প্রয়োজনীয় কিন্তু সীমিত এক ভারসাম্য
মানুষের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় ঘুম অপরিহার্য। ঠিক পরিমাণ ঘুম মস্তিষ্ককে পুনরুজ্জীবিত করে, মনোযোগ বাড়ায়, স্মৃতি তীক্ষ্ণ করে এবং সৃজনশীল চিন্তাকে সক্রিয় রাখে। কিন্তু যখন ঘুম প্রয়োজনের সীমা ছাড়িয়ে যায়—যেমন ৮ থেকে ৯ ঘণ্টার বেশি নিয়মিত ঘুমানো—তখন এর ফলাফল উল্টো দিকেই চলে যায়।
অতিরিক্ত ঘুমের প্রভাব: মস্তিষ্কের ‘ওভাররেস্টিং’
গবেষণায় দেখা গেছে, যারা প্রতিদিন দীর্ঘ সময় ঘুমান, তাদের মস্তিষ্কে একধরনের ‘ওভাররেস্টিং’ বা অতিরিক্ত বিশ্রাম প্রক্রিয়া শুরু হয়। এই অবস্থায় মস্তিষ্কের নিউরনগুলো কম সক্রিয় থাকে, চিন্তাভাবনার গতি কমে যায়, এবং সৃজনশীল ধারণাগুলো জন্ম নেওয়ার পরিবর্তে স্থবির হয়ে পড়ে।
মস্তিষ্কের সৃজনশীল অংশ—বিশেষত প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স—অতিরিক্ত বিশ্রামের কারণে তার স্বাভাবিক ‘স্পার্ক’ হারাতে শুরু করে। ফলে নতুন আইডিয়া বা অনন্য সমাধান ভাবার প্রবণতা দুর্বল হয়ে যায়।

সৃজনশীলতা কেন ভারসাম্য চায়
সৃজনশীলতা হলো বিশ্রাম ও উদ্দীপনার মাঝামাঝি এক অবস্থান। অতিরিক্ত ক্লান্তি যেমন সৃজনশীলতাকে রুদ্ধ করে, তেমনি অতিরিক্ত বিশ্রামও সেটিকে নিস্তেজ করে দেয়।
অল্প ঘুম আমাদের কল্পনাশক্তিকে ক্লান্ত করে ফেলে, কিন্তু অতিরিক্ত ঘুম মস্তিষ্কের “জেগে ওঠার সময়” বিলম্বিত করে। এতে আইডিয়া ভাবা বা কাজের শুরুতে যে দ্রুত মনোযোগ দরকার, তা পাওয়া যায় না। অনেক সময় “সকালের সেরা ভাবনাগুলো” হারিয়ে যায়, কারণ মস্তিষ্ক তখনও আধা-ঘুমন্ত অবস্থায় থাকে।
গবেষণার ভাষায় অতিরিক্ত ঘুমের ফলাফল
হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের এক গবেষণায় দেখা গেছে, যারা নিয়মিত নয় ঘণ্টার বেশি ঘুমান, তাদের কগনিটিভ ফাংশন বা মানসিক প্রক্রিয়াগুলো ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে যায়। তারা দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না, মনোযোগ ধরে রাখতে পারেন না, এবং নতুন ধারণা উদ্ভাবনে পিছিয়ে পড়েন।
অন্যদিকে, যারা নিয়মিত ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা ঘুমান, তারা মানসিকভাবে সক্রিয়, দ্রুত চিন্তাশীল এবং সৃজনশীলতায় বেশি অগ্রসর।

সৃজনশীল মানুষদের ঘুমের ধরন
ইতিহাসে দেখা যায়, অনেক মহান সৃজনশীল ব্যক্তি—যেমন লিওনার্দো দা ভিঞ্চি, নিকোলা টেসলা বা সালভাদর দালি—অল্প কিন্তু কার্যকর ঘুমে অভ্যস্ত ছিলেন। তারা দিনে একাধিক ছোট ঘুম (power nap) নিয়ে মস্তিষ্ককে রিফ্রেশ করতেন। এর ফলে তাদের চিন্তা ছিল ধারালো, মনোযোগী এবং দ্রুতগামী।
অতিরিক্ত ঘুম থেকে মুক্তির উপায়
ঘুমের সময় নির্দিষ্ট করুন: প্রতিদিন একই সময়ে ঘুমাতে যান ও জেগে উঠুন।
দুপুরের ঘুম সীমিত করুন: ২০ থেকে ৩০ মিনিটের বেশি নয়।
বিছানায় অকারণে সময় কাটাবেন না: ঘুম না এলে উঠে হালকা কিছু করুন, বই পড়ুন বা হালকা ব্যায়াম করুন।
রাতের আগে স্ক্রিন টাইম কমান: এটি মেলাটোনিনের ক্ষরণে প্রভাব ফেলে, ঘুমের মান নষ্ট করে।

ঘুম নয়, ভারসাম্যই সৃজনশীলতার চাবিকাঠি
ঘুম সৃজনশীলতার শত্রু নয়—অতিরিক্ত ঘুমই সমস্যা। মস্তিষ্ককে যেমন বিশ্রাম দরকার, তেমনি প্রয়োজন উদ্দীপনাও। যথাযথ পরিমাণ ঘুমই আমাদের চিন্তার জগৎকে করে তোলে তাজা, কল্পনাশক্তিকে দেয় প্রাণ, আর সৃজনশীলতাকে রাখে জীবন্ত।
ঘুম, সৃজনশীলতা, মানসিক স্বাস্থ্য, মস্তিষ্ক, গবেষণা, জীবনধারা, সারাক্ষণ রিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















