১৬ অক্টোবর ছিল মতিয়া চৌধুরীর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৬ তারিখেই এ লেখাটি লেখার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু পাঁচ দিন অপেক্ষা করেছি। কারণ, মতিয়া চৌধুরীর ছাত্র জীবনের রাজনৈতিক সহকর্মীরা, তাঁর ছাত্র জীবনের সহকর্মী ছাড়াও স্বামী প্রখ্যাত সাংবাদিক বজলুর রহমানের আত্মীয়রা সংবাদ মাধ্যমে অনেক বড় বড় স্থানে আছেন। মূলত এই পাঁচ দিন তাদের কারও না কারও লেখা পাওয়ার জন্য এ অপেক্ষা।
কারণ, মতিয়া চৌধুরীর সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটা প্রথমত প্রয়াত সাংবাদিক বজলুর রহমানকে ঘিরে। আমাদের জেনারেশনের প্রায় সব সাংবাদিকই বজলুর রহমানকে অন্য উচ্চতায় রেখে সম্মান করে। তবে তারপরেও পেশাগত কারণে তাঁর সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রে ঘনিষ্ঠ হতে হয়েছে। যে ঘনিষ্ঠতা বাংলাদেশের সকল দলের শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিবিদদের সঙ্গে একজন দীর্ঘ সময় ধরে থাকা সাংবাদিকের থাকে।
তারপরেও মতিয়া চৌধুরীর ওপর শ্রদ্ধার আরও কিছু কারণ ছিল। মতিয়া চৌধুরী কারও দ্বারা মোটিভেটেড হয়ে রাজনীতিতে আসেননি। তিনি তাঁর জাতির আত্মসম্মানে যখন আঘাত দেওয়া হয়েছিল, তারই প্রতিবাদে রাজনীতিতে এসেছিলেন। তখন তিনি নবম শ্রেণির ছাত্রী। মূলত নৃত্যকলা ও সঙ্গীত সাধনা ছিল তাঁর বিজ্ঞান শিক্ষার পাশাপাশি পছন্দের জগত।
সেই সময়টিতে পাকিস্তানে মার্শাল ল’ জারি করলেন আইয়ুব খান এবং তাঁর জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে বললেন, “This nation is not fit for democracy।” মতিয়া চৌধুরী বিভিন্ন সাক্ষাৎকারসহ নানান আলোচনায় বারবার বলতেন, ওই একটি বাক্য তাঁর আত্মসম্মানে আঘাত দিয়েছিল। এ জাতি গণতন্ত্রের উপযোগী নয়।
মতিয়া চৌধুরী শিক্ষিত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা শুধু উচ্চ মর্যাদার সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন না, তাঁদের বাড়ির নিয়মিত অতিথি শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, ত্রৈলক্ষ্য মহারাজ, শিল্পী গীতা দত্তের পিতৃপুরুষসহ অনেকে। তাই এমন একটা পরিবেশে বেড়ে ওঠা এক কিশোরী মন স্বাভাবিকই জাত্যাভিমানে ভরা থাকবেই। তাছাড়া তাঁর মাত্র কিছুদিন আগে প্রবল জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ইংরেজকে তাড়ানো হয়েছে। সে আবহাওয়া তখনও বর্তমান। তাঁর ওপর ৫২ থেকে ৫৮ মাত্র ছয় বছর। ৫২-এর ভাষা আন্দোলন শেষ পর্যন্ত শুধু ভাষা আন্দোলন ছিল না, এটা বাঙালি জাতীয়তাবাদের শিখাকে উসকে দেওয়া এক আন্দোলনের পথ ধরে হাঁটতে থাকে। এমন একটি সময়ে আইয়ুব খানের ওই কথা একটি উচ্চ মধ্যবিত্ত সম্মানিত পরিবারের কিশোরীকে অনেক বড় ধাক্কা দিতে পারে।
আর সেই ধাক্কা থেকেই মতিয়া চৌধুরীর রাজনীতিতে আসা। কিন্তু রাজনীতি করলেও সাহিত্য, দর্শন—কোনো কিছুই তিনি ছাড়েননি। বরং এগুলো তাঁর জীবনের সঙ্গী ছিল। পৃথিবী ও মানব জীবন সম্পর্কে তিনি যেন সারাংশ বুঝেছিলেন; রবীন্দ্রনাথের ওই একটি লাইন থেকে প্রায় বলতেন, “যাও মর্তে, সেখানে দুঃখ পাবে, দুঃখ দেবে।”
আসলে বারবার এই নৃত্যনাট্যটি দেখেছি, বারবার শুনেছি এ সঙ্গীত ও আবৃতি। তবে কোনো একটি বিষয় নিয়ে একদিন মতিয়া আপার সঙ্গে কথা হচ্ছিল—তখন তিনি একটু থেমে বললেন, এটাই তো পৃথিবীর নিয়ম—এখানে তো আসতে হয় দুঃখ পেতে ও দুঃখ দিতে। তারপরেও তো এ পৃথিবীতে ভালোবাসা, স্নেহ, মমতা—এগুলো আছে।
মতিয়া চৌধুরী এ দেশের জন্য কত বড় দুঃখ সয়ে গেছেন, তা হয়তো এ দেশের অনেক মানুষ জানে না, আর নতুন প্রজন্ম তো জানেই না। মতিয়া চৌধুরীর ছাত্র রাজনীতির কারণে যখন তাঁর বাবার সরকারি চাকরি হারানোর প্রশ্ন আসে—সে সময় মতিয়া চৌধুরী তাঁর অভিভাবক পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি তাঁর ভালোবাসার মানুষ বজলুর রহমানকে বলেন, একদিনের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়ে তাঁকে বিয়ে করার জন্য। সে সবই ঘটে। তারপরেই সে নববধূর জেলযাত্রা—সে অনেক ঘটনা। কিন্তু বিয়ের সময় মতিয়া চৌধুরী বজলুর রহমানকে একটি শর্ত দেন—যেন বজলুর রহমান তাঁর কাছে কোনো সন্তান আশা না করেন। এবং বজলুর রহমানও সেটা মেনে নেন।
এই সন্তান না নেবার কারণ হিসেবে মতিয়া চৌধুরী বলেছিলেন, নিজে হয়তো তিনি যে কোনো মূল্যে তাঁর রাজনৈতিক জীবনে আর্থিকভাবে সৎ থাকতে পারবেন, কিন্তু সন্তানের স্বার্থ বিবেচনা করে তাঁর অটল প্রতিজ্ঞা টলে যেতে পারে। এবং এখানে তাঁর দর্শন ছিল—জীবনে বীরের মতো একদিন ফাঁসির রজ্জু গলায় নেওয়া যায়, কিন্তু প্রতিদিন সৎ থাকা ফাঁসির রজ্জু গলায় নেওয়ার থেকে অনেক কঠিন। মতিয়া চৌধুরী যে সঠিক ছিলেন তার প্রমাণ তো এখনও সকলের চোখের সামনে।
তবে এছাড়াও বাঙালি মুসলিম সমাজকে আরও দীর্ঘকাল এমন তিনজন মহীয়সী নারীর জন্য অপেক্ষা করতে হবে। নারীমুক্তি ও নারীশিক্ষার আলো ছড়ানোর অগ্রদূত বেগম রোকেয়া, আর সেই পথ ধরে শুধু নারী নয় গোটা সমাজ আলোকিত করার দীপ হাতে সৌম্য শান্ত দেবীমূর্তির মতো সুফিয়া কামাল, আর এক অগ্নিঝরা নারী—রাজনীতিতে যিনি অগ্নিকন্যা মতিয়া চৌধুরী।
গত বছর ১৬ অক্টোবর বিনা চিকিৎসায় এক ভয়াবহ দুঃসময়ে তাঁর মৃত্যু ঘটে। বাঙালি জাতি ভয়, ক্ষমতা, লোভ, এমনি নানান লালসার কাছে পরাজিত হয়ে তাঁর মরদেহকে সম্মান জানায়নি। এমনকি তাঁর কবরের জন্য এক টুকরো মাটিও জোটেনি—এই বাংলাদেশে। হয়তো না জুটেই ভালো হয়েছে, যে মানুষটি উত্তীয়রের মতো সকল কিছু ত্যাগ করেছিলেন মতিয়া চৌধুরীর জন্য, সেই নিঃস্বার্থ ভালোবাসার মানুষের কবরে তারা জড়াজড়ি করেই আছেন।
ষাটের দশক থেকে ২০২৪ অবধি মতিয়া চৌধুরীর রাজনৈতিক জীবন ও সংগ্রাম যা দেখেছি তা নিয়ে হয়তো কয়েক হাজার পৃষ্ঠা লিখতে পারব। এমনকি গত এক বছরে যাদেরকে দেখলাম তাদের নিয়েও কি ভবিষ্যতে এক হাজার পৃষ্ঠা করে লেখা যাবে না?
তবে তাঁর মৃত্যু দিবসকে স্মরণ করে এ লেখায় শুধু এটুকুই বলব—মতিয়া চৌধুরীই প্রথম রাজনীতিবিদ ও মন্ত্রী যিনি বাংলাদেশের মানুষের মূল খাদ্য চালে দেশকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করেছিলেন। এ কাজে তিনি কী পরিমাণ পরিশ্রম করতেন তা সে সময়ের সাংবাদিক, সচিব, ডিসি, টিএনও, এমনকি থানার কৃষি বিভাগের মাঠকর্মীরাও বলতে পারবেন।
এবং সত্যিই বাংলাদেশকে চমকে উঠতে হয়েছিল—এ দেশে ভারত থেকে, বার্মা (মিয়ানমার) থেকে চাল আমদানি করতে হবে না। এমন একটি সফলতা মতিয়া চৌধুরী সম্ভব করেছিলেন।
অথচ তাঁর কবরের জন্য মাটি জোটেনি এ দেশে—কারণ তিনি নাকি দিল্লির দালাল। কিন্তু তাঁকে দিল্লির দালাল বলে যারা রাজপথ কাঁপিয়ে ছিলেন—“দিল্লি না ঢাকা—ঢাকা ঢাকা।” তারা গত এক বছর তাদের শরীর-স্বাস্থ্য ভালো রেখেছেন, ভারত থেকে বেশি চাল আমদানি করে। গত বিশ বছরের মধ্যে এ বছরই ভারত থেকে সবচেয়ে বেশি চাল আমদানি হয়েছে। এমনকি কাঁচা মরিচও বেশি আমদানি হয়েছে ভারত থেকে। ভারত থেকে কাঁচা মরিচ আমদানি না হলে মরিচের কেজি হাজার টাকায় উঠত। এমনকি আদানির বিদ্যুৎও অনেক বেশি আমদানি হয়েছে। এখন তো ভাবভঙ্গিতে মনে হয়, আদানি ঢাকাতেই আছেন।
তাছাড়া রাজধানী গুলশান, বনানী থেকে শুরু করে প্রায় সব জায়গায় এ মুহূর্তে বাংলাদেশের সাবান, শ্যাম্পু, আফটারশেভ, শেভিং জেল বা ফোম, বাথজেল—এর ৯০ ভাগের ওপর ভারতীয়। যা আগে ৩০ ভাগও ছিল না। কারণ মানুষ ইউরোপ, আমেরিকা, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, চায়নার অনেক উন্নত ব্র্যান্ড বেশি পছন্দ করত। আর সেগুলো কিনত। সেগুলো এখন আর ডলার-অভাবে আমদানি হয় না। মানুষকে বাধ্য হয়েই দিল্লির জিনিসেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। আর এর পরেও মতিয়া চৌধুরীকে তকমা দেওয়া হয় দিল্লির দালাল। তাঁর কবরের জন্য তাঁর নিজহাতে তৈরি স্বদেশভূমিতে মাটি জোটে না। তাঁর মৃত্যুদিন পালিত হয় না। অবশ্য বাঙালির কাছে বাঙালির কোনো শ্রেষ্ঠ সন্তানই সম্মান আশা করেননি। বাঙালি সব সময়ই চতুর, ফড়িয়া, দালাল, সুদখোর, বিদেশির পা-চাটা—এ ধরনের লোকদেরই পছন্দ করে। কারণ সেটা তার নিজ চরিত্রের শঠতার সঙ্গে মেলে। মানসিক ক্ষুদ্রতার সঙ্গে মেলে। কেন যে এ জাতিতে মাঝে মাঝে ভুলক্রমে মতিয়া চৌধুরীর মতো মানুষ জন্মায়—এ প্রশ্ন তো সেই অনাদিকাল থেকে এই পান্ডববর্জিত দেশ নিয়ে।
তারপরেও মতিয়া চৌধুরীর সাফল্য প্রমাণ করে, দেশকে গড়তে হলে, দেশের কাজে সাফল্য আনতে হলে দেশপ্রেম বা উদার জাতীয়তাবাদী হতে হয়।
মৌলবাদ, মেটিকুলাস ডিজাইন—এগুলো দিয়ে মতিয়া চৌধুরীদেরকে অপমান করা যায়, কিন্তু দেশের ও মানুষের কল্যাণ করা যায় না। মানুষের কল্যাণের নিবেদিত হিসেবে শেষ অবধি লেখা থাকবে ইতিহাসে মতিয়া চৌধুরীর মতো মানব ও মানবীদের নাম। তবে এটাও সত্য, বাঙালি ইতিহাসও লেখে না। তবুও কোনো একদিন হয়তো এ দেশের মাটিতে প্রকৃত সন্তানরা জন্মাবে—তারা শুনতে চাইবে মতিয়া চৌধুরীর মতো মানুষের কথা।
লেখক: সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক, সারাক্ষণ, The Present World.