সদ্য শেষ হওয়া ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে তিন ম্যাচ টি-২০ সিরিজের তিনটিতেই হেরেছে বাংলাদেশ, এর মাঝে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের একমাত্র পারফর্মার তানজিদ হাসান তামিমকে নিয়ে আলোচনা চলছে। হোয়াইটওয়াশ হওয়া সিরিজে টানা দুই ম্যাচে অর্ধশতক পেয়েছেন এই ওপেনার।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে তিন ম্যাচের টি–টোয়েন্টি সিরিজে হোয়াইটওয়াশ হয়েছে বাংলাদেশ।
ব্যর্থতার এই সিরিজেও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন ওপেনার তানজিদ হাসান তামিম। দল যখন টানা ব্যর্থতার মধ্য দিয়ে গেছে, তখন টানা দুই ম্যাচে অর্ধশতক তুলে দলের একমাত্র ধারাবাহিক পারফর্মার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তিনি।
তৃতীয় টি–টোয়েন্টিতে চট্টগ্রামে দলের ইনিংস সামলানোর দায়িত্ব নেন তানজিদ। শুরু থেকেই সঠিক শট সিলেকশনে মনোযোগী ছিলেন এই বাঁহাতি ওপেনার। ৬২ বলে ৮৯ রানের ঝলমলে ইনিংস খেলেও জয়ের হাসি দেখা হলো না বাংলাদেশের।
টপ–অর্ডারের ভালো সূচনার পরও নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারাতে থাকে দল। মিডল অর্ডার ও লোয়ার মিডল অর্ডার ব্যর্থ হওয়ায় চাপ ক্রমশ বাড়ে, ম্যাচের নিয়ন্ত্রণও হাতছাড়া হয়।
এমন পরাজয়ের পর স্বাভাবিকভাবেই তানজিদের মনে আক্ষেপ রয়ে গেছে, কারণ তাঁর ইনিংস ছিল ম্যাচ জয়ের মতো।
তবে হতাশার রাতেও ব্যক্তিগত অর্জনের মুকুট পরেছেন তানজিদ। ২০২৫ সালে ২৪ ইনিংসে তাঁর মোট রান দাঁড়িয়েছে ৭১১, যা এক ক্যালেন্ডার বছরে বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ টি–টোয়েন্টি রান।
এ বছর তাঁর স্ট্রাইক রেট ১৩৬, ফিফটি ৭টি। শুধু রান নয়, ৩৮টি ছক্কা মেরেও তিনি গড়েছেন আরেক অনন্য রেকর্ড, এক বছরে বাংলাদেশের জার্সিতে টি২০ ক্রিকেটে সর্বোচ্চ ছক্কা।
তানজিদ তামিম যেখানে এগিয়ে
জাতীয় দলে ওপেনার হিসেবে জায়গা পাকা করার লড়াই এখন বেশ প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। সাম্প্রতিক সময়ে একাধিক ওপেনার উঠে আসলেও ধারাবাহিক পারফর্মেন্সের কারণে নিজেদের আলাদাভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন তানজিদ হাসান তামিম। টানা রান পাওয়া তাঁকে যেমন আত্মবিশ্বাসী করছে, তেমনি ওপেনিংয়ে দীর্ঘমেয়াদি সম্ভাবনার বার্তাও দিচ্ছে।
এক দিক থেকে বাংলাদেশের সমসাময়িক পারফর্ম্যান্স বিচারে সেরা টি২০ ওপেনার তানজিদ তামিম এ কথা বলাই যায়।
মাত্র ২৫–এর কোঠায় বয়স, সামনে দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার সুযোগ রয়েছে তানজিদের সামনে।
নির্বাচক ও বিশেষজ্ঞদের অনেকে বিশ্বাস করছেন, ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ ওপেনিং ব্যাটিংয়ে তিনিই হতে পারেন সবচেয়ে বড় ভরসা।
তবে ব্যক্তিগত পরিসংখ্যান যতই সুন্দর হোক, ম্যাচ জেতাতে সক্ষম সেইসব ইনিংসের সংখ্যাই শেষ পর্যন্ত একজন ব্যাটারের আসল পরিচয় তৈরি করে। বিশেষ করে এমন ম্যাচে যেখানে দলের জয়ের জন্য তাঁর অবদানই হতে পারে নির্ধারক।
বাংলাদেশের ওপেনিং ব্যাটিং লাইনে দীর্ঘদিনের নির্ভরতা ছিলেন তামিম ইকবাল। তাঁর পরবর্তী উত্তরসূরি খুঁজতে গিয়ে নির্বাচকরা বেশ কিছু নাম সামনে আনলেও শেষ পর্যন্ত আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে আসেন আরেক ‘তামিম’, তানজিদ হাসান তামিম।
মোহাম্মদ নাঈম, রনি তালুকদার কিংবা সৌম্য সরকার- যারা সাম্প্রতিক সময়ে ওপেনার হিসেবে আসা-যাওয়া করেছেন, তাঁদের পেছনে ফেলে দীর্ঘমেয়াদে জায়গা দখলের দৌড়ে এগিয়ে আছেন তানজিদ। আশ্চর্য কাকতাল, তাঁর ডাকনামও “তামিম”।
অনেকেই বলেন, আক্রমণাত্মক মানসিকতায় বয়সের শুরুতে তামিম ইকবালের প্রতিচ্ছবি যেন তানজিদের মধ্যেও দেখা যায়।

তানজিদ হাসান তামিম
তানজিদ তামিমকে নিয়ে আক্ষেপ কোথায়
ক্রিকেট সাংবাদিক আফনান পিয়াল তানজিদ হাসান তামিম সম্পর্কে বলেন, “তামিমের মানের একজন ব্যাটার বড় দলের বিপক্ষে বা বড় মঞ্চে কীভাবে ব্যাটিং ভুলে যান এটাই আমাকে খুব ভাবায়”।
তার মতে, রান পেলেও বড় মঞ্চে খেলার জন্য যে মানসিক দক্ষতা লাগে সেখানে ঘাটতি আছে। শ্রীলঙ্কা বা ওয়েস্ট ইন্ডিজের মতো দলগুলোর বিপক্ষে বা দ্বিপাক্ষিক সিরিজে রান করছেন তামিম।
যেমন ৩৬ বলে ৫০ করার পর সাধারণত বড় দলের ওপেনাররা রানের গতি বাড়ান, সেখানে তানজিদ হাসান তামিম গত ম্যাচে করেছেন ৬২ বলে ৮৯।
তানজিদ তামিমের ব্যাটিং নিয়ে সন্তুষ্ট হলেও কিছু আক্ষেপের কথা বলেন তিনি।
“আপনি আন্তর্জাতিক যেকোনো ব্যাটারকে দেখবেন ৫৫-৬০ বল খেললে সেখানে ১০০ এর বেশি রান তুলে ফেলে।”
তানজিদ হাসান তামিমকে তিনি বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে ভালো বলছেন তবে আন্তর্জাতিক মান ছুঁতে এখনও লম্বা পথ পাড়ি দিতে হবে বলে মনে করছেন তিনি।
২০২৩ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলের অন্যতম ভরসা ছিলেন এই তরুণ ওপেনার। তবে নয় ম্যাচে মাত্র একটি অর্ধশতক এবং গড় ১৬.১১, প্রত্যাশার খাতায় খুব বেশি নম্বর তুলতে পারেননি তিনি।
বিশেষ করে অফ সাইডে ড্রাইভ করতে গিয়ে দ্রুত আউট হওয়ার প্রবণতা তাঁকে বারবার বিপদে ফেলেছে, বিশেষত বিশ্বমানের পেস বোলারদের বিপক্ষে।
তবে ভারতের বিপক্ষে পুনেতে করা তাঁর একমাত্র ফিফটি অনেকের নজর কেড়েছিল। শটের ঝুঁকি কমিয়ে, সীমিত স্ট্রোক ব্যবহার করেও সেইদিন তিনি ছিলেন স্বচ্ছন্দ। আর বিশ্বকাপ-পরবর্তী একমাত্র ওয়ানডেতে চট্টগ্রামে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ব্যাট হাতে ঝড় তুলেছিলেন ৮৪ রানে।
একটা আক্ষেপের তথ্য হচ্ছে বয়সভিত্তিক দল থেকে শুরু করে জাতীয় দল সব ফরম্যাটের ক্রিকেটের মাল্টিন্যাশনাল টুর্নামেন্টে ৩৫ ম্যাচ খেলে তানজিদ তামিমের অর্ধশতক মাত্র দুটি।
২০২৪ সালে টি–টোয়েন্টি ক্রিকেটে তানজিদের ফর্ম কিছুটা দোলাচলে ছিল।
জিম্বাবুয়ে সিরিজে দুটি হাফ-সেঞ্চুরি তাঁকে বিশ্বকাপ দলে জায়গা নিশ্চিত করে দেয়। বিপিএলে ২০২৪ মৌসুমে তিনি ছিলেন শীর্ষ রান সংগ্রাহকদের একজন, ১৩৫.৬৮ স্ট্রাইক রেটে ৩৮৪ রান।
কিন্তু টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপে মাত্র ৭ ইনিংসে ৭৬ রান, ধারাবাহিকতাই তানজিদ হাসান তামিমের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
টি২০ বিশ্বকাপের ইতিহাসে যেসব ওপেনার কমপক্ষে পাঁচ ম্যাচ খেলেছেন তাদের মধ্যে সর্বনিম্ন গড়ের তালিকায় ৪ নম্বরে আছেন তানজিদ হাসান তামিম- ১০.৭।
টি২০ ক্রিকেটে তানজিদ হাসান তামিম ১০০০ রান পার করেছেন গত ম্যাচেই, ৪২ ইনিংস খেলেছেন তিনি। যার মধ্যে ১০টি ফিফটি।
এই ১০ অর্ধশতকের মধ্যে এই সিরিজেরই ক্যারিবিয়ায়নদের বিপক্ষে দুটি, জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে দুটি, আফগানিস্তানের বিপক্ষে ২টি করে, এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, সংযুক্ত আরব আমিরাত, নেদারল্যান্ডস ও শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে একটি কটরে ফিফটি করেছেন তিনি।
ওয়ানডে ক্রিকেটে তানজিদ হাসান তামিমের পরিসংখ্যান বেশ করুণ। ২৭ ম্যাচ খেলার পর ২০ গড়ে ৫৫৮ রান তুলেছেন তিনি।
জাতীয় দলে উঠে আসা
বগুড়ায় জন্ম ও বেড়ে ওঠা তানজিদ হাসান তামিমের ক্রিকেট-যাত্রা শুরুটা মোটেই মসৃণ ছিল না। রাজধানী থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূরের এই শহরে খেলাধুলার সুযোগ থাকলেও
পেশাদার ক্রিকেটে ক্যারিয়ার গড়ার সিদ্ধান্ত তখনও অনেকের কাছে ঝুঁকিপূর্ণ। পরিবারের পক্ষ থেকেও প্রথমে সমর্থন মেলেনি।
বিশেষ করে তাঁর বাবাকে বোঝাতে বেশ সময় লেগেছিল যে ক্রিকেটই হতে পারে তার পেশা।
পরবর্তীতে আরও নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও সঠিক পরিবেশের সন্ধানে তিনি যোগ দেন রাজশাহীর বাংলা ট্র্যাক ক্রিকেট একাডেমিতে। সেখানে থেকে বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে ধারাবাহিক সাফল্য তাঁকে এনে দেয় নজর কাড়ার সুযোগ। ২০১৯ সালে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করে তিনি তরুণ প্রতিভাদের তালিকায় নিজের নামটা আরও স্পষ্টভাবে লিখিয়ে নেন।
বাংলাদেশের হয়ে অনূর্ধ্ব–১৯ বিশ্বকাপজয়ী দলের সদস্য ছিলেন তানজিদ। সেই টুর্নামেন্টে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে কোয়ার্টার–ফাইনালে ৮০ রানের গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস খেলে দলের সাফল্যে বড় ভূমিকা রাখেন তিনি। এই পারফরম্যান্সের পরই তাঁকে ভবিষ্যতের জাতীয় দলে ওপেনিংয়ের অন্যতম ভরসা হিসেবে বিবেচনা করা শুরু হয়।
শৈশব থেকেই তাঁর প্রিয় ক্রিকেটার তামিম ইকবাল।
বিবিসি নিউজ বাংলা
Sarakhon Report 



















