তাইওয়ানের পূর্বাঞ্চল এখনো তুলনামূলকভাবে অপরিচিত এক পর্যটন গন্তব্য, যেখানে রয়েছে পাহাড়, নদী, জলপ্রপাত, হট স্প্রিং এবং ঘন সবুজ অরণ্যের এক মনোমুগ্ধকর মিশ্রণ। পশ্চিমের ব্যস্ত শহরজীবন থেকে ভিন্ন, এই অঞ্চল প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের এক নিবিড় সংলাপের স্থান।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রথম সাক্ষাৎ
ইউশান ন্যাশনাল পার্কে প্রবেশের মুহূর্তেই প্রকৃতির সুর শুনতে পাওয়া যায়। এক স্যাক্সোফোনবাদক পাহাড়ের কোলে সুর তুলছেন, পাশে ছায়া দিচ্ছে ঘন সবুজ বন। হাঁটাপথে ওয়ালামি ট্রেইলে পা বাড়ালে শোনা যায় ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, পাতার খসখস শব্দ আর দূরের জলপ্রপাতের ধ্বনি। পর্যটকেরা এখানে খুব কম, আর যারা আসে তারা খুঁজে পায় মুন্টজ্যাক হরিণ বা রক মাকাকের মতো দুর্লভ প্রাণী। ঝুলন্ত সেতু পার হওয়ার সময় মনে হয়, সভ্যতার কোলাহল অনেক দূরে রয়ে গেছে।
শহরের কাছে অথচ প্রকৃতির কোলে
এই ট্রেইলহেডের অবস্থান তাইওয়ানের হুয়ালিয়েন শহর থেকে মাত্র অল্প দূরে, যেখানে প্রায় এক লাখ মানুষ বাস করে। রাজধানী তাইপেই থেকে কয়েক ঘণ্টার ট্রেনে পৌঁছে যাওয়া যায় এই অঞ্চলটিতে। স্থানীয় ট্যুর কোম্পানির সহ-প্রতিষ্ঠাতা মাইকেল ম্যাকক্রিশ বলেন, “তাইওয়ানের প্রায় ৭০ শতাংশ এলাকা বন ও পাহাড়ে ঢাকা, কিন্তু পশ্চিমা পর্যটকদের কাছে এখনো তাইওয়ান এক শিল্পনগরী হিসেবেই পরিচিত।”
পূর্ব উপকূলে হাইকিং, সাইক্লিং, সার্ফিং, ডাইভিং বা ক্যানিয়নিং— সবই সম্ভব। তার দাবি, “এই দিকেই তাইওয়ানের প্রকৃত সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে।”
রোমাঞ্চকর এক সপ্তাহের যাত্রা
ভ্রমণ শুরু হয়েছিল তাইতুং থেকে, সেখান থেকে ট্রেন ও গাড়িতে যাত্রা করে তাইপেই পর্যন্ত। ইউলির ঐতিহাসিক হট স্প্রিং-এ গোসল, তারোকো ন্যাশনাল পার্কের পাহাড় কেটে যাওয়া রাস্তা, কিংবা চিশাং গ্রামের সবুজ ধানক্ষেতে সাইকেল চালানো— প্রতিটি মুহূর্তেই প্রকৃতি যেন ভ্রমণকারীর সঙ্গী। স্থানীয় গাইড মার্ক পেমবার্টন বলেন, “তাইওয়ানে আসা অনেকেই জানেন না, তাদের জন্য কতটা চমক অপেক্ষা করছে।”
পর্যটনের চ্যালেঞ্জ ও সীমাবদ্ধতা
তাইওয়ানের পর্যটনে এখনো বড় অংশই আসে এশিয়ার ভেতর থেকে। ২০১৯ সালে যেখানে রেকর্ড ১ কোটি ১৯ লাখ পর্যটক এসেছিলেন, বর্তমানে সেই সংখ্যা অনেক কম। চীনের সঙ্গে রাজনৈতিক উত্তেজনা এবং কোভিড-পরবর্তী বিধিনিষেধের প্রভাব এখনো কাটেনি।
২০২২ সালে সীমান্ত খুলে দেওয়ার পর পর্যটনের পুনরুদ্ধার শুরু হয়েছে— শুধু এ বছরের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্তই প্রায় ৩৫ লাখ পর্যটক এসেছে, যা গত বছরের তুলনায় ১১ শতাংশ বেশি। যুক্তরাষ্ট্র এখন তাইওয়ানের সবচেয়ে বড় বিদেশি পর্যটন উৎস, এবং তাইওয়ানের এয়ারলাইনগুলো যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শহরগুলোর সঙ্গে সরাসরি ফ্লাইট চালু করছে।
ভূমিকম্প ও ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চল
২০২৪ সালের এপ্রিলে এক শক্তিশালী ভূমিকম্প পূর্ব উপকূলের বড় অংশে ধ্বংস ডেকে আনে। তারোকো ন্যাশনাল পার্কের একাধিক পথ এখনো বন্ধ, ধসে পড়া পাহাড়ের চিহ্ন দেখা যায় সর্বত্র। গত মাসে এক ঘূর্ণিঝড় হুয়ালিয়েন অঞ্চলে বন্যা সৃষ্টি করে, অন্তত ১৮ জনের মৃত্যু ঘটে।
স্থানীয় ট্যুর কোম্পানিগুলোর মতে, এই পরিস্থিতিতে পর্যটকদের আগ্রহ কমে গেছে। তবু কেউ কেউ এখনো পার্কের বিলাসবহুল হোটেল সিল্কস প্লেস তারোকোতে থাকছেন, যা জানুয়ারিতে পুনরায় খোলা হয়েছে।
নীরব বিলাস ও পুনর্জীবন
হোটেলের ছাদে পাহাড়ের দিকে মুখ করে গরম জলে ডুব দেওয়া যেন আকাশে ভাসার মতো অনুভূতি দেয়। স্থানীয় ফল যেমন রোসেল, পোমেলো আর ‘হোয়াইট ওয়াটার স্নোফ্লেক’ দিয়ে তৈরি খাবার অতিথিদের আকর্ষণ করে।
হোটেল মুখপাত্র সানি শিয়েহ বলেন, “ভূমিকম্পের পর আমরা অতিথিদের জন্য এক নতুন ধরনের অভিজ্ঞতা তৈরি করেছি— যেখানে থাকা মানেই সুস্থতা ও প্রশান্তির যাত্রা।” তবে এখনো হোটেলের দখল হার ২৪ শতাংশের নিচে, যা মহামারির আগে ছিল ৬০ শতাংশের বেশি।
ভ্রমণের শেষ প্রান্তে তাইপেই
ক্যাব ও ট্রেনে নির্ভর ভ্রমণ সীমিত হলেও পথের দৃশ্য ছিল মনোমুগ্ধকর— মেঘে মোড়ানো পাহাড়, সমান্তরাল ধানক্ষেত আর নির্জন গ্রাম। হুয়ালিয়েনে সাইকেলে চেপে কিশিংতান সৈকতে যাওয়ার পথে দেখা যায় জার্মান খাবারের দোকান, কফি আর ছাগলের দুধের লাটের মিশ্রণ এক অদ্ভুত স্বাদ এনে দেয়।
তাইপেই পৌঁছে শহরের ব্যস্ত জীবনে ফিরেও প্রকৃতির ছোঁয়া হারায় না ভ্রমণকারীরা। আধুনিক হোটেল, নাইট মার্কেট, চা ও ঐতিহ্যবাহী খাবারের গন্ধে মিশে থাকে শহুরে উষ্ণতা।
বৈচিত্র্যের দ্বীপ
ভ্রমণ বিশেষজ্ঞ কোর লিউ বলেন, “তাইওয়ানের সৌন্দর্য এর বৈচিত্র্যে— একদিনেই পাহাড়, সমুদ্র আর শহুরে জীবন উপভোগ করা সম্ভব।” কিন্তু দুঃখজনকভাবে, পর্যটন প্রচারণায় এখনো এই বৈচিত্র্য যথাযথভাবে তুলে ধরা হয় না।
শেষ দিনে, লেখক আবার প্রকৃতির খোঁজে ইয়াংমিংশান ন্যাশনাল পার্কে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন, কিন্তু প্রবল বৃষ্টিতে তা ভেস্তে যায়। বদলে স্থানীয় এক নাস্তার দোকানে সয়া মিল্ক আর গরম ‘শিয়াও লং বাও’ খেয়ে তিনি উপসংহারে লেখেন— “তাইওয়ান এমন এক দেশ, যেখানে প্রকৃতি ও সংস্কৃতি একসঙ্গে নাস্তার টেবিলেও বসে।”
#তাইওয়ান,# ইউশান ন্যাশনাল পার্ক,# তারোকো, #পূর্ব উপকূল, #এশিয়ার পর্যটন, #প্রকৃতি# ভ্রমণ, #ভূমিকম্প,# হুয়ালিয়েন,# সিল্কস প্লেস,# সারাক্ষণ রিপোর্ট