ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত খুলনার বাণিজ্যিক প্রাণকেন্দ্র ব্যস্ত থাকে মানুষের কোলাহল আর কেনাবেচার ধ্বনিতে। প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার লেনদেন হয় এসব বাজারে। কিন্তু এই ব্যস্ততার আড়ালে জমে উঠছে এক ভয়ংকর ঝুঁকি—আগুন।
খুলনা শহরের অন্তত ২৩টি ছোট-বড় বাজারে ন্যূনতম অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকায় তীব্র ঝুঁকি তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। সরু প্রবেশপথ, অপরিকল্পিত দোকান বিন্যাস, এলোমেলো বৈদ্যুতিক তার আর অগ্নিনির্বাপণের সরঞ্জামের অভাব শহরের ব্যস্ততম বাজারগুলোকে সম্ভাব্য মৃত্যুফাঁদে পরিণত করেছে।
অপরিকল্পিত বিস্তার আর নীরব বিপদ
বছরের পর বছর ধরে এসব বাজার গড়ে উঠেছে কোনো সুস্পষ্ট পরিকল্পনা ছাড়াই। উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, ফায়ার সার্ভিস বা সংশ্লিষ্ট সংস্থার অনুমোদন না থাকায় সামান্য একটি স্ফুলিঙ্গও ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে রূপ নিতে পারে। এতে যেমন বিপুল আর্থিক ক্ষতি হবে, তেমনি ঝুঁকিতে পড়বে অসংখ্য মানুষের জীবন।
ব্যবসায়ীদের নিত্যদিনের আতঙ্ক
বাজারের ব্যবসায়ীদের কাছে ভয় এখন প্রতিদিনের সঙ্গী। বড় বাজারের এক কাপড় ব্যবসায়ী জানান, প্রতিদিন দোকান খুলতে হয় আতঙ্ক নিয়ে। সরু গলি আর গাদাগাদি দোকানের ভিড়ে সামান্য আগুনেই সব শেষ হয়ে যেতে পারে। সড়ক প্রশস্ত করার দাবি বহুবার তোলা হলেও বাস্তব অগ্রগতি নেই।
নতুন বাজার, সুহরাওয়ার্দী বিপণি বিতান, হরোজ মার্কেট ও ভৈরব স্ট্যান্ড সড়কের বাজারগুলোর ব্যবসায়ীরাও একই উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। মসলাপট্টির এক মসলা ব্যবসায়ী বলেন, বারবার অনুরোধ করেও বাজারের রাস্তা প্রশস্ত করা হয়নি। মাঝে মাঝে ফায়ার সার্ভিস এসে কিছু নির্দেশনা দেয়, তাই খুব সতর্ক হয়ে ব্যবসা চালাতে হয়।
বাজারের ভেতরে জমে থাকা বিপর্যয়
খান জাহান আলী হকার্স মার্কেটের ভেতরের চিত্র আরও ভয়াবহ। চার থেকে পাঁচ ফুট চওড়া গলিতে দুই পাশে দোকান, কোথাও পণ্য ছড়িয়ে পড়েছে চলাচলের পথে। মাথার ওপর ঝুলে আছে খোলা বৈদ্যুতিক তারের জট। ব্যস্ত সময়ে চলাচলই কষ্টকর হয়ে ওঠে। এমন পরিস্থিতিতে আগুন লাগলে বের হওয়ার পথ প্রায় থাকবেই না।
এই চিত্র শুধু একটি বাজারের নয়। ফায়ার সার্ভিসের মতে, খুলনার প্রায় সব বড় বাণিজ্যিক এলাকায় একই রকম ঝুঁকি বিরাজ করছে।

ফায়ার সার্ভিসের চ্যালেঞ্জ
খুলনা ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক জানান, মহানগরের অন্তত ২৩টি বাজারকে উচ্চঝুঁকির তালিকায় রাখা হয়েছে। এসব স্থানে আগুন লাগলে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঢোকানোই কঠিন হয়ে পড়ে। প্রশিক্ষণ ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন ছাড়া দুর্ঘটনা ঠেকানো সম্ভব নয়।
তার মতে, এলোমেলো বৈদ্যুতিক তার, সরু গলি, অগ্নিনির্বাপণ সরঞ্জামের অভাব ও পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থা না থাকাই ঝুঁকির মূল কারণ। বিভিন্ন দপ্তরের সমন্বয় সভায় এসব বিষয় তোলা হয়েছে, সবার সম্মিলিত উদ্যোগে পরিস্থিতির উন্নতি আশা করা হচ্ছে।
প্রশাসনের আশ্বাস
জেলা প্রশাসন বলছে, ঝুঁকিপূর্ণ বাজারগুলোর তালিকা ধরে ফায়ার সার্ভিস ও ব্যবসায়ী সংগঠনের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ চলছে। প্রশিক্ষণ ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম শুরু হয়েছে বলেও জানিয়েছে প্রশাসন, যদিও চ্যালেঞ্জের ব্যাপকতা স্বীকার করা হয়েছে।
পরিকল্পনাবিদদের সতর্কবার্তা

নগর পরিকল্পনাবিদরা মনে করছেন, শুধু সচেতনতা যথেষ্ট নয়। শহরের কেন্দ্রস্থলে কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই এসব বাজার গড়ে উঠেছে। সিটি করপোরেশন, উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, বিদ্যুৎ বিভাগ, ফায়ার সার্ভিস ও পানি সরবরাহ সংস্থার সমন্বিত ও দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে বড় ধরনের বিপর্যয় অনিবার্য হতে পারে।
তাঁদের মতে, অবিলম্বে সরু সড়ক প্রশস্ত করতে হবে, বৈদ্যুতিক কেবল মাটির নিচে নিতে হবে এবং প্রতিটি বাজারে পর্যাপ্ত পানি ও অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
সময় ফুরিয়ে আসছে
সতর্কবার্তা ইতিমধ্যেই স্পষ্ট। ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে খুলনা জেলায় ছোট-বড় মিলিয়ে ২৯১টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নয়ন ছাড়াই বাজারগুলো ওপর-নিচে বিস্তৃত হতে থাকায় প্রতিদিনই ঝুঁকি বাড়ছে।
হাজারো ব্যবসায়ী ও ক্রেতার জীবনে খুলনার বাজারগুলো এখনো প্রাণবন্ত। তবে সেই প্রাণচাঞ্চল্যের নিচেই লুকিয়ে আছে ভয়ংকর এক অগ্নিঝুঁকি, যা যে কোনো সময় বড় বিপর্যয়ে রূপ নিতে পারে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















