বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের আর্থিক স্বাস্থ্য উদ্বেগজনকভাবে অবনতি হয়েছে। ২০২৫ সালের জুন প্রান্তিকে দেশের সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংকগুলোর সম্মিলিত পুঁজির ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি— যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
দ্রুত বেড়েছে পুঁজির ঘাটতি
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যে দেখা যায়, মার্চ প্রান্তিকে ঘাটতি ছিল ১ লাখ ১০ হাজার ২৬০ কোটি টাকা। মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে এই ঘাটতি ৪৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি বেড়েছে। বর্তমানে ৬১টি তফসিলি ব্যাংকের মধ্যে ২৪টি বাধ্যতামূলক ন্যূনতম পুঁজি বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে সার্বিকভাবে দেশের আর্থিক স্থিতিশীলতা মারাত্মক চাপে পড়েছে।
সংকটের মূল কারণ: অ-পরিশোধিত ঋণ (এনপিএল)
অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংক বিশ্লেষকদের মতে, ব্যাংকগুলোর ক্রমবর্ধমান অ-পরিশোধিত ঋণ বা এনপিএলই এ সংকটের প্রধান কারণ। ব্যাংকগুলো যখন ঋণ আদায়ে ব্যর্থ হয়, তখন আইন অনুযায়ী তাদেরকে ভবিষ্যৎ ক্ষতির জন্য একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ সংরক্ষণ করতে হয়, যাকে “প্রভিশনিং” বলা হয়। কিন্তু অনেক ব্যাংক এই সংরক্ষণ বাধ্যবাধকতা পূরণ করতে না পারায় তাদের মূলধন সরাসরি ক্ষয় হচ্ছে।
রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর উন্মোচিত অনিয়ম
সম্প্রতি রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর বহু গোপন অনিয়ম ও দুর্বলতা প্রকাশ্যে এসেছে। এর ফলে অ-পরিশোধিত ঋণের পরিমাণ রেকর্ড হারে বেড়েছে এবং একই সঙ্গে ব্যাংকগুলোর পুঁজির ভিত্তি মারাত্মকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে।
কোন ব্যাংকগুলো সবচেয়ে ঝুঁকিতে
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুসারে, ২৪টি ঘাটতিগ্রস্ত ব্যাংকের মধ্যে রয়েছে—
- রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক (SOCBs): কৃষি ব্যাংক ২৯,১৬১ কোটি, জনতা ব্যাংক ১৭,০২৫ কোটি, অগ্রণী ব্যাংক ৭,৬৯৮ কোটি, রূপালী ব্যাংক ৪,১৭৩ কোটি, বেসিক ব্যাংক ৩,৭৮৩ কোটি এবং রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক ২,৬২০ কোটি টাকা ঘাটতিতে রয়েছে।
- বেসরকারি ও শরিয়াভিত্তিক ব্যাংক (PCBs): ইউনিয়ন ব্যাংক (শরিয়াহ) ২১,৩৮৭ কোটি, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ ১৮,৫০৪ কোটি, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ১০,৫০১ কোটি, ন্যাশনাল ব্যাংক ৮,৪৫৯ কোটি, এবি ব্যাংক ৬,৭৭৫ কোটি, পদ্মা ব্যাংক ৫,৬১৯ কোটি এবং আইএফআইসি ব্যাংক ৪,০৫১ কোটি টাকার ঘাটতিতে রয়েছে।
- নতুনভাবে ঘাটতির তালিকায় যুক্ত: এনআরবিসি ব্যাংক ৩১৬ কোটি এবং আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক ২৫৪ কোটি টাকার ঘাটতিতে পড়েছে।
নিয়ন্ত্রক মানদণ্ড পূরণে ব্যর্থতা
বেসেল-থ্রি কাঠামো অনুযায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংক নির্ধারণ করেছে যে প্রতিটি তফসিলি ব্যাংককে ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে ন্যূনতম ১২.৫ শতাংশ মূলধন অনুপাত (CRAR) বজায় রাখতে হবে। এছাড়া, ব্যাংকগুলোকে ধীরে ধীরে ২০২৬ সালের মধ্যে ন্যূনতম ৪ শতাংশ লিভারেজ অনুপাত (LR) অর্জন করতে হবে।
কিন্তু বর্তমানে ১.৫৫ লাখ কোটি টাকার পুঁজি ঘাটতি ইঙ্গিত দিচ্ছে— বহু ব্যাংক এই মূল নিয়ন্ত্রক মানদণ্ড পূরণে অক্ষম। এটি ব্যাংকিং খাতের কাঠামোগত দুর্বলতা ও শাসনব্যবস্থার গভীর সংকটের প্রতিফলন।
অর্থনীতির জন্য সতর্ক সংকেত
দুর্বল মূলধনভিত্তি শুধু ব্যাংকের ক্ষতি সামলানোর ক্ষমতাকে হ্রাস করে না, বরং এটি শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ বিতরণ, বৈদেশিক ব্যাংকের সঙ্গে কার্যকর লেনদেন এবং বিনিয়োগ প্রবাহের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। অর্থনীতিবিদদের মতে, যদি দ্রুত সংস্কার ও সুশাসন নিশ্চিত না করা হয়, তবে এ সংকট দেশের সার্বিক আর্থিক ব্যবস্থাকে বিপন্ন করে তুলতে পারে।
# বাংলাদেশ_ব্যাংক, ব্যাংকিং_খাত, অ-পরিশোধিত_ঋণ, পুঁজি_ঘাটতি, অর্থনীতি, সারাক্ষণ_রিপোর্ট