জ্বালানি নিরাপত্তা বনাম কড়া সবুজ নীতির দ্বন্দ্ব
ইউরোপীয় ইউনিয়নের নতুন করপোরেট টেকসই আইন নিয়ে অনিশ্চয়তা যত বাড়ছে, কাতার তত জোরে এর সমাধানের জন্য সময়সীমা বেঁধে দিতে চাইছে। দেশটির জ্বালানি মন্ত্রী স্পষ্ট জানিয়েছেন, বছরের শেষের মধ্যে ইউরোপকে ব্যবসায়ীদের উদ্বেগ দূর করার বাস্তব পথ দেখাতে হবে, নইলে দীর্ঘমেয়াদি গ্যাস চুক্তিগুলো ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে। ইইউর করপোরেট সাসটেইনেবিলিটি ডিউ ডিলিজেন্স ডিরেক্টিভ বৃহৎ কোম্পানিগুলোকে তাদের সরবরাহ শৃঙ্খলে মানবাধিকার ও পরিবেশগত ঝুঁকি শনাক্ত ও ব্যবস্থাপনার বাধ্যবাধকতা দেয়। ইউরোপীয় গ্যাস আমদানিকারকরা উদ্বেগ প্রকাশ করছে—কাতারসহ তৃতীয় দেশের সঙ্গে করা চুক্তি ও যৌথ বিনিয়োগে এই আইন কীভাবে প্রযোজ্য হবে, তার স্পষ্টতা এখনও নেই। দোহা প্রকাশ্যে অসন্তোষ জানিয়ে এমনকি ইঙ্গিত দিয়েছে, আইনকে যদি অযৌক্তিক বা অতিরিক্ত চাপ হিসেবে মনে হয়, তাহলে গ্যাস সরবরাহ পুনর্বিবেচনা করতে হবে—যা ইউক্রেন যুদ্ধের পর কাতারি এলএনজির ওপর ইউরোপের বাড়তি নির্ভরতার প্রেক্ষাপটে স্পষ্ট রাজনৈতিক বার্তা।

ইইউর জন্য এই অচলাবস্থা আরও বড় এক বাস্তবতা সামনে আনে: জলবায়ু নীতিতে নেতৃত্বের দাবি আর বাস্তব জ্বালানি নিরাপত্তার প্রয়োজনের মধ্যে ফাঁক। কাগজে কলমে ব্রাসেলস চাইছে কঠোর পরিবেশ নিয়মের মাধ্যমে বিশ্বকে পথ দেখাতে, অথচ একই সঙ্গে শিল্প প্রতিযোগিতা ও জ্বালানি সরবরাহের নিরাপত্তাও রক্ষা করতে হচ্ছে। ইইউভুক্ত বহু কোম্পানি জানাচ্ছে, নির্দিষ্ট ও স্বচ্ছ মানদণ্ড থাকা ভালো, কিন্তু একই সঙ্গে ব্রাসেলস ও জাতীয় সরকারের নানা নিয়ম একত্রে মেনে চলা ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ। জলবায়ু আন্দোলনকারীরা এর উল্টো অবস্থানে; তারা বলছে, যদি শক্তিশালী রপ্তানিকারক দেশের চাপের মুখে আইন নরম করা হয়, তবে বার্তাটা যাবে—সবুজ নীতির চেয়ে জ্বালানি রাজনীতিই শেষ কথা। পরবর্তী কয়েক সপ্তাহে আলোচনার ফলেই বোঝা যাবে, ইইউ কতটা দূর পর্যন্ত যেতে প্রস্তুত, যখন পরিবেশগত ভাবমূর্তির বিপরীতে দাঁড়িয়ে আছে বাস্তব গ্যাসের সরবরাহ।
সবুজ রূপান্তর ও বাজারের বাস্তবতা
কাতারের চাপের কৌশল এমন সময়ে সামনে এল যখন বৈশ্বিক গ্যাস বাজার এখনো টানটান, আর ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের কাছেই বহু বছরের চুক্তি আবার আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে। মূল্যবৃদ্ধি ও ঘাটতির অভিজ্ঞতায় ভোগা ইউরোপীয় ইউটিলিটিগুলো ২০৩০-এর পর পর্যন্ত সরবরাহ নিশ্চিত করতে পর্যায়ক্রমে নতুন চুক্তি করেছে, যার বড় অংশই কাতারের আসন্ন এলএনজি প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত। নতুন আইন নিয়ে অনিশ্চয়তা দীর্ঘায়িত হলে সেই প্রকল্পগুলোর অর্থায়ন ও চূড়ান্ত বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত উভয়ই জটিল হয়ে উঠতে পারে। বিশ্লেষকদের মতে, উচ্চাভিলাষী ডিকার্বনাইজেশন পরিকল্পনা থাকলেও বাস্তবতায় ইউরোপের গ্যাস প্রয়োজন আরও বহু বছর টিকে থাকবে—কয়লা থেকে বেরিয়ে আসা, নবায়নযোগ্য জ্বালানি বাড়ানো এবং পর্যাপ্ত স্টোরেজ গড়ে তুলতে এই সময়ের গ্যাস অপরিহার্য সেতুবন্ধন।

অন্যদিকে ভোটারদের বিদ্যুৎ ও গ্যাস বিলের চাপ, আর শিল্পখাতে প্রতিযোগিতা হারানোর আশঙ্কা—দুটোর মাঝেই পড়েছে সরকারগুলো। ফলে নীতিনির্ধারকরা এমন পথ খুঁজছেন, যেখানে বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত না করেও কোম্পানিগুলোকে নির্গমন কমাতে ও সরবরাহ শৃঙ্খলা সম্পর্কে আরও স্বচ্ছ হতে বাধ্য করা যায়। দোহা থেকে আসা কঠোর মন্তব্য ইইউর ভেতরে তাদেরই অবস্থানকে শক্ত করতে পারে, যারা নতুন আইন প্রয়োগে বেশি নমনীয় নির্দেশিকা ও বাস্তবসম্মত সময়সীমার পক্ষে যুক্তি দিচ্ছেন। তবে একই সঙ্গে এটি মনে করিয়ে দেয়, জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল পৃথিবীতে জলবায়ু নীতি কখনোই কেবল বৈজ্ঞানিক আলোচনার বিষয় নয়; এটি শক্তি রাজনীতি ও কূটনৈতিক দরকষাকষির অংশ। এই দ্বন্দ্বের ফল নির্ধারণ করবে, ইউরোপ ভবিষ্যতে কতটা কঠোরভাবে তার সবুজ নিয়মের পক্ষে দাঁড়াতে পারে, যখন বিপরীতে থাকে কৌশলগত জ্বালানি সরবরাহকারীর হিসাব।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















