পরীক্ষামূলক উড্ডয়নে নতুন ইতিহাস
মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার উদ্ভাবিত নীরব সুপারসনিক জেট X-59 মঙ্গলবার দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার মরুভূমির আকাশে প্রথমবারের মতো উড়েছে। এই পরীক্ষামূলক বিমানটি শব্দের বেগ অতিক্রম করেও খুব কম শব্দ উৎপন্ন করার জন্য তৈরি করা হয়েছে, যা ভবিষ্যতে দ্রুত বাণিজ্যিক বিমানযাত্রার পথ প্রশস্ত করতে পারে।
বিমানটি নির্মাণ করেছে লকহিড মার্টিন, যারা নাসার জন্য এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। ভোরের কিছু পর, লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার উত্তরে পালমডেলের স্কাঙ্ক ওয়ার্কস ফ্যাসিলিটি থেকে বিমানটি উড্ডয়ন করে।
নিরাপদে অবতরণ ও উড্ডয়নের পথ
রানওয়ে থেকে খাড়া উড্ডয়নের পর বিমানটি উত্তরের দিকে ঘুরে এডওয়ার্ডস এয়ার ফোর্স বেসে যায় এবং প্রায় এক ঘণ্টা পর নাসার আর্মস্ট্রং ফ্লাইট রিসার্চ সেন্টারের কাছাকাছি নিরাপদে অবতরণ করে। উড্ডয়নের পুরো সময় এটি নাসার একটি অনুসারী বিমানের সঙ্গে ছিল।

শব্দ নিয়ন্ত্রণে প্রযুক্তির সাফল্য
X-59-এর নকশাটি বিশেষভাবে এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যাতে এটি শব্দের বেগ অতিক্রমের সময় প্রচলিত ‘সোনিক বুম’ বা বিস্ফোরণধ্বনি না করে বরং একটি নরম ‘সোনিক ঠক্’ শব্দ তৈরি করে—যা গাড়ির দরজা বন্ধ করার মতোই স্বল্পমাত্রার শব্দ।
নাসা ও লকহিডের মতে, এই প্রযুক্তি এমন এক বড় সমস্যার সমাধান করতে পারে, যা অতিস্বনক বাণিজ্যিক বিমানের উড্ডয়নকে দীর্ঘদিন ধরে সীমিত রেখেছিল—স্থলভাগের ওপর দিয়ে উড্ডয়নের সময় অতিরিক্ত শব্দদূষণ।
ব্যয়বহুল কিন্তু যুগান্তকারী প্রকল্প
২০১৮ সাল থেকে X-59 প্রকল্পে নাসা ইতিমধ্যেই ৫১৮ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে। এক ইঞ্জিনবিশিষ্ট এই বিমানের দৈর্ঘ্য প্রায় ৩০ মিটার এবং এর প্রথম উড্ডয়নটি ছিল পরিকল্পনামাফিক সাবসনিক গতিতে। এটি ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৩৭০ কিলোমিটার বেগে ও ১২ হাজার ফুট (৩,৬৬০ মিটার) উচ্চতায় উড়েছিল।
প্রায় ২০০ জন এয়ারোস্পেস কর্মী ও তাদের পরিবার নিরাপদ দূরত্ব থেকে মহাসড়কের পাশে দাঁড়িয়ে ঐতিহাসিক এই উড্ডয়ন প্রত্যক্ষ করেন।
নাসা ও লকহিডের প্রতিক্রিয়া
লকহিড মার্টিনের মুখপাত্র ক্যান্ডিস রুসেল এক বিবৃতিতে জানান, “X-59 আজ সকালে সফলভাবে প্রথম উড্ডয়ন সম্পন্ন করেছে—এটি বিমান চলাচলের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।”

নাসার প্রধান পরীক্ষামূলক পাইলট নিলস লারসন একক ককপিট থেকে এই বিমানের নিয়ন্ত্রণে ছিলেন।
ভবিষ্যৎ উড্ডয়নের পরিকল্পনা
এই এক্সপেরিমেন্টাল বিমানটি পূর্ণ সক্ষমতায় পৌঁছালে এটি ম্যাক ১.৪ গতিতে (১,৪৯০ কিমি/ঘণ্টা), অর্থাৎ শব্দের গতির চেয়ে দ্রুত বেগে ৫৫,০০০ ফুট (১৬,৭৬৪ মিটার) উচ্চতায় ভ্রমণ করতে পারবে।
লকহিড জানায়, X-59 থেকে সংগৃহীত তথ্য ভবিষ্যতে অতিস্বনক বিমানের জন্য নতুন শব্দমাত্রা নির্ধারণে সহায়তা করবে।
কনকর্ডের পর নতুন যুগ
১৯৭৬ সালে কনকর্ড প্রথম বাণিজ্যিকভাবে অতিস্বনক যাত্রীবাহী ফ্লাইট চালু করেছিল। কিন্তু উচ্চ ব্যয়, সীমিত আসনসংখ্যা, ২০০০ সালের মারাত্মক দুর্ঘটনা ও ২০০১ সালের ৯/১১ হামলার পর যাত্রীসংখ্যা কমে যাওয়ায় ২০০৩ সালে এটি বন্ধ হয়ে যায়।
নাসা জানিয়েছে, X-59-এর প্রথম উড্ডয়ন মূলত ছিল কম উচ্চতায় ৩৮৬ কিমি/ঘণ্টা গতিতে সিস্টেমের স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা যাচাইয়ের জন্য। পরবর্তী পর্যায়ে এটি ধীরে ধীরে উচ্চতা ও গতি বাড়াবে এবং অবশেষে শব্দের বেগ অতিক্রম করবে।
মার্কিন উদ্ভাবনের গৌরব
এই মাসের শুরুতে ক্যালিফোর্নিয়া ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড টেকনোলজি অ্যাসোসিয়েশন X-59-কে ২০২৫ সালের “ক্যালিফোর্নিয়ার সবচেয়ে চমকপ্রদ উদ্ভাবন” হিসেবে ঘোষণা করে।

মার্কিন পরিবহন সচিব ও নাসার ভারপ্রাপ্ত প্রশাসক শন ডাফি বলেন, “এই কাজটি যুক্তরাষ্ট্রকে বিমান প্রযুক্তিতে নেতৃত্ব ধরে রাখতে সাহায্য করবে এবং সাধারণ মানুষের উড়োজাহাজে ভ্রমণের ধরণ বদলে দিতে পারে।”
নাসার নীরব সুপারসনিক বিমান X-59 কেবল একটি প্রযুক্তিগত কৃতিত্ব নয়, বরং এটি ভবিষ্যতের শব্দনিয়ন্ত্রিত অতিদ্রুত বাণিজ্যিক ফ্লাইটের সম্ভাবনাকে আরও বাস্তবের কাছাকাছি নিয়ে এসেছে।
#নাসা, X-59, #সুপারসনিক,# লকহিড মার্টিন,# ক্যালিফোর্নিয়া,# বিমান প্রযুক্তি,# যুক্তরাষ্ট্র
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















