২০২৬ সালের নভেম্বরে সর্বনিম্ন উন্নত দেশ (এলডিসি) তালিকা থেকে উত্তরণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ এক ঐতিহাসিক মাইলফলকে পৌঁছাতে যাচ্ছে। তবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পরিষদ–বাংলাদেশ (আইসিসিবি) এর সর্বশেষ ত্রৈমাসিক নিউজ বুলেটিন (জুলাই–সেপ্টেম্বর ২০২৫) অনুযায়ী, এই অর্জনের সঙ্গে আসছে গভীর কাঠামোগত সংস্কার, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি ও প্রতিযোগিতা জোরদারের বড় চ্যালেঞ্জও।
তিনটি জাতিসংঘ সূচকে সাফল্য
“এলডিসি উত্তরণ: সামনে চ্যালেঞ্জ” শিরোনামের সম্পাদকীয়তে বলা হয়, বাংলাদেশ জাতিসংঘের তিনটি সূচক—প্রতি মাথাপিছু মোট জাতীয় আয়, মানবসম্পদ সূচক এবং অর্থনৈতিক ঝুঁকি সূচকে—যোগ্যতা অর্জন করেছে। এটি গত পাঁচ দশকের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সামাজিক অগ্রগতির প্রতিফলন।
তবে আইসিসিবি সতর্ক করে দিয়েছে, উত্তরণ কোনো সমাপ্তি নয়; বরং এটি “একটি অধিক চাহিদাসম্পন্ন নতুন অধ্যায়ের সূচনা।”
রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক চাপ
২০২৪ সালের জুলাইয়ের রাজনৈতিক অস্থিরতার পর বাংলাদেশকে উচ্চ বৈদেশিক ঋণ, মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা হ্রাসসহ নানা অর্থনৈতিক চাপে পড়তে হয়েছে। আইসিসিবির বিশ্লেষণে বলা হয়, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কারণে সরবরাহ চেইন ও উৎপাদন ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, বিশেষ করে বস্ত্র, লজিস্টিকস ও সেবা খাতে।
ফলে উৎপাদন ব্যাহত, চালান বিলম্বিত এবং রপ্তানি আয় হ্রাস পেয়েছে; একই সঙ্গে ঋণ পরিষেবার ব্যয়ও বেড়েছে।
রপ্তানি সুবিধা হারানোর আশঙ্কা
উত্তরণের পর সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হলো ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার মতো বাজারে শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত সুবিধা ধীরে ধীরে হারানো। তৈরি পোশাক খাত, যা দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশের বেশি জোগান দেয়, সেখানে ১০–১২ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপের ঝুঁকি তৈরি হবে। এতে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা অনেক কমে যেতে পারে।
আইসিসিবি উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, বাজার বৈচিত্র্যকরণ ও উচ্চমূল্যের পোশাক পণ্যে রূপান্তরের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছে।
বৈশ্বিক বাণিজ্যের নতুন বাস্তবতা
সম্পাদকীয়তে বলা হয়, বৈশ্বিক বাণিজ্যের কাঠামো দ্রুত বদলে যাচ্ছে। বাড়ছে সুরক্ষাবাদ, কঠিন মানদণ্ড ও অশুল্ক বাধা—যেমন কার্বন বর্ডার ট্যাক্স ও যথাযথ পর্যালোচনা আইন। এসব পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে “দায়িত্বশীল ও উদ্ভাবনী উৎপাদনকেন্দ্র” হিসেবে নিজেদের অবস্থান পুনর্নির্ধারণ করতে হবে, যেখানে স্থায়িত্ব, স্বচ্ছতা ও শ্রমমানের প্রতি প্রতিশ্রুতি থাকবে।
ঋণ সংকট ও আর্থিক চাপ
উত্তরণের পর অনুদান ও স্বল্পসুদে ঋণের সুযোগ কমে যাবে, ফলে সরকারকে বাণিজ্যিক ঋণের ওপর নির্ভর করতে হবে, যা তুলনামূলক ব্যয়বহুল। বর্তমানে বৈদেশিক ঋণ ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে; সুদের হার আরও বাড়লে ঋণ পরিশোধে চাপ সৃষ্টি হবে, যদি না শক্তিশালী ঋণব্যবস্থাপনা ও রপ্তানি বৈচিত্র্য নিশ্চিত করা যায়।
কাঠামোগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের আহ্বান
আইসিসিবি সাহসী সংস্কারের আহ্বান জানিয়েছে—কর ও শুল্কনীতি সহজীকরণ, চুক্তি বাস্তবায়নে দক্ষতা বৃদ্ধি, ডিজিটাল শাসনব্যবস্থা সম্প্রসারণ এবং ব্যবসায়িক পরিবেশে স্বচ্ছতা আনতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। এতে দেশীয় ও বৈদেশিক বিনিয়োগ উভয়ই বাড়বে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
মানবসম্পদ উন্নয়ন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি
শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষা খাতের দুর্বলতা নিয়েও আইসিসিবি উদ্বেগ জানিয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, “এলডিসি-উত্তর বাংলাদেশ মানবসম্পদ উন্নয়নে পিছিয়ে থাকতে পারে না।” এজন্য দক্ষতা উন্নয়ন, কারিগরি প্রশিক্ষণ ও নারীর কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে ত্বরান্বিত বিনিয়োগের আহ্বান জানানো হয়েছে।
নতুন খাতের সম্ভাবনা
পোশাকের বাইরেও বাংলাদেশকে তথ্যপ্রযুক্তি, ওষুধশিল্প, চামড়া, কৃষি-প্রক্রিয়াজাতকরণ, জাহাজ নির্মাণ ও সেবা খাতে বৈচিত্র্য আনার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে ওষুধশিল্পে গবেষণা ও উন্নয়ন (R&D) জোরদার, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা–জিএমপি মানদণ্ডে উন্নীতকরণ, আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্ব ও সরকারি প্রণোদনা কাঠামো গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে।
সময় বাড়ানোর প্রস্তাব ও ভবিষ্যৎ দৃষ্টিভঙ্গি
সম্প্রতি আইসিসিবি ও আরও ১৫টি ব্যবসায়িক সংগঠন দেশের এলডিসি উত্তরণ প্রক্রিয়া ৩–৫ বছর পিছিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। ২৪ আগস্টের সংবাদ সম্মেলনে তারা যুক্তি দেয়, এ সময়সীমা বৃদ্ধি পেলে শিল্পখাতগুলো পুনরায় সক্ষমতা অর্জন, প্রতিযোগিতা পুনর্গঠন এবং প্রয়োজনীয় সংস্কার বাস্তবায়নের সুযোগ পাবে।
আইসিসিবি-র ভাষায়, “বাংলাদেশের উত্তরণ একটি উদযাপনের মাইলফলক—তবে এটি একই সঙ্গে কর্মের আহ্বানও।” প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, “অতীতের সুবিধাগুলো হারিয়ে যাবে, আর ভবিষ্যতের শৃঙ্খলা দাবি করবে আরও সংস্কার, উদ্ভাবন ও স্থিতিশীলতা।”
সংগঠনটির মতে, নীতি–সমন্বিত পদক্ষেপ, শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি খাতের গতিশীল নেতৃত্বের মাধ্যমে বাংলাদেশ এই উত্তরণকে “অন্তর্ভুক্তিমূলক, টেকসই ও স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধির শক্তিশালী সোপানে” রূপ দিতে পারে—অর্থাৎ দুর্বলতা থেকে উদ্যমের পথে যাত্রা শুরু করতে পারে।
#t বাংলাদেশ, এলডিসি উত্তরণ, আইসিসিবি, অর্থনৈতিক সংস্কার, রপ্তানি, বাণিজ্য, ঋণ সংকট, বেসরকারি খাত, টেকসই উন্নয়ন, সারাক্ষণ রিপোর্ট