০৪:২২ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৩ অক্টোবর ২০২৫
মুকুট অলংকার চুরির তিন দিন পর খুলল ল্যুভর—কঠোর তল্লাশিতে নতুন নিয়ম এলএনজি বাণিজ্যে নিয়মকাঠামো শিথিলের চাপ—ইইউকে কাতার-যুক্তরাষ্ট্রের চিঠি রোবটে গতি বাড়াচ্ছে অ্যামাজন—গুদাম কাজের ছবিই বদলাবে সমালোচনার মধ্যেও সুপার বোল হাফটাইমে ব্যাড বান্নি—এনএফএলের অবস্থান অপরিবর্তিত জাপানের উপকূলে নতুন গভীর–সমুদ্র অ্যানিমোন প্রজাতি শনাক্ত রাশিয়ার জ্বালানি আয়ে চাপ বাড়াতে নতুন নিষেধাজ্ঞায় কিয়েভের সমর্থন মাস্ক: এ বছরই ‘সেফটি মনিটর’ ছাড়াই টেসলা রোবোট্যাক্সি চালু হতে পারে রাশিয়ার স্থগিত সম্পদ ব্যবহারে ঝুঁকি ভাগে ইইউকে চাপ দিচ্ছে বেলজিয়াম ময়মনসিংহে অটোরিকশাচালক খুন—ছিনতাইকারীদের হাতে প্রাণ গেল মাসুদের সরকারি ক্রয় কমিটিতে অনুমোদন—১০০,০০০ টন চাল আমদানি, ব্যয় ৪৪৬ কোটি টাকা

আন্দোলনের পর গ্রেফতার বুয়েটছাত্র, ‘ধর্ম অবমাননা’ নিয়ে কী হয়েছিল?

ধর্মীয় অবমাননা ও নারী সহপাঠীকে ধর্ষণের অভিযোগে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বা বুয়েটের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ক্যাম্পাসের এক ছাত্রের বিরুদ্ধে মামলার পর ওই শিক্ষার্থীকে আটক করেছে পুলিশ।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিকাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ওই ছাত্রকে মঙ্গলবার সকালে হল থেকে ও রাতে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার সাময়িক বহিষ্কার করা হয়।

মঙ্গলবার রাতেই শিক্ষার্থীদের তীব্র আন্দোলনের মুখে বুয়েট প্রশাসনের মামলার পর ভোর রাত সাড়ে চারটায় বুয়েটের আহসান উল্লাহ হল থেকে শ্রীশান্ত রায়কে গ্রেফতার করা হয়।

আহসান উল্লাহ হলের প্রভোস্ট ড. মুহাম্মদ ফয়সাল বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকেও আলাদাভাবে তদন্ত করা হচ্ছে। সেই তদন্তের পরই এ নিয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

বুয়েটে তার সহপাঠী শিক্ষার্থীরা বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম রেডিটে ছদ্মনামে নারীদের নিয়ে নানা ‘কুরুচিপূর্ণ’ মন্তব্য করতেন মি. রায়, যে কারণে তারা এ নিয়ে আন্দোলন করেছেন ও বিচার চেয়েছেন।

বুধবার রাতে মি. রায়কে বুয়েট ক্যাম্পাস থেকে গ্রেফতারের পর তাকে আদালতে নেওয়া হলে বিচারক তাকে জেল হাজতে পাঠানোর আদেশ দেন বলে বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন চকবাজার মডেল থানার ওসি সৈয়দ আশরাফুজ্জামান।

এ নিয়ে বিবিসি বাংলা মি. রায়ের বাবার সাথেও কথা বলেছে। তিনি জানিয়েছেন, এই ঘটনার পর মঙ্গলবারই তিনি ঢাকায় এসেছেন। তবে, তদন্তের আগে এই বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত কিছু বলতে চাননি তিনি।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম রেডিটে ছদ্মনামে লিখতেন মি. রায়, তারপরও কীভাবে অভিযোগ উঠলো এবং এর সত্যতাও বা কতটুকু তা নিয়ে সহপাঠী, হল প্রশাসন ও পুলিশের সাথেও কথা বলেছে বিবিসি বাংলা।

ঘটনার শুরু কীভাবে

ফেসবুক, টিকটক কিংবা ইনস্টাগ্রামের মতোই আরেকটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম রেডিট।

তরুণদের মধ্যে অনেকেই এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা ধরনের কন্টেন্ট শেয়ার করে থাকেন। তবে বাংলাদেশে ফেসবুক বা টিকটকের মতো এর ব্যবহার অতটা নেই।

বুয়েটের শিক্ষার্থীরা জানান, সম্প্রতি এই রেডিটে বুয়েট শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ লক্ষ্য করেন- সেখানে ছদ্মনামে মুসলিম নারী কিংবা ইসলাম ধর্ম নিয়ে একজন বিভিন্ন ধরনের নেতিবাচক মন্তব্য করছেন।

কোনো কোনো পোস্টে ছদ্মনামের ওই ব্যক্তি নিজেকে বুয়েটের শিক্ষার্থী হিসেবেও দাবি করে বিভিন্ন পোস্ট কমেন্ট করেছেন বলেও তারা জানান।

বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের স্নাতক চূড়ান্ত বিভাগের ছাত্র আব্দুর নূর বিবিসি বাংলাকে বলেন, “একটা ছদ্মনাম ব্যবহার করে একদিন একটা পোস্টে করে একজন। ওই পোস্টদাতা সেখানে দাবি করে, একটা মুসলিম মেয়েকে সে ধর্ষণ করেছে”।

মি. নূর জানান, “ছদ্মনামে লেখা ওই পোস্টের কমেন্টে বলা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে একটা কনসার্টের সময় সে তার মুসলিম নারী সহপাঠী শিক্ষার্থীর সাথে গাঁজা সেবন করে এবং পরবর্তীতে তাকে ঢাকার ধানমণ্ডির একটি হোটেলে নিয়ে ধর্ষণ করে”।

বুয়েটের শিক্ষার্থীরা জানান, এর কিছুদিন পরে ছদ্মনামে চালানো ওই আইডি থেকে একটি কমেন্টেও দাবি করা হয় সে বুয়েটের ইলেকট্রিকাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং ২১ ব্যাচের শিক্ষার্থী।

“কিছুদিন আগে বুয়েটের ইলেক্ট্রনিক অ্যান্ড ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের একটা ছেলে রেডিটে একটি বিতর্কিত পোস্ট দিয়েছিল। সেটি নিয়ে রেডিটে নানা আলোচনা তৈরি হয়। তখন উইকলি সার্ভিস ৯২৩ ছদ্মনামের ওই আইডি থেকে কমেন্ট করে লিখে- ‘হি ইজ মাই ক্লাসমেট ফ্রম ইইই ২১”।

শিক্ষার্থীরা বলছিলেন, মূলত বিতর্কিত ওই পোস্টে বুয়েটের শিক্ষার্থী পরিচয় দেওয়ার পরই কিছুদিন আগে বিষয়টি নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আলোচনা হয়।

একই ব্যাচ, অর্থাৎ বুয়েটের ২১ ব্যাচের যন্ত্রকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী আবরার ফাইয়াজ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “গত সোমবার ২০তম ব্যাচের এক ভাই হঠাৎ করে ফেসবুক পোস্টে লিখে যে রেডিটে এক ধরনের কমেন্ট দেখা যাচ্ছে। সেখানে মুসলিম বিদ্বেষ, ব্যাচমেট মুসলিম বন্ধুকে ড্রাগ খাইয়ে রেপ করছে এই বিষয়গুলো ছিল। সেখানে কিছু ক্লু পায় স্টুডেন্টরা”।

বুয়েটের শিক্ষার্থীরা বলছিলেন, এই বিষয়গুলো সামনে আসলেও ওই নাম ব্যবহারকারী আসলেই বুয়েট স্টুডেন্ট কি-না কিংবা ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়ে কি-না সেটি নিয়ে তাদের মধ্যে নানা ধোঁয়াশা ছিল।

মি. ফাইয়াজ বলছিলেন, “গত জুন মাসের ৩ তারিখ ওই আইডি থেকেই একটি পোস্টে লেখা হয়- সে নেপাল গেছে ট্যুরে। একই সময় সে ইনস্টাগ্রামেও পোস্ট দিয়েছিল যে নেপালে আছে”।

“স্টুডেন্টরা তখন এই বিষয়গুলো নিয়ে সার্চ করছিল। এক পর্যায়ে তারা দেখতে পায় ইন্সটাগ্রাম আইডিতে নেপালের ছবি ও রেডিটে ছদ্মনামের পোস্ট একই দিনের ছিল। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে ছদ্মনামের পোস্টে সে হিন্দু সম্প্রদায়ের সেটাও লিখছিলো”, বলছিলেন মি. ফাইয়াজ।

শিক্ষার্থীরা জানান, বিষয়গুলো নিয়ে গত কয়েকদিন বুয়েট শিক্ষার্থী তার পোস্টগুলো মনিটরিং শুরু করে। এক পর্যায়ে আরো কিছু তথ্য ও প্রমাণ তারা সংগ্রহ করে।

বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পর যা হলো

সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের স্নাতক শ্রেণির শিক্ষার্থী মি. নূর বলছিলেন, “শিক্ষার্থীরা যখন সব তথ্য প্রমাণ সংগ্রহ করলো তখন বিষয়টি নিয়ে গত সোমবার শ্রীশান্ত রায়কে তার হলে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলো। প্রথমে জিজ্ঞাসাবাদে সে অস্বীকার করলো। পরে তার সামনে তথ্য প্রমাণ হাজির করার পর সে কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি”।

তবে, শিক্ষার্থীরা এটিও জানিয়েছেন, ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীরা সরাসরি জিজ্ঞাসাবাদের আগেই শ্রীশান্ত তার ল্যাপটপ কিংবা মোবাইল থেকে সব তথ্য প্রমাণ মুছে ফেলার চেষ্টা করে।

মি. নুর বলছিলেন, “যখন স্টুডেন্টরা দেখে যে সে তার ব্রাউজার হিস্ট্রি ডিলিট করে ফেলেছে, তখন সবাই তাকে এ নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। কিন্তু সে কোনো কিছুতেই স্বীকার করছিলো না”।

আবরার ফাইয়াজ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, “আমাদের সন্দেহ দূর হয়ে গেছে তখন যখন সে ছদ্মনামের একটা পোস্টে লিখেছিল সে জেনারেল স্কলারশিপ পেয়েছে। কারণ ওই ব্যাচে সেই একা ওই স্কলারশিপ পেয়েছে”।

এরপর গত সোমবারই এই বিষয়টি শিক্ষার্থীরা আহসান উল্লাহ হলের প্রশাসনকে জানান শিক্ষার্থীরা। পরে শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে সোমবার হল প্রশাসন তাকে হল থেকে সাময়িক বহিষ্কার করে।

আন্দোলন-মামলা ও গ্রেফতার

বুয়েট শিক্ষার্থী আব্দুন নুর জানান, সোমবার রাতে হল থেকে বহিষ্কারের পর মঙ্গলবার সকালে শ্রীশান্ত হল থেকে বের হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। এসময় তাকে আটকায় শিক্ষার্থীরা। পরে আবারো খবর দেওয়া হয় হল প্রভোস্টকে।

দুপুর থেকেই বিষয়টি আহসান উল্লাহ হল ছাপিয়ে পুরো ক্যাম্পাসে একটু একটু ছড়িয়ে পড়ে।

ইসলাম ধর্ম ও মুসলিম নারীদের নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘বিতর্কিত’ পোস্ট করা বিষয়টি নিয়ে নানা আলোচনা চলতে থাকে বুয়েটের বিভিন্ন সোশ্যাল গ্রুপে।

একই ব্যাচের ছাত্র মি. ফাইয়াজ জানান, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন বাড়তে থাকলে একটা পর্যায়ে বুয়েট উপাচার্য শ্রীশান্তের বাবাকে সিলেট থেকে ঢাকায় ফোন করে নিয়ে আসেন। তিনি রাত নয়টায় ক্যাম্পাসে আসার পর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার জিম্মায় তার ছেলেকে ছেড়ে দিতে চাচ্ছিলো।

তবে, শিক্ষার্থীদের অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এই সিদ্ধান্ত মানতে চায়নি। এক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ শুরু করলে পুলিশ তাদের সরিয়ে দিতে চায়।

মি. নুর বলছিলেন, “তখন স্টুডেন্টরা শ্রীশান্তকে তার বাবার সাথে যেতে দিতে রাজি হচ্ছিল না। অনেকে শিক্ষার্থী তখন জড়ো হয়ে যায় ভিসি অফিসের সামনে। তখন পুলিশ এসে ছাত্রদের কড়া ভাষায় কথা বলে। তখন সাধারণ ছাত্ররা আরো ক্ষেপে যায়। তালা ভেঙে বের হয়ে পুলিশকে অবরোধ করে ফেলে”।

এক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে রাতেই শ্রীশান্তকে বুয়েট থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়। পরে তাকে আটক করে চকবাজার থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে তার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়।

মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম রেডিটে ছদ্মনাম ব্যবহার করছিলেন শ্রীশান্ত। তিনি ইসলাম ও মুসলিম নারীদের নিয়ে রেডিটে ‘আপত্তিকর মন্তব্য’ পোস্ট করেন। পরে তার পরিচয় শনাক্ত করা হয়। তার করা ‘বিদ্বেষমূলক মন্তব্য শিক্ষার্থীসহ ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্রছাত্রীদের মনে গভীর উদ্বেগ তৈরি হয়’।

আহসান উল্লাহ হলের প্রভোস্ট ড. মুহাম্মদ ফয়সাল বিবিসি বাংলাকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বাদী হয়ে মামলা করার পর ওই শিক্ষার্থীকে ভোর রাত সাড়ে চারটার দিকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

BBC News বাংলা

জনপ্রিয় সংবাদ

মুকুট অলংকার চুরির তিন দিন পর খুলল ল্যুভর—কঠোর তল্লাশিতে নতুন নিয়ম

আন্দোলনের পর গ্রেফতার বুয়েটছাত্র, ‘ধর্ম অবমাননা’ নিয়ে কী হয়েছিল?

১১:২২:২২ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৩ অক্টোবর ২০২৫

ধর্মীয় অবমাননা ও নারী সহপাঠীকে ধর্ষণের অভিযোগে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বা বুয়েটের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ক্যাম্পাসের এক ছাত্রের বিরুদ্ধে মামলার পর ওই শিক্ষার্থীকে আটক করেছে পুলিশ।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিকাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ওই ছাত্রকে মঙ্গলবার সকালে হল থেকে ও রাতে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার সাময়িক বহিষ্কার করা হয়।

মঙ্গলবার রাতেই শিক্ষার্থীদের তীব্র আন্দোলনের মুখে বুয়েট প্রশাসনের মামলার পর ভোর রাত সাড়ে চারটায় বুয়েটের আহসান উল্লাহ হল থেকে শ্রীশান্ত রায়কে গ্রেফতার করা হয়।

আহসান উল্লাহ হলের প্রভোস্ট ড. মুহাম্মদ ফয়সাল বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকেও আলাদাভাবে তদন্ত করা হচ্ছে। সেই তদন্তের পরই এ নিয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

বুয়েটে তার সহপাঠী শিক্ষার্থীরা বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম রেডিটে ছদ্মনামে নারীদের নিয়ে নানা ‘কুরুচিপূর্ণ’ মন্তব্য করতেন মি. রায়, যে কারণে তারা এ নিয়ে আন্দোলন করেছেন ও বিচার চেয়েছেন।

বুধবার রাতে মি. রায়কে বুয়েট ক্যাম্পাস থেকে গ্রেফতারের পর তাকে আদালতে নেওয়া হলে বিচারক তাকে জেল হাজতে পাঠানোর আদেশ দেন বলে বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন চকবাজার মডেল থানার ওসি সৈয়দ আশরাফুজ্জামান।

এ নিয়ে বিবিসি বাংলা মি. রায়ের বাবার সাথেও কথা বলেছে। তিনি জানিয়েছেন, এই ঘটনার পর মঙ্গলবারই তিনি ঢাকায় এসেছেন। তবে, তদন্তের আগে এই বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত কিছু বলতে চাননি তিনি।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম রেডিটে ছদ্মনামে লিখতেন মি. রায়, তারপরও কীভাবে অভিযোগ উঠলো এবং এর সত্যতাও বা কতটুকু তা নিয়ে সহপাঠী, হল প্রশাসন ও পুলিশের সাথেও কথা বলেছে বিবিসি বাংলা।

ঘটনার শুরু কীভাবে

ফেসবুক, টিকটক কিংবা ইনস্টাগ্রামের মতোই আরেকটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম রেডিট।

তরুণদের মধ্যে অনেকেই এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা ধরনের কন্টেন্ট শেয়ার করে থাকেন। তবে বাংলাদেশে ফেসবুক বা টিকটকের মতো এর ব্যবহার অতটা নেই।

বুয়েটের শিক্ষার্থীরা জানান, সম্প্রতি এই রেডিটে বুয়েট শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ লক্ষ্য করেন- সেখানে ছদ্মনামে মুসলিম নারী কিংবা ইসলাম ধর্ম নিয়ে একজন বিভিন্ন ধরনের নেতিবাচক মন্তব্য করছেন।

কোনো কোনো পোস্টে ছদ্মনামের ওই ব্যক্তি নিজেকে বুয়েটের শিক্ষার্থী হিসেবেও দাবি করে বিভিন্ন পোস্ট কমেন্ট করেছেন বলেও তারা জানান।

বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের স্নাতক চূড়ান্ত বিভাগের ছাত্র আব্দুর নূর বিবিসি বাংলাকে বলেন, “একটা ছদ্মনাম ব্যবহার করে একদিন একটা পোস্টে করে একজন। ওই পোস্টদাতা সেখানে দাবি করে, একটা মুসলিম মেয়েকে সে ধর্ষণ করেছে”।

মি. নূর জানান, “ছদ্মনামে লেখা ওই পোস্টের কমেন্টে বলা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে একটা কনসার্টের সময় সে তার মুসলিম নারী সহপাঠী শিক্ষার্থীর সাথে গাঁজা সেবন করে এবং পরবর্তীতে তাকে ঢাকার ধানমণ্ডির একটি হোটেলে নিয়ে ধর্ষণ করে”।

বুয়েটের শিক্ষার্থীরা জানান, এর কিছুদিন পরে ছদ্মনামে চালানো ওই আইডি থেকে একটি কমেন্টেও দাবি করা হয় সে বুয়েটের ইলেকট্রিকাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং ২১ ব্যাচের শিক্ষার্থী।

“কিছুদিন আগে বুয়েটের ইলেক্ট্রনিক অ্যান্ড ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের একটা ছেলে রেডিটে একটি বিতর্কিত পোস্ট দিয়েছিল। সেটি নিয়ে রেডিটে নানা আলোচনা তৈরি হয়। তখন উইকলি সার্ভিস ৯২৩ ছদ্মনামের ওই আইডি থেকে কমেন্ট করে লিখে- ‘হি ইজ মাই ক্লাসমেট ফ্রম ইইই ২১”।

শিক্ষার্থীরা বলছিলেন, মূলত বিতর্কিত ওই পোস্টে বুয়েটের শিক্ষার্থী পরিচয় দেওয়ার পরই কিছুদিন আগে বিষয়টি নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আলোচনা হয়।

একই ব্যাচ, অর্থাৎ বুয়েটের ২১ ব্যাচের যন্ত্রকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী আবরার ফাইয়াজ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “গত সোমবার ২০তম ব্যাচের এক ভাই হঠাৎ করে ফেসবুক পোস্টে লিখে যে রেডিটে এক ধরনের কমেন্ট দেখা যাচ্ছে। সেখানে মুসলিম বিদ্বেষ, ব্যাচমেট মুসলিম বন্ধুকে ড্রাগ খাইয়ে রেপ করছে এই বিষয়গুলো ছিল। সেখানে কিছু ক্লু পায় স্টুডেন্টরা”।

বুয়েটের শিক্ষার্থীরা বলছিলেন, এই বিষয়গুলো সামনে আসলেও ওই নাম ব্যবহারকারী আসলেই বুয়েট স্টুডেন্ট কি-না কিংবা ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়ে কি-না সেটি নিয়ে তাদের মধ্যে নানা ধোঁয়াশা ছিল।

মি. ফাইয়াজ বলছিলেন, “গত জুন মাসের ৩ তারিখ ওই আইডি থেকেই একটি পোস্টে লেখা হয়- সে নেপাল গেছে ট্যুরে। একই সময় সে ইনস্টাগ্রামেও পোস্ট দিয়েছিল যে নেপালে আছে”।

“স্টুডেন্টরা তখন এই বিষয়গুলো নিয়ে সার্চ করছিল। এক পর্যায়ে তারা দেখতে পায় ইন্সটাগ্রাম আইডিতে নেপালের ছবি ও রেডিটে ছদ্মনামের পোস্ট একই দিনের ছিল। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে ছদ্মনামের পোস্টে সে হিন্দু সম্প্রদায়ের সেটাও লিখছিলো”, বলছিলেন মি. ফাইয়াজ।

শিক্ষার্থীরা জানান, বিষয়গুলো নিয়ে গত কয়েকদিন বুয়েট শিক্ষার্থী তার পোস্টগুলো মনিটরিং শুরু করে। এক পর্যায়ে আরো কিছু তথ্য ও প্রমাণ তারা সংগ্রহ করে।

বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পর যা হলো

সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের স্নাতক শ্রেণির শিক্ষার্থী মি. নূর বলছিলেন, “শিক্ষার্থীরা যখন সব তথ্য প্রমাণ সংগ্রহ করলো তখন বিষয়টি নিয়ে গত সোমবার শ্রীশান্ত রায়কে তার হলে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলো। প্রথমে জিজ্ঞাসাবাদে সে অস্বীকার করলো। পরে তার সামনে তথ্য প্রমাণ হাজির করার পর সে কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি”।

তবে, শিক্ষার্থীরা এটিও জানিয়েছেন, ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীরা সরাসরি জিজ্ঞাসাবাদের আগেই শ্রীশান্ত তার ল্যাপটপ কিংবা মোবাইল থেকে সব তথ্য প্রমাণ মুছে ফেলার চেষ্টা করে।

মি. নুর বলছিলেন, “যখন স্টুডেন্টরা দেখে যে সে তার ব্রাউজার হিস্ট্রি ডিলিট করে ফেলেছে, তখন সবাই তাকে এ নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। কিন্তু সে কোনো কিছুতেই স্বীকার করছিলো না”।

আবরার ফাইয়াজ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, “আমাদের সন্দেহ দূর হয়ে গেছে তখন যখন সে ছদ্মনামের একটা পোস্টে লিখেছিল সে জেনারেল স্কলারশিপ পেয়েছে। কারণ ওই ব্যাচে সেই একা ওই স্কলারশিপ পেয়েছে”।

এরপর গত সোমবারই এই বিষয়টি শিক্ষার্থীরা আহসান উল্লাহ হলের প্রশাসনকে জানান শিক্ষার্থীরা। পরে শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে সোমবার হল প্রশাসন তাকে হল থেকে সাময়িক বহিষ্কার করে।

আন্দোলন-মামলা ও গ্রেফতার

বুয়েট শিক্ষার্থী আব্দুন নুর জানান, সোমবার রাতে হল থেকে বহিষ্কারের পর মঙ্গলবার সকালে শ্রীশান্ত হল থেকে বের হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। এসময় তাকে আটকায় শিক্ষার্থীরা। পরে আবারো খবর দেওয়া হয় হল প্রভোস্টকে।

দুপুর থেকেই বিষয়টি আহসান উল্লাহ হল ছাপিয়ে পুরো ক্যাম্পাসে একটু একটু ছড়িয়ে পড়ে।

ইসলাম ধর্ম ও মুসলিম নারীদের নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘বিতর্কিত’ পোস্ট করা বিষয়টি নিয়ে নানা আলোচনা চলতে থাকে বুয়েটের বিভিন্ন সোশ্যাল গ্রুপে।

একই ব্যাচের ছাত্র মি. ফাইয়াজ জানান, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন বাড়তে থাকলে একটা পর্যায়ে বুয়েট উপাচার্য শ্রীশান্তের বাবাকে সিলেট থেকে ঢাকায় ফোন করে নিয়ে আসেন। তিনি রাত নয়টায় ক্যাম্পাসে আসার পর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার জিম্মায় তার ছেলেকে ছেড়ে দিতে চাচ্ছিলো।

তবে, শিক্ষার্থীদের অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এই সিদ্ধান্ত মানতে চায়নি। এক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ শুরু করলে পুলিশ তাদের সরিয়ে দিতে চায়।

মি. নুর বলছিলেন, “তখন স্টুডেন্টরা শ্রীশান্তকে তার বাবার সাথে যেতে দিতে রাজি হচ্ছিল না। অনেকে শিক্ষার্থী তখন জড়ো হয়ে যায় ভিসি অফিসের সামনে। তখন পুলিশ এসে ছাত্রদের কড়া ভাষায় কথা বলে। তখন সাধারণ ছাত্ররা আরো ক্ষেপে যায়। তালা ভেঙে বের হয়ে পুলিশকে অবরোধ করে ফেলে”।

এক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে রাতেই শ্রীশান্তকে বুয়েট থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়। পরে তাকে আটক করে চকবাজার থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে তার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়।

মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম রেডিটে ছদ্মনাম ব্যবহার করছিলেন শ্রীশান্ত। তিনি ইসলাম ও মুসলিম নারীদের নিয়ে রেডিটে ‘আপত্তিকর মন্তব্য’ পোস্ট করেন। পরে তার পরিচয় শনাক্ত করা হয়। তার করা ‘বিদ্বেষমূলক মন্তব্য শিক্ষার্থীসহ ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্রছাত্রীদের মনে গভীর উদ্বেগ তৈরি হয়’।

আহসান উল্লাহ হলের প্রভোস্ট ড. মুহাম্মদ ফয়সাল বিবিসি বাংলাকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বাদী হয়ে মামলা করার পর ওই শিক্ষার্থীকে ভোর রাত সাড়ে চারটার দিকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

BBC News বাংলা