২৬তম সাংবিধানিক সংশোধনী নিয়ে শুনানিতে পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি মোহাম্মদ আলী মাজহার মন্তব্য করেছেন যে, প্রতিবেশী দেশ ভারতের সংবিধান বেঞ্চেরও বিশেষ ক্ষমতা রয়েছে। তিনি বলেন, দুই দেশের বিচার কাঠামো ভিন্ন হলেও, সংবিধান ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে ভারতের বেঞ্চও বিশেষভাবে সক্ষম।
শুনানিতে তুলনামূলক বিশ্লেষণ
মঙ্গলবার ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিত এই শুনানিতে আইনজীবী শব্বির রাজা রিজভি আদালতে যুক্তি দেন যে, বিশ্বে কেবল ভারতেই ‘সংবিধান বেঞ্চ’ রয়েছে; অন্য দেশে থাকে ‘সংবিধান আদালত’। এর জবাবে বিচারপতি মাজহার বলেন, “ভারতেও সংবিধান বেঞ্চের বিশেষ ক্ষমতা রয়েছে।”
রিজভি বলেন, ভারতে কেবল প্রধান বিচারপতিই এমন বেঞ্চ গঠন করতে পারেন। এ প্রসঙ্গে বিচারপতি মাজহার উল্লেখ করেন, “ভারতে প্রধান বিচারপতিকে ‘মাস্টার অব দ্য রোস্টার’ ঘোষণা করা হয়েছে, কিন্তু পাকিস্তানে এ দায়িত্ব ভাগ করা হয়েছে দুটি কমিটির মধ্যে। এখানে প্রধান বিচারপতি এককভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত নন।”
সংশোধনী ও চ্যালেঞ্জ
বিচারপতি আমিনউদ্দিন খানের নেতৃত্বে গঠিত আট সদস্যবিশিষ্ট বেঞ্চে এই শুনানি হয়। বেঞ্চে আরও ছিলেন বিচারপতি জামাল খান মন্দোখেল, আয়েশা এ মালিক, সৈয়দ হাসান আজহার রিজভি, মুসারাত হিলালি, নাঈম আখতার আফগান ও শাহিদ বিলাল হাসান।
পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই), জামায়াতে ইসলামী (জেআই), সুন্নি ইত্তেহাদ কাউন্সিল (এসআইসি), লাহোর ও করাচি বার অ্যাসোসিয়েশন, সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সাতজন সভাপতি এবং আরও অনেক ব্যক্তি ২৬তম সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে আবেদন করেন।
আদালতের প্রশ্ন ও আইনি বিতর্ক
আইনজীবী রিজভি যুক্তি দেন, সংশোধনীর পরও সুপ্রিম কোর্ট তার সাংবিধানিক ক্ষমতা সংরক্ষণ করেছে। এর জবাবে বিচারপতি মাজহার বলেন, “২৬তম সংশোধনীর মাধ্যমে সাংবিধানিক ব্যাখ্যার ক্ষমতা সংবিধান বেঞ্চে স্থানান্তরিত হয়েছে।”
বিচারপতি হিলালি জানতে চান, “তাহলে কি আমাদের প্রথমে ২৬তম সংশোধনী স্থগিত করতে হবে?”
তিনি আরও প্রশ্ন করেন, “আমরা কীভাবে অনুচ্ছেদ ১৯১-এ বাইপাস করব?” — উত্তরে রিজভি বলেন, এই অনুচ্ছেদকে সংবিধানের অন্যান্য ধারার সঙ্গে মিলিয়ে পড়তে হবে, একা নয়।
রিজভির বক্তব্যের জবাবে বিচারপতি মাজহার বলেন, “অনুচ্ছেদ ১৮৪(৩)-এর ক্ষমতা এখন অনুচ্ছেদ ১৯১(এ)-এর অধীনে সংবিধান বেঞ্চে স্থানান্তরিত হয়েছে। নিয়মিত বেঞ্চ ও সংবিধান বেঞ্চ একই বৃক্ষের দুটি শাখা, কিন্তু তাদের ক্ষমতা আলাদা।”
ফুল কোর্ট গঠনের বিতর্ক
রিজভি প্রস্তাব দেন, বেঞ্চ চাইলে ফুল কোর্ট গঠনের নির্দেশ দিতে পারে। তখন বিচারপতি আমিনউদ্দিন প্রশ্ন করেন, “যেসব বিচারক সংবিধান ব্যাখ্যার অধিকারী নন, তাদের কীভাবে এই বেঞ্চে অন্তর্ভুক্ত করা হবে?”
তিনি আরও বলেন, “সংবিধান বেঞ্চ প্রধান বিচারপতিকে অন্তর্ভুক্ত করতে বাধা দেয় না, তবে ক্ষমতা হস্তান্তরের কোনো বিধানও নেই।”
আইনজীবী রিজভি বলেন, “অনুচ্ছেদ ১৯১(এ) নিজেই বলে, সংবিধান বেঞ্চ সুপ্রিম কোর্টের অংশ এবং প্রয়োজনে ফুল কোর্ট গঠনের প্রস্তাব দিতে পারে।”
বিচারপতি মাজহার জানতে চান, “ফুল কোর্ট গঠনের বিষয়টি আমরা কাকে পাঠাব?”
রিজভি বলেন, “আপনারাই বলেছেন, সরকার যদি প্রেসিডেন্টের মাধ্যমে রেফারেন্স পাঠায়, তা প্রধান বিচারপতির কাছে যাবে।”
তবে বিচারপতি মাজহার প্রশ্ন তোলেন, “প্রধান বিচারপতি যেহেতু বিচার কমিশনের সদস্য, তিনি নিজেই কি বিচারক মনোনয়ন দিতে পারেন?”
পরবর্তী দিন পর্যন্ত মুলতবি
রিজভির যুক্তি শেষ হলে, আবেদনকারী আনাস আহমেদের পক্ষে ব্যারিস্টার আদনান খান তার বক্তব্যে বলেন, এই মামলাটি শুনতে ফুল কোর্ট গঠন করা প্রয়োজন।
বিচারপতি মাজহার ফের প্রশ্ন করেন, “ফুল কোর্ট গঠনের প্রস্তাব আমরা কাকে পাঠাব?”
এর জবাবে ব্যারিস্টার খান বলেন, “ফুল কোর্ট আসলে আলাদা করে গঠিত হয় না; এটি সব বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত এবং কেবল আহ্বান করা হয়।”
তিনি আরও বলেন, “বিচার কমিশনে সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে।” এ পর্যায়ে বিচারপতি আমিনউদ্দিন জানতে চান, “কীভাবে সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চিত হলো?”
সবশেষে আদালত শুনানি বুধবার পর্যন্ত মুলতবি ঘোষণা করে।
২৬তম সংশোধনী নিয়ে পাকিস্তানের বিচার বিভাগে যে বিতর্ক চলছে, তা শুধু সাংবিধানিক ক্ষমতার প্রশ্ন নয়, বরং বিচার কাঠামোর ভারসাম্য নিয়েও নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে। ভারত-পাকিস্তান তুলনায় বিচারপতি মাজহারের মন্তব্য ইঙ্গিত করছে, দুটি দেশের সাংবিধানিক বাস্তবতায় ভিন্নতা থাকলেও বিচার স্বাধীনতা ও ক্ষমতার সীমা নির্ধারণের প্রয়াস উভয় ব্যবস্থাতেই বিদ্যমান।