ে উঠছে।
#
পাকিস্তান, আফগানিস্তান, টিটিপি, তালেবান, সীমান্ত সংঘর্ষ, কাবুল, খাইবার পাখতুনখোয়া, হাক্কানি নেটওয়ার্ক, চীন, সৌদি আরব, কাতার, ইমরান খান, দক্ষিণ এশিয়া, নিরাপত্তা সংকট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















