জাপানের শতাব্দীপ্রাচীন ম্যাচা চা ঐতিহ্য একসময় ছিল সৌন্দর্য, শ্রদ্ধা, বিশুদ্ধতা ও শান্তির প্রতীক। কিন্তু বিশ্বজুড়ে হঠাৎ শুরু হওয়া “ম্যাচা ক্রেজ” এই চার নীতির জায়গায় এনে দিয়েছে বিশৃঙ্খলা, অনৈতিকতা ও প্রতারণা। জাপানের ঐতিহ্যবাহী চা প্রস্তুতকারীরা এখন লড়ছেন নকল ও অতিমূল্য বিক্রির বিরুদ্ধে, আর বাজারজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে নিম্নমানের পাউডার ও মিথ্যা লেবেলযুক্ত “প্রিমিয়াম” পণ্য।
ঐতিহ্যের শেকড় ও আধুনিক বিপর্যয়
ম্যাচা তৈরির ঐতিহ্য চার শতাব্দী পুরোনো। “ওয়া, কেই, সেই, জাকু”—এই চার নীতির ওপর দাঁড়িয়ে ছিল চা সংস্কৃতি: সামঞ্জস্য, শ্রদ্ধা, বিশুদ্ধতা ও প্রশান্তি।
তবে আজকের বাস্তবতা ভিন্ন। টিকটকের প্রভাবে ম্যাচা এখন বিশ্বজোড়া “ফ্যাশন ড্রিঙ্ক”—ক্যাফেগুলোর মেন্যুতে কফিকে টপকিয়ে এগিয়ে গেছে। জাপানের মোট চা উৎপাদনের মাত্র ৬ শতাংশ ম্যাচা হলেও এখন তার অর্ধেকের বেশি রপ্তানি হচ্ছে বিদেশে। যুক্তরাষ্ট্রে গত তিন বছরে ম্যাচার বিক্রি বেড়েছে ৮৬ শতাংশ।
নকল পণ্য ও জাপানি ব্র্যান্ডের সংকট
জাপানের খ্যাতনামা ব্র্যান্ড মারুকিউ কায়ামায়েন (Marukyu Koyamaen), যার ইতিহাস ১৭০৪ সাল থেকে, আট বছর ধরে আদালতে লড়ছে নকল পণ্যের বিরুদ্ধে। তাদের নাম ব্যবহার করে বাজারে ছড়াচ্ছে নিম্নমানের পাউডার চা। কোম্পানির প্রেসিডেন্ট মটোয়া কায়ামা জানিয়েছেন, “যদি কেউ এই নকল পণ্য কিনে মনে করে এটি আমাদের তৈরি, তবে তা আমাদের সুনামের জন্য ভয়ানক ক্ষতি।”
অন্যদিকে, অনলাইনে “ইম্পেরিয়াল গ্রেড”, “বারিস্টা গ্রেড” বা “সেরিমোনিয়াল গ্রেড”-এর মতো নতুন লেবেল দেখা যাচ্ছে, যেগুলোর কোনো আনুষ্ঠানিক মানদণ্ডই নেই। ফলে ভোক্তারা বুঝতে পারছেন না কোনটি আসল, কোনটি বাজারজাত কৌশল।
নতুন বাজারে বাড়ছে বিকৃতি ও অপ্রচলিত প্রথা
অনেক ক্যাফে এখন হাতে ফেটানো ম্যাচার বদলে ব্যবহার করছে তৈরি কনসেন্ট্রেট বা “ব্যাচা”—যা ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পূর্ণ বেমানান। এমনকি কিছু পানীয়তে যুক্ত হচ্ছে কলার স্বাদ বা চকলেটের ফ্লেভার!
বারিস্টারা মজা করে বলেন, “দিনভর এত পাউডার নিঃশ্বাসে নিচ্ছি যে ‘ম্যাচা লাং’ হয়ে যাবে!”
জাপানের বাইরে বাণিজ্যিক বিস্তার
ম্যাচা এখন কেবল জাপানের নয়। অস্ট্রেলিয়া, কেনিয়া, চীন ও দক্ষিণ কোরিয়াতেও তৈরি হচ্ছে পাউডার চা, যেগুলো একই নামে বিক্রি হচ্ছে। স্টারবাকস তাদের ম্যাচা কিনছে একাধিক দেশ থেকে।
এক মার্কিন চা আমদানিকারক বলেন, “এখন পরিস্থিতি ওয়াইল্ড ওয়েস্টের মতো—অনিশ্চয়তা আর নতুন প্রতিযোগীতে ভরা।”
শহরজুড়ে ‘ম্যাচাকোর’ সংস্কৃতি
লস অ্যাঞ্জেলেস, লন্ডন, নিউইয়র্ক—সবখানে নতুন নতুন ম্যাচা ক্যাফে গজিয়ে উঠছে। ব্ল্যাঙ্ক স্ট্রিট নামের একটি চেইন নিজেদের নাম থেকে “কফি” শব্দটাই বাদ দিয়েছে, কারণ এখন তাদের অর্ধেক বিক্রিই ম্যাচা-ভিত্তিক পানীয়।
বন্ড স্ট্রিটে “১২ ম্যাচা”, ইস্ট ১০থ স্ট্রিটে “ম্যাচা হাউস”, ব্লিকার স্ট্রিটে “আওকো ম্যাচা”—প্রতিটি জায়গায়ই ভিড় উপচে পড়ছে।
সরবরাহ ঘাটতি ও কৃষকদের উদ্বেগ
সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত “ফার্স্ট ফ্লাশ” ম্যাচা আসে বসন্তের প্রথম চা-পাতা থেকে, যা সবচেয়ে মিষ্টি ও সুগন্ধি। কিন্তু এর সরবরাহ সীমিত। “ম্যাচাফুল” প্রতিষ্ঠাতা হান্না হ্যাবস বলেন, “প্রথম ফ্লাশের ঘাটতি এখন বড় সমস্যা।”
বড় কোম্পানিগুলো যেখানে গুণমান কমিয়ে উৎপাদন বাড়াচ্ছে, সেখানেই ক্ষুদ্র চাষিরা ঐতিহ্য রক্ষা করতে হিমশিম খাচ্ছেন।
রন্ধনশৈলীতে ম্যাচার অপব্যবহার
বিশেষজ্ঞদের মতে, নিম্নমানের বা “কুলিনারি গ্রেড” ম্যাচা ব্যবহার করা উচিত চকলেট, ব্রাউনি বা মিষ্টি পানীয়তে। কিন্তু অনেক ক্যাফে প্রিমিয়াম ম্যাচা দিয়ে লাটে তৈরি করছে, যা এক বিশেষজ্ঞের ভাষায় “রেড বারগান্ডি ওয়াইন দিয়ে স্যাংরিয়া বানানোর মতো।”
ঐতিহ্যের অবক্ষয় ও সাংস্কৃতিক উদ্বেগ
জাপানি চা-অনুষ্ঠান চাডো—অর্থাৎ “চায়ের পথ”—একটি আধ্যাত্মিক অনুশীলন, যার জন্য বছরের পর বছর সাধনা লাগে। ইউরাসেনকে লস অ্যাঞ্জেলেসের প্রতিনিধি অ্যান আবে বলেন, “বিশ্বে ম্যাচার প্রতি আগ্রহ ভালো লাগছে, কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জানেই না, এক বাটি চায়ের পেছনে কত ইতিহাস ও শৃঙ্খলা লুকিয়ে আছে।”
ম্যাচা আজ বৈশ্বিক বাজারে এক “সবুজ বিপ্লবের” প্রতীক হলেও এর জনপ্রিয়তা ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির জন্য এক দ্বিধার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একদিকে ক্রমবর্ধমান চাহিদা, অন্যদিকে নকল, নিম্নমান ও বাণিজ্যিক বিকৃতি—এই দুই মেরুর টানাপোড়েনে হারিয়ে যাচ্ছে জাপানের শতাব্দীপ্রাচীন চা-দর্শনের সৌন্দর্য ও প্রশান্তি।
# জাপান,# ম্যাচা,# চা-সংস্কৃতি,# নকল পণ্য,# ঐতিহ্য,# বৈশ্বিক বাজার, #খাদ্য শিল্প, #সারাক্ষণ রিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















