স্বাধীন চলচ্চিত্রের উত্থান: গল্পই এখন মূল শক্তি
দীর্ঘদিন ধরে কোরীয় চলচ্চিত্র বাজারে মনে করা হতো, বড় বাজেট মানেই বক্স অফিসে সাফল্য। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ের দুটি ছোট স্বাধীন চলচ্চিত্র — ‘দ্য ওয়ার্ল্ড অব লাভ’ ও ‘দ্য আগলি’ — সেই ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করেছে। বিশাল প্রচারণা নয়, বরং দর্শকের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়া প্রশংসাই এগুলোকে সাফল্যের পথে নিয়ে গেছে।
‘দ্য ওয়ার্ল্ড অব লাভ’: এক কিশোরীর অনুভূতির সূক্ষ্ম গল্প
২২ অক্টোবর মুক্তিপ্রাপ্ত ‘দ্য ওয়ার্ল্ড অব লাভ’ মুক্তির পাঁচ দিনের মধ্যেই ৩০ হাজার দর্শক অতিক্রম করে এবং দুই সপ্তাহ পেরোবার আগেই ৫০ হাজারের কাছাকাছি পৌঁছে যায়। এটি একটি স্বাধীন চলচ্চিত্রের জন্য বিরল সাফল্য, বিশেষ করে সীমিত সংখ্যক প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শনের পরও।
গল্পটি ১৮ বছর বয়সী এক স্কুলছাত্রী ‘জু-ইন’-এর জীবনকে ঘিরে। সহপাঠীদের মধ্যে একটি পিটিশনকে কেন্দ্র করে বিরোধের পর সে একের পর এক অজ্ঞাত চিঠির টার্গেটে পরিণত হয়। নির্মাতা ইউন গা-ইউন তাঁর আগের চলচ্চিত্র ‘দ্য ওয়ার্ল্ড অব আস’ ও ‘দ্য হাউস অব আস’-এর মতো সূক্ষ্ম সংবেদনশীলতা এখানে আবারও তুলে ধরেছেন। এটি তাঁর ছয় বছরের বিরতির পর প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র।

সমালোচকদের প্রশংসা ও তারকাদের সমর্থন
চলচ্চিত্রটির আবেগপূর্ণ উপস্থাপনা ও আন্তরিকতার জন্য এটি ব্যাপক প্রশংসা পেয়েছে। কিম হে-সু, কিম তে-রি, পার্ক জং-মিন, গো আহ-সুংসহ জনপ্রিয় তারকারা প্রকাশ্যে সমর্থন জানিয়েছেন। অস্কারজয়ী পরিচালক বং জুন হো নিজেও এক আলোচনায় অংশ নিয়ে ছবিটির প্রশংসা করেন। অভিনেত্রী জং ইউ-মি সামাজিক মাধ্যমে লিখেছেন, “এই চলচ্চিত্রটি দেখতে পেরে আমি সত্যিই কৃতজ্ঞ।”
‘দ্য ওয়ার্ল্ড অব লাভ’ মূলধারার সিনেমার বাঁধাধরা ধারা থেকে বেরিয়ে এসে এক নিঃশব্দ, মানবিক বার্তা দেয়। তরুণ প্রজন্মের সাধারণ জীবনের প্রতিফলন তুলে ধরে এটি দর্শকের মনে গভীর সাড়া ফেলেছে।
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি
দেশে মুক্তির আগেই এটি টরন্টো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের প্রতিযোগিতা বিভাগে একমাত্র কোরীয় চলচ্চিত্র হিসেবে নির্বাচিত হয়। এরপর পিংইয়াও, ওয়ারশা, বিএফআই লন্ডন, টোকিও ফিলমেক্স ও হংকং এশিয়ান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে আমন্ত্রণ পায়।

‘দ্য আগলি’: ২ কোটি ওনে তৈরি হয়ে ১০২ কোটি ওনের সাফল্য
আরেকটি বিস্ময়কর সাফল্যের নাম ‘দ্য আগলি’। এটি নির্মাণ করেছেন ‘ট্রেন টু বুসান’-খ্যাত পরিচালক ইওন সাং হো। মাত্র ২ কোটি ওন (প্রায় ১ লাখ ৪৫ হাজার ডলার) বাজেটে তৈরি এই চলচ্চিত্র এখন পর্যন্ত প্রায় ১০২ কোটি ওন আয় করেছে, যা প্রায় ৫০ গুণ লাভ।
চলচ্চিত্রটির গল্প ইম ডং-হোয়ান নামের এক ব্যক্তিকে ঘিরে, যে তার মায়ের মৃত্যুর ৪০ বছরের পুরনো রহস্য উন্মোচনের চেষ্টা করছে। সে থাকে তার অন্ধ পিতার সঙ্গে, যিনি সিলমোহর খোদাইয়ের একজন দক্ষ কারিগর। পার্ক জং-মিন, কওন হে-হিও এবং শিন হিউন বিনের মতো তারকাদের অভিনয়ে এটি দর্শকদের হৃদয় জয় করেছে।
ইওন এই ছবিটি মাত্র ২০ জন সদস্য নিয়ে এবং বাণিজ্যিক ছবির তুলনায় এক-তৃতীয়াংশ শুটিং সময় ব্যবহার করে নির্মাণ করেন। প্রধান অভিনেতা পার্ক জং-মিন কোনো পারিশ্রমিক ছাড়াই অভিনয় করেছেন, যা দলটির সৃষ্টিশীল পরীক্ষার প্রতি প্রতিশ্রুতি প্রকাশ করে।

ঝুঁকিপূর্ণ শিল্পে নতুন দৃষ্টান্ত
পরিচালক ইওন বলেন, তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে কম বাজেটের পথ বেছে নিয়েছিলেন, যাতে প্রচলিত প্রযোজনা কাঠামোর বাইরে গিয়ে সৃজনশীলতা ও স্বাধীনতা রক্ষা করা যায়। এই সাফল্য কোরীয় চলচ্চিত্র শিল্পের একঘেয়ে বাণিজ্যিক চিন্তার বিপরীতে এক নিঃশব্দ প্রতিবাদ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
সংস্কৃতি বিশ্লেষক জং দক-হিউন বলেন, “এখন আর শুধু বড় বাজেটের মাল্টিপ্লেক্স সিনেমাই সফল হয় না। ছোট বাজেটের চলচ্চিত্রও দর্শকদের গভীরভাবে নাড়া দিতে পারে।”
তিনি আরও যোগ করেন, “বর্তমান সময়ে দর্শকদের রুচি ব্যক্তিগত হয়ে উঠেছে। তাই টিকে থাকতে হলে প্রেক্ষাগৃহগুলোকে বৈচিত্র্য গ্রহণ করতে হবে।”
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















