০৩:৩১ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৮ জুন ২০২৫

দিবারাত্রির কাব্য: মানিক বন্দোপধ্যায় ( ৪৯ তম কিস্তি )

  • Sarakhon Report
  • ১২:০০:৩৭ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
  • 9
রবীন্দ্রনাথ পরবর্তী সময়ে বাংলা সাহিত্যে আরেকটি নতুন যুগ সৃষ্টি হয়েছিলো। ভাষাকে মানুষের মুখের ভাষার কাছে নিয়ে আসা নয়, সাহিত্যে’র বিষয়ও হয়েছিলো অনেক বিস্তৃত। সাহিত্যে উঠে এসেছিলো পরিবর্তিত মন ও সমাজের নানান প্রাঙ্গন। সময়ের পথ ধরে সে যুগটি এখন নিকট অতীত। আর সে সাহিত্যও চিরায়ত সাহিত্য। দূর অতীত ও নিকট অতীতের সকল চিরায়ত সাহিত্য মানুষকে সব সময়ই পরিপূর্ণ মানুষ হতে সাহায্য করে। চিরায়ত সাহিত্যকে জানা ছাড়া বাস্তবে মানুষ তার নিজেকে সম্পূর্ণ জানতে পারে না।

সারাক্ষণের চিরায়ত সাহিত্য বিভাগে এবারে থাকছে মানিক বন্দোপধ্যায়ের দিবারাত্রির কাব্য।

দিবারাত্রির কাব্যে’র ভূমিকায় মানিক বন্দোপধ্যায় নিজেই যা লিখেছিলেন …..

দিবারাত্রির কাব্য আমার একুশ বছর বয়সের রচনা। শুধু প্রেমকে ভিত্তি করে বই লেখার সাহস ওই বয়সেই থাকে। কয়েক বছর তাকে তোলা ছিল। অনেক পরিবর্তন করে গত বছর বঙ্গশ্রীতে প্রকাশ করি।

দিবারাত্রির কাব্য পড়তে বসে যদি কখনো মনে হয় বইখানা খাপছাড়া, অস্বাভাবিক,- তখন মনে রাখতে হবে এটি গল্পও নয় উপন্যাসও নয়, রূপক কাহিনী। রূপকের এ একটা নূতন রূপ। একটু চিন্তা করলেই বোঝা যাবে বাস্তব জগতের সঙ্গে সম্পর্ক দিয়ে সীমাবদ্ধ করে নিলে মানুষের কতগুলি অনুভূতি যা দাঁড়ায়, সেইগুলিকেই মানুষের রূপ দেওয়া হয়েছে। চরিত্রগুলি কেউ মানুষ নয়, মানুষের Projection-মানুষের এক এক টুকরো মানসিক অংশ।

দিবা রাত্রির কাব্য

মানিক বন্দোপাধ্যায়

 

রূপাইকুড়ায় সে তাদের বাঙ্গ সম্পর্ককে প্রাণপণে ঠেলে তুলতে চেয়েছিল সেই স্তরে যেখানে বাস্তব-ধর্মী মানুষের আবেগ ও স্বপ্ন বিছানো থাকে, সেখানে রস ও মাধুর্যের সমাবেশ। সাধারণ যুক্তি ও বিচারবুদ্ধিকে তুচ্ছ করে দেবার প্রবৃত্তি হেরম্ব যাতে দমন করতে না চায়, রূপাইকুড়ায় তাই ছিল সুপ্রিয়ার প্রাণপণ চেষ্টা এবার সুপ্রিয়া তার সমস্ত নেশা টুটিয়ে দিতে চায়, সে যে প্রায় ভুলে যেতে বসেছে সে রক্তমাংসের মানুষ, তার এই ভ্রান্তিকে সে টিকতে দেবে না।

আত্মবিস্মৃত পাখির মতো নিঃসীম আকাশে পাখা মেলে অনন্তযাত্রায় তাকে প্রস্তুত হতে দেখে এই নীড়লুব্ধা বিহঙ্গমী তার কাছে পৃথিবীর আকর্ষণ টেনে এনেছে, তাকে মনে পড়িয়ে দিচ্ছে আকাশে আশ্রয় নেই, খাঞ্চ নেই, পানীয় নেই। হেরম্ব ধীরে ধীরে হাঁটে। মিথ্যা নয়, রূপের বাহার ছাড়া আনন্দের আর কিছুই নেই। সুপ্রিয়ার ইঙ্গিত আনন্দের ভিতর ও বাহির সুন্দর, অপার্থিব, অব্যবহার্য সৌন্দর্যে তার দেহ-মন মণ্ডিত হয়ে আছে: সে রঙিন কালিতে ছাপানো অনবদ্য কবিতার মতো।

অথবা সে আকাশের মতো, তার মধ্যে ডুবে গিয়েও পাখিকে নিজের পাখায় ভর করে থাকতে হয়, পাখা অবশ হলে পৃথিবীতে পতন অনিবার্য। আনন্দকে প্রেম ছাড়া আর কোন পূজায় পাওয়া যায় না, প্রেমের শেষ অবশ নিশ্বাসের সঙ্গে সে হারিয়ে যাবে। সুপ্রিয়ার কাছে অভ্যন্ত বিরক্তি ও মমতার অবাধ খেলায় বিস্ময়কর স্বস্তিবোধ করে হেরম্ব কি এখন বুঝতে পারছে না আনন্দের সান্নিধ্যে তাকে অনির্বচনীয় সুতীব্র সুখের সঙ্গে কি অসহ্য যন্ত্রণা দেয়? তার অর্ধেক হৃদয় ভালবাসার যে পুলক সংগ্রহ করে, অপরাধ মরণাধিক কষ্ট সয়ে তার মূল্য দেয়? সুপ্রিয়ার কাছে সে উন্মাদনা পাবার সম্ভাবনা যেমন নেই, সেরকম

অসহ্য দুঃখও সে দেয় না।

তবু সে দুঃখই তার চাই, তাকে পরিহাস করা যাবে না।

‘চল ফিরি।’

‘ চলুন আর একটু। নির্জনতা গভীর হয়ে আসছে।’

‘জলে ভিজে অশোকের কিছু হয়নি তো?’

হঠাৎ অশোকের কথা ওঠায় সুপ্রিয়া একটু বিস্মিত হয়ে হেরম্বের মুখের

দিকে তাকাল।

‘হুহু করে জ্বর এসেছে।’

‘তুই যে চলে এলি?’

‘ছোটলোক ভাবছেন, না? সেবা করার লোক না থাকলে আসতাম না। দাদা, বৌদি, ভাইঝি সবাই ঘিরে আছে, তারা আপনার জন। আমি

তো পর?’

‘তোর কি হয়েছে বলো?’

‘বুঝতে পারেননি? আমার মন আগাগোড়া বদলে গেছে। আজকাল

সর্বদা অন্যমনস্ক থাকি।’

 

দিবারাত্রির কাব্য: মানিক বন্দোপধ্যায় ( ৪৮ তম কিস্তি )

দিবারাত্রির কাব্য: মানিক বন্দোপধ্যায় ( ৪৮ তম কিস্তি )

দিবারাত্রির কাব্য: মানিক বন্দোপধ্যায় ( ৪৯ তম কিস্তি )

১২:০০:৩৭ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
রবীন্দ্রনাথ পরবর্তী সময়ে বাংলা সাহিত্যে আরেকটি নতুন যুগ সৃষ্টি হয়েছিলো। ভাষাকে মানুষের মুখের ভাষার কাছে নিয়ে আসা নয়, সাহিত্যে’র বিষয়ও হয়েছিলো অনেক বিস্তৃত। সাহিত্যে উঠে এসেছিলো পরিবর্তিত মন ও সমাজের নানান প্রাঙ্গন। সময়ের পথ ধরে সে যুগটি এখন নিকট অতীত। আর সে সাহিত্যও চিরায়ত সাহিত্য। দূর অতীত ও নিকট অতীতের সকল চিরায়ত সাহিত্য মানুষকে সব সময়ই পরিপূর্ণ মানুষ হতে সাহায্য করে। চিরায়ত সাহিত্যকে জানা ছাড়া বাস্তবে মানুষ তার নিজেকে সম্পূর্ণ জানতে পারে না।

সারাক্ষণের চিরায়ত সাহিত্য বিভাগে এবারে থাকছে মানিক বন্দোপধ্যায়ের দিবারাত্রির কাব্য।

দিবারাত্রির কাব্যে’র ভূমিকায় মানিক বন্দোপধ্যায় নিজেই যা লিখেছিলেন …..

দিবারাত্রির কাব্য আমার একুশ বছর বয়সের রচনা। শুধু প্রেমকে ভিত্তি করে বই লেখার সাহস ওই বয়সেই থাকে। কয়েক বছর তাকে তোলা ছিল। অনেক পরিবর্তন করে গত বছর বঙ্গশ্রীতে প্রকাশ করি।

দিবারাত্রির কাব্য পড়তে বসে যদি কখনো মনে হয় বইখানা খাপছাড়া, অস্বাভাবিক,- তখন মনে রাখতে হবে এটি গল্পও নয় উপন্যাসও নয়, রূপক কাহিনী। রূপকের এ একটা নূতন রূপ। একটু চিন্তা করলেই বোঝা যাবে বাস্তব জগতের সঙ্গে সম্পর্ক দিয়ে সীমাবদ্ধ করে নিলে মানুষের কতগুলি অনুভূতি যা দাঁড়ায়, সেইগুলিকেই মানুষের রূপ দেওয়া হয়েছে। চরিত্রগুলি কেউ মানুষ নয়, মানুষের Projection-মানুষের এক এক টুকরো মানসিক অংশ।

দিবা রাত্রির কাব্য

মানিক বন্দোপাধ্যায়

 

রূপাইকুড়ায় সে তাদের বাঙ্গ সম্পর্ককে প্রাণপণে ঠেলে তুলতে চেয়েছিল সেই স্তরে যেখানে বাস্তব-ধর্মী মানুষের আবেগ ও স্বপ্ন বিছানো থাকে, সেখানে রস ও মাধুর্যের সমাবেশ। সাধারণ যুক্তি ও বিচারবুদ্ধিকে তুচ্ছ করে দেবার প্রবৃত্তি হেরম্ব যাতে দমন করতে না চায়, রূপাইকুড়ায় তাই ছিল সুপ্রিয়ার প্রাণপণ চেষ্টা এবার সুপ্রিয়া তার সমস্ত নেশা টুটিয়ে দিতে চায়, সে যে প্রায় ভুলে যেতে বসেছে সে রক্তমাংসের মানুষ, তার এই ভ্রান্তিকে সে টিকতে দেবে না।

আত্মবিস্মৃত পাখির মতো নিঃসীম আকাশে পাখা মেলে অনন্তযাত্রায় তাকে প্রস্তুত হতে দেখে এই নীড়লুব্ধা বিহঙ্গমী তার কাছে পৃথিবীর আকর্ষণ টেনে এনেছে, তাকে মনে পড়িয়ে দিচ্ছে আকাশে আশ্রয় নেই, খাঞ্চ নেই, পানীয় নেই। হেরম্ব ধীরে ধীরে হাঁটে। মিথ্যা নয়, রূপের বাহার ছাড়া আনন্দের আর কিছুই নেই। সুপ্রিয়ার ইঙ্গিত আনন্দের ভিতর ও বাহির সুন্দর, অপার্থিব, অব্যবহার্য সৌন্দর্যে তার দেহ-মন মণ্ডিত হয়ে আছে: সে রঙিন কালিতে ছাপানো অনবদ্য কবিতার মতো।

অথবা সে আকাশের মতো, তার মধ্যে ডুবে গিয়েও পাখিকে নিজের পাখায় ভর করে থাকতে হয়, পাখা অবশ হলে পৃথিবীতে পতন অনিবার্য। আনন্দকে প্রেম ছাড়া আর কোন পূজায় পাওয়া যায় না, প্রেমের শেষ অবশ নিশ্বাসের সঙ্গে সে হারিয়ে যাবে। সুপ্রিয়ার কাছে অভ্যন্ত বিরক্তি ও মমতার অবাধ খেলায় বিস্ময়কর স্বস্তিবোধ করে হেরম্ব কি এখন বুঝতে পারছে না আনন্দের সান্নিধ্যে তাকে অনির্বচনীয় সুতীব্র সুখের সঙ্গে কি অসহ্য যন্ত্রণা দেয়? তার অর্ধেক হৃদয় ভালবাসার যে পুলক সংগ্রহ করে, অপরাধ মরণাধিক কষ্ট সয়ে তার মূল্য দেয়? সুপ্রিয়ার কাছে সে উন্মাদনা পাবার সম্ভাবনা যেমন নেই, সেরকম

অসহ্য দুঃখও সে দেয় না।

তবু সে দুঃখই তার চাই, তাকে পরিহাস করা যাবে না।

‘চল ফিরি।’

‘ চলুন আর একটু। নির্জনতা গভীর হয়ে আসছে।’

‘জলে ভিজে অশোকের কিছু হয়নি তো?’

হঠাৎ অশোকের কথা ওঠায় সুপ্রিয়া একটু বিস্মিত হয়ে হেরম্বের মুখের

দিকে তাকাল।

‘হুহু করে জ্বর এসেছে।’

‘তুই যে চলে এলি?’

‘ছোটলোক ভাবছেন, না? সেবা করার লোক না থাকলে আসতাম না। দাদা, বৌদি, ভাইঝি সবাই ঘিরে আছে, তারা আপনার জন। আমি

তো পর?’

‘তোর কি হয়েছে বলো?’

‘বুঝতে পারেননি? আমার মন আগাগোড়া বদলে গেছে। আজকাল

সর্বদা অন্যমনস্ক থাকি।’

 

দিবারাত্রির কাব্য: মানিক বন্দোপধ্যায় ( ৪৮ তম কিস্তি )

দিবারাত্রির কাব্য: মানিক বন্দোপধ্যায় ( ৪৮ তম কিস্তি )