গ্রামের ফাঁকা হয়ে যাওয়া জমি আর বাড়ছে সংঘর্ষের ঝুঁকি
এপ্রিলের পর থেকে জাপানে ভাল্লুকের আক্রমণে নিহত ও আহত মানুষের সংখ্যা প্রায় ২৩১–এর ঘরে পৌঁছেছে, যা দেশটির জন্য নতুন এক রেকর্ড। উত্তর থেকে মধ্য জাপানের বিভিন্ন প্রিফেকচারে কৃষিজমি, পাহাড়ি গ্রাম ও শহরতলির পাশে এই সমস্ত হামলার ঘটনা ঘটছে। বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রাকৃতিক খাদ্য কমে যাওয়া, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, এবং ক্রমশ ফাঁকা হয়ে যাওয়া গ্রামীণ এলাকা—এই তিনটি কারণই ভাল্লুককে মানুষের বসতি এলাকার আরও কাছাকাছি টেনে আনছে। বহু জায়গায় দেখা যাচ্ছে, কালো ভাল্লুক দিনের আলোতেও ছোট শহরের ভেতর ঢুকে পড়ছে, বাড়ির উঠানে ফলের গাছ কিংবা খোলা ডাস্টবিন থেকে খাবার খুঁজে নিচ্ছে। এর ফলে স্থানীয় সরকারগুলো দ্রুত সতর্কবার্তা প্রচারের স্পিকার বসানো, ফাঁদ পাতা এবং বাসিন্দাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার মতো পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে।

এই পরিস্থিতি পুরোনো বিতর্কও নতুন করে উসকে দিয়েছে—কতটা শিকার অনুমতি দেওয়া উচিত এবং কতটা সংরক্ষণ প্রাধান্য পাবে। অতীতে কঠোর নিয়ন্ত্রণের ফলে অনেক এলাকায় ভাল্লুকের সংখ্যা কমে গিয়েছিল; পরবর্তীতে কিছু সুরক্ষামূলক নীতির পর তাদের সংখ্যা ধীরে ধীরে বেড়েছে। এখন আবার গ্রামবাসীরা আরও বেশি শিকারের দাবি তুলছে, তারা বলছে—প্রাণ বাঁচানোই আগে। সংরক্ষণবাদীরা পাল্টা যুক্তি তুলে ধরছেন, কেবল শিকার বাড়িয়ে সমস্যার মূলে পৌঁছানো যাবে না; এতে অনেক অঞ্চলে স্থানীয় ভাল্লুক প্রজাতিই বিলুপ্ত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হবে। তাদের মতে, বনজ ফলন, পাহাড়ি উদ্ভিদকুল ও জমি ব্যবস্থাপনার দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তন না বুঝে কেবল গুলি চালিয়ে নিরাপত্তা আনা সম্ভব নয়। জাতীয় সরকারকে এখন চাপের মুখে পড়ে বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা হালনাগাদ, তথ্য সংগ্রহ বাড়ানো এবং স্থানীয় প্রশাসনকে বেশি আর্থিক সহায়তা দেওয়ার বিষয়গুলো নিয়ে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে।
নিরাপত্তা, সংস্কৃতি ও প্রকৃতি—তিন দিকের ভারসাম্যের লড়াই
সংখ্যার হিসাবের বাইরে এই সংকট গ্রামাঞ্চলের মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপনেও বড় প্রভাব ফেলছে। অনেক কৃষক এখন ভোরবেলা একা মাঠে যাওয়া এড়িয়ে চলেন, সন্ধ্যার পর পাহাড়ি পথ ধরে হাঁটা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। স্কুলগামী শিশুদের দলবেঁধে, অভিভাবক বা স্বেচ্ছাসেবকের তত্ত্বাবধানে যাতায়াত করানো হচ্ছে, ঝোপজঙ্গল কেটে পথ পরিষ্কার রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পর্যটন নির্ভর এলাকাগুলো নতুন নিরাপত্তা নির্দেশিকা, স্পষ্ট সাইনবোর্ড আর গাইডেড হাইকিংয়ের মাধ্যমে ভ্রমণকারীদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছে। একই সঙ্গে পাহাড়ি অঞ্চলে ভাল্লুককে ঘিরে দীর্ঘদিনের সাংস্কৃতিক কল্পনা—ভয়ঙ্কর হলেও সম্মানিত প্রাণী হিসেবে—এখন ছোটদের চোখে নতুনরকম আতঙ্ক হয়ে উঠছে। ফেসবুক ভিডিও ও টেলিভিশনের জরুরি খবরই এখন অনেকের কাছে ‘ভাল্লুক’ শব্দের প্রথম ছবি আঁকে।

কমিউনিটি পর্যায়ে বিভিন্ন সভা-সমাবেশে মানুষকে শেখানো হচ্ছে কিভাবে খাবারের আবর্জনা সুরক্ষিত রাখা যায়, ফলগাছের যত্ন নেওয়া যায়, আর বনে গেলে বা গ্রাম–পাহাড়ের সীমানায় হাঁটতে গেলে সতর্কতার জন্য ঘণ্টি বা আওয়াজ তৈরির ছোট যন্ত্র সঙ্গে রাখা যায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই বছরের রেকর্ড মূলত এক ধরনের সতর্ক সংকেত—ভবিষ্যতের নতুন বাস্তবতার ইঙ্গিত। জনসংখ্যা কমে যাওয়া এবং বয়স্ক মানুষের অনুপাত বেড়ে যাওয়ায় অনেক গ্রামই আধা-পরিত্যক্ত; ফাঁকা বাড়ি আর অনাবাদী জমি বন্যপ্রাণীর চলাফেরার জন্য এক ধরনের করিডর খুলে দিচ্ছে। জলবায়ুর ওঠানামায় কখনো বেশি, কখনো কম ফলন হওয়ায় পাহাড়ি বনে খাবার ঘাটতি দেখা দিলে ভাল্লুকরা আরও নিচে নেমে আসছে। দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের পথে এখন আলোচনা হচ্ছে প্রাকৃতিক আবাসস্থল পুনরুদ্ধার, বনজ বৃক্ষের বৈচিত্র্য বাড়ানো, এবং স্থানীয় রিপোর্টিংয়ের সঙ্গে সেন্সর নেটওয়ার্ক মিলে আগাম সতর্কতা জোরদার করার মতো উদ্যোগ নিয়ে। নীতিনির্ধারকদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ—গ্রামীণ মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি এমন ব্যবস্থা করা, যাতে জাপানের পাহাড়ি প্রকৃতির নিজস্ব প্রাণবৈচিত্র্যও টিকে থাকতে পারে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















