দেশের দ্বিতীয় সমুদ্রবন্দর মংলাকে জাতীয় রেল নেটওয়ার্কে যুক্ত করার স্বপ্ন নিয়ে এক দশক আগে শুরু হয়েছিল খুলনা–মংলা রেললাইন প্রকল্প। কিন্তু দেড় বছর পার হলেও সেই স্বপ্ন আজ বাস্তব হয়নি। ৪ হাজার ২৬১ কোটি টাকায় নির্মিত এই “স্বপ্নের প্রকল্প” এখন দাঁড়িয়ে আছে এক স্থবির বাস্তবতায়—যেখানে অবকাঠামো আছে, কিন্তু প্রয়োগ নেই।
এক দশকের পরিকল্পনার পরও অপূর্ণ প্রতিশ্রুতি
মংলা বন্দর হয়ে আমদানি ও রপ্তানি পণ্যের দ্রুত ও কম খরচে পরিবহন নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে নির্মিত হয়েছিল ৯১ কিলোমিটার দীর্ঘ রেললাইনটি। একসময় ধারণা করা হয়েছিল, এই লাইন খুলনা অঞ্চলের শিল্প-বাণিজ্যের চেহারা বদলে দেবে। কিন্তু আধুনিক অবকাঠামো থাকা সত্ত্বেও প্রকল্পটি এখনো কাঙ্ক্ষিত সুফল দিতে পারেনি।
বর্তমানে এই রেললাইন কেবল যাত্রী পরিবহনের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। পণ্যবাহী ট্রেন কার্যত বন্ধ।
পণ্য পরিবহনে স্থবিরতা
রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, ২০২৩ সালে উদ্বোধনের পর থেকে এখন পর্যন্ত মাত্র তিনবার পণ্য পরিবহন করা হয়েছে—২০২৫ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি, ২৩ মার্চ ও ২৫ জুন তারিখে—চট্টগ্রাম থেকে মংলায় প্রায় ১৯ হাজার মেট্রিক টন পণ্য আনা হয়। এর পর থেকে আর কোনো পণ্যবাহী ট্রেন চলেনি।

আন্তর্জাতিক ঋণে বাস্তবায়িত বৃহৎ প্রকল্প
২০১০ সালে বিদেশি ঋণ সহায়তায় শুরু হওয়া এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে ভারতের লারসেন অ্যান্ড টুবরো (এল অ্যান্ড টি) ও আইআরকন ইন্টারন্যাশনাল। এতে রয়েছে ৫.১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ রূপসা রেলসেতু—যা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সবচেয়ে বড় সেতু। এছাড়া ৯টি রেলস্টেশন, ৬৬টি ছোট সেতু এবং ২৪৬টি কালভার্টও নির্মিত হয়েছে।
কাগজে-কলমে এটি ছিল এক রূপান্তরমুখী প্রকল্প। কিন্তু বাস্তবে স্থানীয় বাসিন্দা ও বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি।
স্থানীয় হতাশা ও অর্থনৈতিক স্থবিরতা
স্থানীয়দের দাবি, নিয়মিত পণ্যবাহী ট্রেন চালু থাকলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হতো, শিল্পাঞ্চলের প্রবৃদ্ধি বাড়ত এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনীতি শক্তিশালী হতো। এখন তারা প্রকল্পটিকে ব্যয়বহুল অথচ নিষ্ক্রিয় অবকাঠামো হিসেবে দেখছেন।
ব্যবসায়ীরাও একই হতাশা প্রকাশ করেছেন। তাদের মতে, মংলা বন্দর ও রেলওয়ের মধ্যে কার্যকর সমন্বয় না থাকায় এই স্থবিরতা তৈরি হয়েছে।
জয়েন্ট ইন্টারন্যাশনালের মালিক মো. সাজ্জাদুল ইসলাম বলেন, “অবকাঠামো আছে, কিন্তু কার্যকর সমন্বয় নেই—তাই সম্ভাবনাও অপ্রয়োগিত থেকে যাচ্ছে।”
মংলা বন্দরের সীমাবদ্ধতা
বেশ কয়েকজন আমদানিকারক জানিয়েছেন, মংলা বন্দরে বড় জাহাজ ভেড়ানোর সীমিত সক্ষমতা, পুরনো ক্রেন, পর্যাপ্ত গুদাম ও কন্টেইনার সুবিধার অভাব এবং ধীর গতির আনলোডিং কার্যক্রমের কারণে ব্যবসায়ীরা রেল ব্যবস্থায় আগ্রহ দেখাচ্ছেন না।
রেলওয়ের দাবি: প্রস্তুতি সম্পূর্ণ
রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চল ব্যবস্থাপক ফরিদ আহমেদ বলেন, “আমরা রেক ও ইঞ্জিনসহ সব প্রস্তুতি নিয়েছি। কিন্তু মংলা বন্দরে পণ্যের পরিমাণ কম থাকায় নিয়মিত ট্রেন চালানো সম্ভব হচ্ছে না।”
তিনি আরও জানান, শিল্পপতি, রপ্তানিকারক ও আমদানিকারকদের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক হচ্ছে, যাতে তারা রেলপথে পণ্য পরিবহনে আগ্রহী হন।
বন্দর কর্তৃপক্ষের পদক্ষেপ
মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের ট্রাফিক পরিচালক মো. কামাল হোসেন বলেন, “আমরা বন্দর আধুনিকায়নের উদ্যোগ নিচ্ছি এবং টার্মিনাল সম্প্রসারণের কাজ চলছে। আমদানিকারকদের উৎসাহিত করতে নানা প্রণোদনা বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে।”

সমন্বয়ের অভাবই মূল সমস্যা
বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রকল্পটির দুরবস্থা বৃহত্তর একটি সমস্যার প্রতিফলন—মূল অংশীদারদের মধ্যে কৌশলগত সমন্বয়ের অভাব।
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির বলেন, “যদি পরিকল্পনামাফিক পণ্যবাহী ট্রেন চালু করা যেত, তাহলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনীতি বদলে যেত। এটি ঋণনির্ভর প্রকল্প, ফলে সুদের বোঝা ক্রমেই বাড়ছে।”
তিনি আরও বলেন, “প্রকল্পটি কার্যকর করতে হলে বন্দর, রেলওয়ে ও বাণিজ্যিক অংশীদারদের মধ্যে সমন্বিত পরিকল্পনা নিতে হবে। নিয়মিত পণ্য পরিবহন শুরু হলে দক্ষিণাঞ্চলের পুরো অর্থনীতি নতুন প্রাণ পেতে পারে।”
খুলনা–মংলা রেললাইন একসময় ছিল উন্নয়নের প্রতীক। আজ এটি দাঁড়িয়ে আছে এক স্থবির বাস্তবতায়—যেখানে অবকাঠামো আছে, কিন্তু প্রয়োগ নেই।
অর্থনীতিবিদদের মতে, সময়মতো কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে এই ‘স্বপ্নের প্রকল্প’ শেষ পর্যন্ত কেবল আর্থিক বোঝা হিসেবেই থেকে যাবে।
#খুলনা_মংলা_রেলপথ #স্বপ্নের_প্রকল্প #বাংলাদেশ_রেলওয়ে #মংলা_বন্দর #অর্থনীতি #অবকাঠামো #সারাক্ষণরিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















