মার্কিন সুপ্রিম কোর্টে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্কনীতি এখন গুরুতর সংকটে। আদালতে যুক্তি দেখানো হয়েছে যে, ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্ক আরোপ আসলে রাজস্ব আহরণের উদ্দেশ্যেই করা হয়েছে, যা সংবিধান অনুযায়ী কংগ্রেসের একচেটিয়া ক্ষমতার মধ্যে পড়ে।
ফলস্বরূপ, এই মামলাটি শুধু শুল্ক নয়, বরং মার্কিন প্রশাসনিক কাঠামোর মৌলিক ক্ষমতার ভারসাম্যের সঙ্গেও জড়িত।
প্রধান বিতর্ক: রাজস্ব নাকি বৈদেশিক নীতি?
মামলার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন মার্কিন সলিসিটর জেনারেল জন সাওয়াল (John Sauer)। তিনি আদালতে যুক্তি দেন, “এগুলো রাজস্ব আহরণের উদ্দেশ্যে আরোপিত শুল্ক নয়।”
কিন্তু বাস্তবে, ট্রাম্প বারবার দাবি করেছেন, তার শুল্কনীতি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বিশাল আয় তৈরি করেছে। তিনি একাধিকবার বলেছেন, এই অর্থ দিয়ে আয়কর প্রতিস্থাপন, কৃষকদের সহায়তা কিংবা নাগরিকদের রিবেট দেওয়া সম্ভব।
তাহলে, সাওয়ালের এমন বক্তব্য কেন? কারণ সংবিধান অনুযায়ী, শুল্ক ও কর আরোপের ক্ষমতা কেবল কংগ্রেসের। তাই আদালতকে বোঝাতে তিনি চেষ্টা করছেন যে, ট্রাম্পের উদ্দেশ্য রাজস্ব নয়, বরং বৈদেশিক নীতির অংশ হিসেবে অর্থনৈতিক চাপ প্রয়োগ।
ক্ষমতার ভারসাম্যে ধাক্কা
আমেরিকার সংবিধান প্রণেতারা প্রেসিডেন্টকে রাজস্ব তোলার ক্ষমতা না দিয়ে কংগ্রেসের হাতে তা রেখেছিলেন — যাতে একনায়কতান্ত্রিক ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা না হয়।
কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে “ইম্পেরিয়াল প্রেসিডেন্সি” বা নির্বাহী শাখার অতিরিক্ত প্রভাব কংগ্রেসের কর্তৃত্বকে দুর্বল করেছে।

ট্রাম্প প্রশাসনে এই প্রবণতা আরও জোরদার হয়। তিনি বিভিন্ন সংস্থা থেকে অর্থ প্রত্যাহার করেছেন, আইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত সংস্থাগুলোর কার্যক্রম বন্ধ করেছেন এবং ইচ্ছানুসারে রাজ্য ও বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিল আটকে রেখেছেন।
সুপ্রিম কোর্টের অবস্থান
রক্ষণশীল বিচারপতিদের প্রাধান্য থাকা সত্ত্বেও, এই আদালত ট্রাম্পের সীমাহীন শুল্ক আরোপের ক্ষমতা মেনে নিতে দ্বিধাগ্রস্ত।
ট্রাম্পের নিজস্ব বাজেট অফিসের হিসাব অনুযায়ী, তার শুল্কনীতির ফলে ১০ বছরে ৩.৯ ট্রিলিয়ন ডলার অতিরিক্ত রাজস্ব আসতে পারে — যা ১৯৮২ সালের পর সবচেয়ে বড় কর বৃদ্ধি হিসেবে বিবেচিত হবে।
বিচারপতি নিল গরসাচ বলেন, “সংবিধান অনুযায়ী কর আরোপের ক্ষমতা কংগ্রেসের হাতে — এটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এক অটল নীতি।”
মূল প্রশ্ন
মামলাটি আইনি দৃষ্টিতে জটিল হলেও মূল প্রশ্নটি স্পষ্ট: প্রেসিডেন্ট কি কংগ্রেসের অনুমতি ছাড়াই যে কোনো দেশে, যে কোনো পণ্যে, যে কোনো হারে শুল্ক আরোপ করতে পারেন?
আইনি প্রেক্ষাপট
ট্রাম্প ১৯৭৭ সালের “ইন্টারন্যাশনাল এমার্জেন্সি ইকোনমিক পাওয়ারস অ্যাক্ট” অনুযায়ী শুল্ক বাড়িয়েছেন, যা বিদেশি জরুরি অবস্থার মোকাবিলায় প্রেসিডেন্টকে আমদানি নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা দেয়।
তবে এই আইনের ব্যাখ্যা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে — “নিয়ন্ত্রণ” বলতে কি শুল্ক আরোপও বোঝায়, নাকি কেবল নিষেধাজ্ঞা ও অর্থনৈতিক বিধিনিষেধ বোঝায়?
নিম্ন আদালত ইতিমধ্যেই রায় দিয়েছে যে, আইনটি প্রেসিডেন্টকে শুল্ক আরোপের ক্ষমতা দেয় না।

বিচারকদের প্রতিক্রিয়া
চিফ জাস্টিস জন রবার্টস মন্তব্য করেন, “এটি আসলে আমেরিকানদের ওপর কর আরোপের বিষয়, আর করের ক্ষমতা সবসময়ই কংগ্রেসের।”
বিচারপতি এলেনা কাগান যোগ করেন, “যদি কোনো প্রেসিডেন্ট সীমাহীন হারে কর আরোপ করতে পারেন, তবে এটি সুস্পষ্টভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের সমস্যা তৈরি করবে।”
বিশ্লেষকদের মতে, নয়জন বিচারপতির মধ্যে অন্তত ছয়জন — তিনজন লিবারেল বিচারপতি, রবার্টস, গরসাচ ও অ্যামি কোনি ব্যারেট — ট্রাম্পের বিপক্ষে রায় দিতে পারেন।
সম্ভাব্য ফলাফল
ট্রাম্প দাবি করেছেন, রায় তার বিরুদ্ধে গেলে “যুক্তরাষ্ট্র ধ্বংস হয়ে যাবে।”
কিন্তু বিশ্লেষকরা বলছেন, এমনটি হবে না। কমিটি ফর আ রেসপন্সিবল ফেডারেল বাজেটের হিসাব অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত আদায়কৃত ১৯৫ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে প্রায় ৯০ বিলিয়ন ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। বাকিটা অন্য আইনি কর্তৃত্বে টিকে থাকবে।
তবে বড় প্রশ্নটি হলো: ভবিষ্যতে কোনো প্রেসিডেন্ট কি বিদেশি সংকটের অজুহাতে একক সিদ্ধান্তে কর আরোপ করতে পারবেন? যদি আদালত ট্রাম্পের পক্ষে রায় দেয়, তাহলে কোনো প্রেসিডেন্ট জলবায়ু সংকট ঘোষণা করে সরাসরি কার্বন ট্যাক্স-ও বসাতে পারেন — কংগ্রেসের অনুমতি ছাড়াই।
গরসাচ সতর্ক করে বলেন, “এটি একমুখী রাস্তা — যেখানে ক্ষমতা ধীরে ধীরে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছ থেকে সরে গিয়ে নির্বাহী শাখার হাতে চলে যায়।”
বিচারকদের বার্তা ছিল স্পষ্ট: এই প্রবণতা থামানোর সময় এসে গেছে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 




















