সয়াবিনের দামে রেকর্ড বৃদ্ধি
টোকিও থেকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র-চীন শীর্ষ বৈঠকের দিন বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিনের দামে হঠাৎ বড় উত্থান দেখা যায়। এই বৃদ্ধি মূলত প্রত্যাশা থেকে এসেছে যে, বেইজিং শিগগিরই আবারও মার্কিন সয়াবিন আমদানি শুরু করতে পারে।
এতে স্পষ্ট হয়, চীন দক্ষতার সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অন্যতম রাজনৈতিক দুর্বল জায়গা—আমেরিকান কৃষকদের—কৌশলগতভাবে ব্যবহার করছে।
শিকাগো বোর্ড অব ট্রেডে সয়াবিনের ভবিষ্যৎ চুক্তির দাম প্রতি বুশেলে ১১ ডলার ছাড়িয়ে গেছে, যা গত ১৫ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। ট্রেজারি সচিব স্কট ব্যাসেন্ট জানান, প্রাথমিক পর্যায়ের আলোচনায় চীন মার্কিন সয়াবিন আমদানি বাড়াতে সম্মত হয়েছে।
কৃষকদের ভোট ব্যাংকে আঘাত
বৈঠকের পর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ঘোষণা দেন, “সয়াবিনসহ কৃষিজ পণ্য ক্রয় অবিলম্বে শুরু হবে।” প্রথমে বাজারে সামান্য পতন এলেও পরক্ষণেই দাম আবার বেড়ে যায়।
মারুবেনি ইনস্টিটিউটের সিনিয়র গবেষক আইরি উরানো বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের মোট সয়াবিন রপ্তানির অর্ধেকই যায় চীনে। জাপানের মতো দেশগুলো যদি আমদানি বাড়ায়ও, তাতে এই ঘাটতি পূরণ হবে না।”
তিনি যোগ করেন, “চীন যদি আমদানি বাড়ায়, তা বাজারের জন্য ইতিবাচক হবে, তবে প্রভাব নির্ভর করবে ক্রয়ের পরিমাণের ওপর।”

ট্রাম্প নীতিতে কৃষকদের ‘পারফেক্ট স্টর্ম’
চীনের পাল্টা শুল্ক আরোপের পর মার্চে দাম নেমে আসে প্রতি বুশেলে ৯ ডলারে। এরপর চীন মার্কিন সয়াবিন বাদ দিয়ে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা থেকে সরবরাহ নেয়। সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে একটিও চালান যায়নি।
দামের পতনের পাশাপাশি ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্ক নীতির ফলে কাঁচামালের খরচ বেড়ে যায় এবং অভিবাসন নীতির কারণে শ্রম ঘাটতি দেখা দেয়।
ওয়াশিংটনভিত্তিক সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের বিশ্লেষক ফিলিপ লুক বলেন, “এটি মার্কিন কৃষকদের জন্য এক নিখুঁত ঝড়—সব দিক থেকেই ক্ষতির।”
আমেরিকান সয়াবিন অ্যাসোসিয়েশন জানায়, প্রতি বুশেলে উৎপাদন ব্যয় গড়ে ১২ ডলারেরও বেশি, ফলে কৃষকদের লোকসান দিন দিন বাড়ছে।
তাদের মতে, “চীনে রপ্তানি হ্রাসের ফলে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা মার্কিন বাজার দখল করেছে। কৃষকদের হতাশা এখন চরম।”
চীনের কৌশল: কৃষকদের অসন্তোষকে অস্ত্র বানানো
মার্কিন কৃষকরা ট্রাম্পের অন্যতম ভোটভিত্তি। তাদের অসন্তোষ ব্যবহার করে চীন অভ্যন্তরীণভাবে ট্রাম্প প্রশাসনের ওপর চাপ বাড়িয়েছে।
আগস্টে ট্রাম্প আশা প্রকাশ করেন, চীন যদি সয়াবিন আমদানি চারগুণ বাড়ায়, তবে বাজারে সাময়িক উত্থান হয়, কিন্তু পরে আবারও পতন ঘটে।

জ্বালানি বাজারেও চীনের পাল্টা চাল
শুধু কৃষিপণ্য নয়, জ্বালানিতেও যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরতা কমিয়েছে চীন। মার্চে তারা মার্কিন তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (LNG) আমদানি বন্ধ করে এবং জুনে বন্ধ করে দেয় অপরিশোধিত তেল ক্রয়।
এর পরিবর্তে তারা রাশিয়া ও মধ্য এশিয়া থেকে প্রাকৃতিক গ্যাস এবং পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় সস্তা হওয়া রাশিয়ান তেল আমদানি বাড়ায়।
বর্তমানে ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েট (WTI) তেলের দাম প্রতি ব্যারেল ৬০ ডলারের আশেপাশে, যা বছরের শুরু থেকে ২০ শতাংশ কম। এটি মূলত OPEC+ দেশগুলোর অতিরিক্ত উৎপাদনের ফল।
ফলে চীন জ্বালানি ঘাটতির কোনো আশঙ্কা ছাড়াই মজুদ বাড়াচ্ছে এবং সরবরাহ সংকটে টেকসই প্রস্তুতি নিচ্ছে।
বিরল খনিজে (Rare Earths) যুক্তরাষ্ট্রের সীমাবদ্ধতা
চীন যদিও যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি ক্রেতা হিসেবে খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়, তবে সয়াবিনে তাদের ভূমিকা অনেক বড়। তবুও, বিশ্বের সবচেয়ে বড় তেল উৎপাদক হওয়া সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র তার নিজস্ব জ্বালানি সম্পদকে আলোচনার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারছে না।
ফলে ওয়াশিংটন এখন বেইজিংয়ের বিরল খনিজ রপ্তানি সীমাবদ্ধতার জবাব দিতে বিপাকে পড়েছে।

এই নির্ভরতা কমাতে যুক্তরাষ্ট্র অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ক্ষমতা বাড়াচ্ছে এবং জাপানের সঙ্গে এক চুক্তি করেছে, যাতে স্থিতিশীল সরবরাহ কাঠামো গড়ে তোলা যায়।
তবে চীন যেখানে বৈশ্বিক উৎপাদনের ৭০% এবং প্রক্রিয়াজাতকরণের ৯০% নিয়ন্ত্রণ করে, সেখানে নির্ভরতা কমাতে সময় লাগবে।
দুই দেশের সমঝোতা: শুল্ক হ্রাস ও এক বছরের ছাড়
বৃহস্পতিবারের শীর্ষ বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্র চীনা পণ্যের ওপর শুল্ক ১০ শতাংশ কমাতে সম্মত হয়, আর চীন এক বছরের জন্য বিরল খনিজ রপ্তানি সীমাবদ্ধতা স্থগিত রাখবে।
তবে দেশীয় অর্থনীতির মন্থরতার কারণে চীনেরও এই বাণিজ্যযুদ্ধ টেনে নেওয়ার সুযোগ কম।
ব্রাজিলের সয়াবিনের মৌসুম যুক্তরাষ্ট্রের সময়ের সঙ্গে না মেলায় কেবল সেটির ওপর নির্ভর করা ব্যয়বহুল হয়ে উঠবে।
ফলে উভয় দেশই এখন বাস্তবতা বুঝে সম্পর্কের টানাপোড়েন কমাতে আগ্রহী।
সয়াবিন থেকে শুরু করে জ্বালানি ও বিরল খনিজ—সবক্ষেত্রেই চীন এমনভাবে ভারসাম্য রক্ষা করছে, যাতে অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা হয় এবং যুক্তরাষ্ট্রের ওপর কৌশলগত চাপ বজায় থাকে।
অন্যদিকে, ট্রাম্প প্রশাসন এখন এক দ্বিধায়—কৃষকদের স্বার্থ রক্ষা না করলে রাজনৈতিক ক্ষতি, আর বাণিজ্যিক ছাড় দিলে অর্থনৈতিক ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা।
#চীন-যুক্তরাষ্ট্র-বাণিজ্য,# সয়াবিন,# ট্রাম্প,# চীন-আমদানি,# বৈশ্বিক-বাজার,# বিরল-খনিজ,# কৃষি-অর্থনীতি, #সারাক্ষণ-রিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















