চীনের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের চংকিং শহরের এক পাহাড়চূড়ার পার্কে প্রতি শুক্রবার ও শনিবার সকালে শত শত মানুষ ভিড় করেন। তবে তাঁরা নিজেদের ভালোবাসার খোঁজে নন—বরং সন্তানদের জন্য পাত্র-পাত্রী খুঁজতে আসেন।
বিবাহবাজারের দৃশ্য
এই পার্কটি এখন একপ্রকার বাস্তব ডেটিং অ্যাপে রূপ নিয়েছে, যেখানে “সুইপ” করেন প্রবীণ বাবা-মায়েরা। তাঁরা একে বলেন “সিয়াংছিন জিয়াও”—বাংলায় অর্থ “বিবাহ-পরিচয় কোণা”। ইংরেজিতে পরিচিত এটি “ম্যারেজ মার্কেট” নামে।
এখানে কাগজে ছাপানো জীবনীই প্রোফাইল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তাতে থাকে বয়স, উচ্চতা, পেশা, এবং পছন্দের সঙ্গীর বিবরণ। কেউ কেউ লেখেন ওজন, আয়, এমনকি পেনশন সুবিধার কথাও—যা পশ্চিমা সমাজে অনেকটা গোপন তথ্যের মতো। বেশিরভাগ প্রোফাইলে ছবি বা নাম থাকে না।
প্রজন্মভেদে দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য
স্বেচ্ছাসেবী ‘ম্যাচমেকার’ সিস্টার গাও প্রতি সপ্তাহে আসেন কয়েক ডজন প্রোফাইল নিয়ে। তিনি ব্যস্ত থাকেন বাবা-মায়েদের বোঝাতে যে, আজকের তরুণদের মানসিকতা তাঁদের প্রজন্মের থেকে আলাদা।
গাও বলেন, “আমাদের সময়ে মানুষ অনেক কিছু মেনে নিত। এখনকার তরুণরা ভাবে—‘আমি কেন মানিয়ে নেব?’”
চীনে এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন এখন এক সামাজিক সংকটের ইঙ্গিত দিচ্ছে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে দেশে মাত্র ৬১ লাখ দম্পতি বিয়ে নিবন্ধন করেছেন—আগের বছরের তুলনায় ২১% কম এবং ইতিহাসের সর্বনিম্ন। ফলে জন্মহারও হ্রাস পাচ্ছে, যা দেশটির জনসংখ্যা সংকোচনের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
পার্কে ভিড় ও প্রোফাইল প্রদর্শনী
চংকিংয়ের পিপলস পার্কে এত ভিড় হয় যে প্রবীণরা হাঁটাচলার জায়গা খুঁজে পান না। বাবা-মায়েরা সন্তানদের জীবনী হাতে ধরে রাখেন, কেউ কেউ খোলা ছাতায় প্রোফাইল টাঙিয়ে রাখেন যেন প্রদর্শনী স্টল। সারি সারি লেমিনেটেড কাগজ মাটিতে বা দেওয়ালে লাগানো থাকে।
যে প্রোফাইল পছন্দ হয়, তাঁরা সঙ্গে সঙ্গে মোবাইল অ্যাপ উইচ্যাটে যোগাযোগ যোগ করেন।
এক তরুণীর প্রোফাইলে লেখা ছিল—তিনি মাসে প্রায় ৫৬০ ডলার আয় করেন, নিজস্ব বাড়ি ও গাড়ি আছে, এবং এমন কাউকে চান যাঁর বয়স ২৯ বছরের নিচে, উচ্চতা ৫ ফুট ৮ ইঞ্চির কম, ওজন প্রায় ৬৫ কেজি এবং ‘খারাপ অভ্যাস নেই’।
তার কাছেই থাকা এক তরুণের প্রোফাইলে উল্লেখ ছিল—তিনি কলেজ ডিগ্রিধারী, ট্যাটু নেই, এবং ‘অতিরিক্ত মোটা নন’—যা মেয়েটির শর্তের সঙ্গে বেশ সামঞ্জস্যপূর্ণ।
এক সন্তান নীতির পরিণতি
চীনের দীর্ঘদিনের এক সন্তান নীতি এখন নতুন প্রজন্মের প্রেম ও বিবাহে ভারসাম্যহীনতা তৈরি করেছে। ঐতিহ্যগতভাবে ছেলেশিশুর প্রতি সামাজিক পক্ষপাতের কারণে দেশে পুরুষের সংখ্যা নারীর তুলনায় অনেক বেশি। অন্যদিকে একমাত্র কন্যা সন্তানরা তুলনামূলক ভালো শিক্ষা ও সম্পদ পেয়েছে, ফলে তাঁদের প্রত্যাশাও বেড়েছে।
তরুণদের অভিজ্ঞতা
৩৪ বছর বয়সী বিক্রয়কর্মী ঝাং জিং চংকিংয়ের এই বিবাহবাজারে এসেছিলেন নিজের জন্য স্বামী খুঁজতে। তাঁর শর্ত—৩৪ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে, ৫ ফুট ৭ ইঞ্চির বেশি উচ্চতা, সন্তান নেই, স্থায়ী চাকরি এবং নিজস্ব বাড়ি থাকতে হবে।
তিনি বলেন, “আমরা বেছে বেছে দেখি বলে অনেকে ভাবে আমরা খুঁতখুঁতে। আসলে অনেক পুরুষই যোগ্য নয়।”

৩৬ বছর বয়সী হুয়াং ওয়েইমিং প্রথমবার এসেছিলেন টিকটকের চীনা সংস্করণ দোইনের একটি ভিডিও দেখে। তাঁর নিজের বিবরণ—উচ্চতা ৫ ফুট ৭ ইঞ্চি, নিজস্ব বাড়ি ও গাড়ি আছে, মার্কেটিংয়ে কাজ করেন, বার্ষিক আয় প্রায় ১৭ হাজার ডলার।
তাঁর শর্ত: “পাতলা হতে হবে,” একটু ভেবে তিনি যোগ করলেন, “আর আমার মূল্যবোধের সঙ্গে মিল থাকতে হবে।”
অনলাইন ডেটিং প্ল্যাটফর্ম Zhenai.com-এ তিনি আগে চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সেখানে ৩,০০০ ডলার মূল্যের প্যাকেজ দেখে পিছু হটেন। তিনি বলেন, “যদি কেউ এত টাকা দিতে রাজি থাকে, তবে তাঁর চাহিদা নিশ্চয়ই অনেক বেশি।”
প্রবীণদের সামাজিক আড্ডা
যদিও এই বিবাহবাজার থেকে সফলতার গল্প খুব কমই শোনা যায়, তবু পার্কটি প্রতি সপ্তাহে জমজমাট থাকে। অনেকেই বলেন, এটি কেবল পাত্র-পাত্রী খোঁজার জায়গা নয়, বরং প্রবীণদের সামাজিক আড্ডারও কেন্দ্র।
কেউ কেউ মজা করে বলেন, “আমার ছেলে তো বিয়ে করে ফেলেছে, তবু এখানে আসি, বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হয়।”
দুপুর নাগাদ পার্ক ফাঁকা হতে শুরু করে। ঝাং জিং কয়েকজনের সঙ্গে উইচ্যাটে যোগাযোগ করলেও তেমন আশাব্যঞ্জক কিছু পাননি।
সেদিনের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তিনি বললেন, “খুব একটা ভালো নয়।”
#চীন,# বিবাহবাজার, #চংকিং, #এক সন্তান নীতি, #তরুণ প্রজন্ম#, সমাজ ও সংস্কৃতি, #সারাক্ষণ রিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 

















