বাংলাদেশে ইলিশ সবসময় উৎসবের মাছ হিসেবে পরিচিত, কিন্তু এখন গরুর মাংসের দামই মানুষের সবচেয়ে বড় উদ্বেগের কারণ। কারণ এটি কেবল উৎসব নয়, বরং প্রতিদিনের খাবার ও প্রোটিনের অন্যতম উৎস। দামের লাগামছাড়া বৃদ্ধিতে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারগুলো আরও চাপে পড়েছে।
প্রতিদিনের খাবারের চিন্তা: কেন গরুর মাংসের দাম বেশি আলোচিত
বাংলাদেশে যখন বাজারে পণ্যের দাম বাড়ে, তখন সাধারণত ইলিশের দাম নিয়েই বেশি আলোচনা হয়। কিন্তু এবার চিত্রটি আলাদা—ইলিশের দাম যেমন বেড়েছে, তার চেয়ে বেশি উদ্বেগ তৈরি করেছে গরুর মাংসের মূল্যবৃদ্ধি।
কারণ, ইলিশ যদিও উৎসবের বা বিশেষ দিনের মাছ, গরুর মাংস এখন বহু পরিবারের দৈনন্দিন বা সাপ্তাহিক প্রোটিনের অন্যতম উৎস। তাই এই দামের প্রভাব সরাসরি পড়ছে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষের রান্নাঘরে।
ইলিশ বিলাস, গরুর মাংস ছিল নিয়মিত চাহিদা
ইলিশের দাম সব সময়ই কিছুটা উঁচু থাকে, এবং সেটি ‘বিলাসী’ খাদ্য হিসেবেই ধরা হয়। বেশিরভাগ মানুষ বছরে কয়েকবারই ইলিশ খান—বর্ষা বা উৎসবের মৌসুমে।
কিন্তু গরুর মাংস একসময় “সাপ্তাহিক প্রোটিন” ছিল—শুক্রবারের বাজারে এক কেজি মাংস কিনে পরিবারে ভাগাভাগি করে খাওয়া হতো। এখন সেই এক কেজি মাংসের দাম ৯০০ থেকে ১,০০০ টাকায় পৌঁছেছে। ফলে এই নিয়মিত খাদ্যটিই আজ বিলাসের কাতারে চলে গেছে।

দামের পেছনের কারণ: উৎপাদন খরচ থেকে সিন্ডিকেট
গরুর মাংসের দামের ঊর্ধ্বগতির পেছনে রয়েছে একাধিক কারণ—
খামারিদের ব্যয় বৃদ্ধি: গোখাদ্য, ওষুধ, ভ্যাকসিন ও শ্রমের খরচ ৩০–৪০ শতাংশ বেড়েছে।
জ্বালানি ও পরিবহন খরচ: পশু পরিবহনের খরচ দ্বিগুণ হয়েছে, যা সরাসরি মাংসের দামে যোগ হচ্ছে।
মধ্যস্বত্বভোগীর প্রভাব: পাইকার ও দালালচক্র বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে, ফলে খামারি ও ক্রেতা—দু’জনই ক্ষতিগ্রস্ত।
সরবরাহ ঘাটতি: কোরবানির পর দেশে পশুর সংখ্যা সাময়িকভাবে কমে যায়, ফলে দাম দ্রুত বাড়ে।
অন্যদিকে, ইলিশের ক্ষেত্রে সরবরাহ মৌসুমি হলেও সরকারি নিষেধাজ্ঞা শেষে জেলেরা কিছুটা নিয়ন্ত্রণে রাখে। কিন্তু গরুর মাংসের দাম বাড়লে বিকল্পের অভাবে সাধারণ মানুষ তাতেই কষ্ট পায়।
কেন গরুর মাংসের দাম বৃদ্ধি বেশি প্রভাব ফেলছে
দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে সম্পর্ক: ইলিশ না খেলে ক্ষতি নেই, কিন্তু মাংস বা প্রোটিন ছাড়া খাদ্যতালিকা অসম্পূর্ণ থেকে যায়।
সব শ্রেণির ভোক্তা নির্ভর: শহর-গ্রাম—সব শ্রেণির মানুষ গরুর মাংস খায়; তাই প্রভাবের পরিধি বড়।
বিকল্পের সংকট: দেশীয় মাছ বা মুরগির দামও বেড়ে যাওয়ায় বিকল্প প্রোটিন পাওয়া কঠিন।
পুষ্টিহীনতার আশঙ্কা: নিয়মিত মাংস না খেতে পারায় শিশু ও বৃদ্ধদের পুষ্টিহীনতা বাড়ছে।

বাজারে সাধারণ মানুষের অভিমত
মিরপুরের গৃহিণী রুবিনা আক্তার বলেন, “ইলিশ তো ঈদের সময় খাই, কিন্তু এখন গরুর মাংসও আর কেনা যায় না। বাচ্চাদের জন্য সামান্য মাংস কিনতে গেলেও হাজার টাকা লেগে যায়।”
খিলগাঁওয়ের দোকানদার হাসান মিয়া বলেন, “মানুষ এখন মাংস কিনতে আসে, দাম শুনে শুধু মাথা নাড়ে। অনেকে আধা কেজিও কিনতে পারছে না।”
অর্থনীতিবিদদের দৃষ্টিতে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. নাসির হোসেন বলেন, “ইলিশ বিলাসবহুল পণ্য, তাই দামের প্রভাব সীমিত। কিন্তু গরুর মাংসের দাম বৃদ্ধি জীবনযাত্রার সূচককে সরাসরি আঘাত করে। এটি খাদ্য নিরাপত্তার ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।”
ইলিশের দাম বাড়া হয়তো বাংলাদেশের মানুষ মেনে নিতে পারে, কারণ সেটি উৎসবের আনন্দের অংশ। কিন্তু গরুর মাংসের দাম বেড়ে যাওয়া মানে প্রতিদিনের খাবারে ঘাটতি, প্রোটিনের অভাব, আর পুষ্টিহীনতার ঝুঁকি।
তাই মানুষের উদ্বেগ এখন ইলিশ নয়—তাদের রান্নাঘরের হাঁড়িতে প্রোটিন ফিরিয়ে আনার লড়াই নিয়ে।
#গরুরমাংস #ইলিশ #বাজারদর #পুষ্টিহীনতা #মধ্যবিত্তসংকট #খাদ্যনিরাপত্তা #বাংলাদেশঅর্থনীতি #সারাক্ষণরিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















