০৭:২৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ০৮ নভেম্বর ২০২৫
চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙর করেছে পাকিস্তানি নৌযান ‘পিএনএস সাইফ’ কিছু রাজনৈতিক দলের পদক্ষেপ জনগণের অধিকার বিপন্ন করতে পারে: তারেক রহমান নাইজেরিয়া বন্যপ্রাণী পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির আইন পাস করল মাইক্রোসফট ও জি৪২ সংযুক্ত আরব আমিরাতে ডেটা-সেন্টার বিস্তার ঘোষণা বড় টেকের চাপের মুখে ইইউ এইআই আইন বাস্তবায়ন বিলম্বে বিবেচনায় বাংলাদেশ আমেরিকা থেকে গম কিনছে, বাণিজ্য উত্তেজনা কমাতে বড় পদক্ষেপ ব্লেক লাইভলির মামলায় সাক্ষী টেইলর সুইফট ও হিউ জ্যাকম্যান; ক্ষতিপূরণের দাবি ১৬১ মিলিয়ন ডলার ডাক রাশ্মিকার ‘দ্য গার্লফ্রেন্ড’ প্রথম দিনেই ব্যর্থতার মুখে ৩ দফা দাবি: শহীদ মিনারে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অবস্থান কর্মসূচি

বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগ তদন্ত নিয়ে কী বলছে সরকার, আইএসপিআর

শেখ হাসিনার শাসনামলে গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে বহু সমালোচনা হয়েছে। অতীতের মতো অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ও নির্যাতন, গুলিতে মৃত্যুর অভিযোগ থেমে নেই বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন মানবাধিকারকর্মীরা।

বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থানের পরে প্রাণঘাতী গুলি ও হেফাজতে নির্যাতনে বিচারবহির্ভূত হত্যার বেশকিছু অভিযোগ সুষ্ঠু তদন্ত হচ্ছে কি না সেই প্রশ্নও তুলেছেন তারা।

মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই সরকারের সময়ে সারা দেশে অন্তত ৪০টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের হিসেবে ওই সংখ্যা ৬০। অর্থাৎ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে গড়ে প্রতি মাসে চারটির বেশি বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা ঘটেছে।

বর্তমান সরকারের আমলে সংগঠিত বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনাগুলোর তদন্ত নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন মানবাধিকারকর্মী ও অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত গুম কমিশনের সদস্য নূর খান লিটন। গুলিতে মৃত্যুর প্রতিটি ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত হওয়া দরকার বলে মনে করেন তিনি।

“বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বা কাস্টডিয়াল টর্চারের যে কালচার সেটা থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী বা নিরাপত্তা বাহিনী বেরিয়ে আসছে এখন পর্যন্ত এইটা বলার সুযোগ নাই। অর্থাৎ বিগত সরকারের আমলে যে অবস্থাটা ছিল, তার থেকে আপনি কিছু ব্যতিক্রম পেতে পারেন। কিন্তু খুব বেশি যে উন্নতি হয়েছে সেটা বলার সুযোগ আসেনি। ইতিমধ্যে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন এই বিষয়গুলো নিয়ে প্রশ্ন তুলছে, পরিসংখ্যান দেখাচ্ছে,” বলেন তিনি।

গুলিতে মৃত্যুর ঘটনায় আলাদা বিশেষজ্ঞ কমিটির মাধ্যমে তদন্ত করা প্রয়োজন বলে মনে করেন গোপালগঞ্জে সহিংসতার ঘটনায় সরকারি তদন্ত কমিশনের সদস্য সাজ্জাদ সিদ্দিকী।

“পাঁচ অগাস্টের পরিণতির পরে আবারো যদি কেউ লেথাল উইপন ব্যবহার করে, কারো গুলিতে মারা যায়, তাহলে মানুষের আশার জায়গাটা থাকে না,” বলেন তিনি।

গোপালগঞ্জ, খাগড়াছড়ির মতো ঘটনায় গুলিতে মৃত্যুতে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ‘অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের’ অভিযোগ এবং প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের সমালোচনা করেন মানবাধিকারকর্মীরা।

এ ব্যাপারে আইএসপির বিবিসিকে জানিয়েছে, প্রাণঘাতী গুলি সেনাবাহিনী শুধু অনুমোদিত রুলস অব এনগেজমেন্ট অনুযায়ী ব্যবহার করে। এছাড়া যেকোনো অভিযোগ আসলে সেনা আইন অনুযায়ী তদন্ত হয়। বর্তমানে তদন্তে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও মানবাধিকার সংক্রান্ত বিষয়ে সেনাবাহিনী অধিকতর গুরুত্ব দিচ্ছে

প্রাণঘাতী গুলি ও তদন্ত নিয়ে উদ্বেগ

গত জুলাই মাসে এনসিপির গোপালগঞ্জ সফরকে ঘিরে সংঘর্ষে গুলিতে পাঁচ জনের মৃত্যু হয়। অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ ও গুলিতে একদিনে সর্বোচ্চ প্রাণহানীর ঘটনা এটি।

গোপালগঞ্জে ঘটনায় সেনাবাহিনীর অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের অভিযোগ করেছিলেন মানবাধিকারকর্মীরা।

ঘটনার পরদিন ১৭ই জুলাই সেনাবাহিনীর পক্ষে আইএসপির এক বিবৃতিতে বলেছিল ‘আত্মরক্ষার্থে বলপ্রয়োগে বাধ্য হয়েছে সেনাবাহিনী’।

গোপালগঞ্জে গুলির ঘটনায় বাহিনীর নিজস্ব কোনো তদন্ত হয়েছে কি না এমন প্রশ্নে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বিবিসি বাংলাকে জানানো হয়,

“গোপালগঞ্জে সংঘটিত ঘটনার প্রেক্ষিতে জাতীয় পর্যায়ে একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়েছে এবং কমিশন কর্তৃক তদন্ত প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়েছে”।

তবে, গোপালগঞ্জে ঘটনা তদন্তে সাবেক একজন বিচারপতির নেতৃত্বে সরকার যে তদন্ত কমিটি গঠন করে সেটি গুলির ঘটনা সেভাবে তদন্ত করেনি। সম্প্রতি এই কমিশন তাদের তদন্ত প্রতিবেদন সরকারের কাছে উপস্থাপন করেছে, তবে অন্তর্বর্তী সরকার তা এখনো জনসমক্ষে প্রকাশ করেনি।

সরকার গঠিত ওই তদন্ত দলের একজন সদস্য ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যান সাজ্জাদ সিদ্দিকী। বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, গোপালগঞ্জে কার গুলিতে মৃত্যু হয়েছে এ বিষয়টি তদন্ত করা কমিটির কার্যপরিধিতে ছিল না।

যে প্রতিবেদনগুলো আসছে, যে ভিডিও ফুটেজগুলো আসছে- তাকে উভয় পক্ষ থেকেই কিন্তু গুলির রেকর্ড পাওয়া গেছে, জানান তিনি।

“সাবোটাজ হওয়ার সম্ভাবনা একপাশ থেকে যেরকম আছে, আবার যারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ছিল তাদের পক্ষ থেকেও গুলিতে মারা গেছে এই সন্দেহ ছিল। এই জিনিসগুলো আমাদের টিওআর এর মধ্যে ছিল না যে কার গুলিতে মারা গেছে। এটা এখনো অমিমাংসিত। এটা হয়তো এক্সপার্ট যারা তারা করবে। তবে গুলিতে মারা গেছে এটা সত্য,” বলেন তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যান সাজ্জাদ সিদ্দিকী

গোপালগঞ্জে গুলিতে নিহত চারজনকে কবর থেকে উঠিয়ে পোস্ট মর্টেম করা হয়েছিল।

গোপালগঞ্জের পুলিশ সুপার বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, সবগুলোর ক্ষেত্রে একইরকম ভাষায় মতামত দেয়া হয়েছে।

পুলিশ সুপারের পাঠানো ইংরেজিতে লেখা সেই মতামতের অনুবাদ হলো–– “আমাদের অভিমত, মৃত্যুর কারণ ছিল রক্তক্ষরণ ও শক, যা পূর্ববর্তী আঘাতের ফলে ঘটেছে এবং হত্যাকাণ্ডের প্রকৃতির ছিল”।

গোপালগঞ্জ ছাড়াও এ সরকারের সময় খাগড়াছড়ির গুইমারা, আশুলিয়ায় শ্রমিক বিক্ষোভ, মোহাম্মদপুরে অভিযানে গুলিতে মৃত্যুর ঘটনা সমালোচিত হয়েছে।

মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের হিসেবে অন্তবর্তীকালীন সরকারের ১৪ মাসে গুলিতে মৃত্যু হয়েছে অন্তত ১৯ জনের। মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের হিসাবে এ সংখ্যা ২৯ জন।

গুলিতে মৃত্যুর কোনো ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও সে অনুযায়ী দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার নজির তৈরি করতে পারেনি এই সরকার, এমন হতাশা প্রকাশ করে মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন বলেন,

“গোপালগঞ্জের ঘটনা বলেন, আশুলিয়ার ঘটনা বলেন- যেখানে যেখানে ঘটনাগুলি ঘটেছে সেই জায়গাগুলোতে যদি একটা সুষ্ঠু তদন্ত করে জনসম্মুখে বলে দিক যে হ্যাঁ, এই ঘটনার প্রেক্ষিতে এইটা হয়েছে, তাহলে কিন্তু বিষয়টা বোঝা যেত। যে সরকারের তরফ থেকে বা বাহিনীগুলির তরফ থেকে তাদের সদস্যদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য, আইনের বাইরে গিয়ে কাজ করার জন্য শাস্তি পেতে হচ্ছে বা তাদেরকে বিচারের মুখোমুখী করছে। তাহলে জনগণ কিন্তু কিছুটা আস্থা পেতে পারতো”।

সার্বিকভাবে গুলির ঘটনাগুলো উদ্ঘাটনে সরকারের পদক্ষেপ নিয়ে সাজ্জাদ সিদ্দিকী বলেন, প্রাণঘাতী অস্ত্র বা লেথাল উইপন দিয়ে গুলিতে কেউ মারা গেছে সেটারও তদন্ত হচ্ছে না ঠিকমতো। কিংবা এটার জন্য সুনির্দিষ্টভাবে যে তদন্ত হওয়া দরকার, এই গুরুত্বটা অনুধাবন করা এই সরকারের দরকার ছিল।

“কার গুলিতে মারা গেল এটা কিন্তু একটা স্পেসিফিক টিওআর (কার্যপরিধি)। এই টিওআর’র জায়গায় কাজ করতে হবে একেবারে স্পেসিফিক এক্সপার্ট দিয়ে। আদারওয়াইজ আপনার প্রতি ট্রাস্ট আসবে না। সরকার সেই কাজগুলো করছে কি না সে জায়গায় যথেষ্ট সন্দেহ আছে। সেই জায়গায় একটা রিল্যাকটেন্স (অনীহা) এই যে বিগত সরকারের সময়ে যেরকম দেখা গিয়েছিল এই সরকারের সময়ে এই জায়গায় একটা রিল্যাকটেন্স আছে আমার কাছে মনে হয়”।

কিশোরগঞ্জে আটকের পর নারীর মৃত্যু

গুলিতে মৃত্যুর পাশাপাশি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আটকের পর তাদের হেফাজতে ২১ জনের মৃত্যুর অভিযোগ পাওয়া গেছে।

এ বছর ১৩ই জুন কিশোরগঞ্জে কটিয়াদীতে মাদকবিরোধী এক অভিযানে যৌথ বাহিনীর হাতে আটক হওয়ার পর ছয় ঘণ্টার মধ্যে মৃত্যু হয় এক নারীর।

ফিরোজা বেগম নামে ওই নারীর পরিবারের দাবি, তার স্বামী স্বপন মিয়াকে বাড়িতে না পেয়ে তাকে আটক করা হয়। গভীর রাতে তাকে থানা পুলিশে সোপর্দ করার পর ছয় ঘণ্টার মধ্যে মারা যান ফিরোজা বেগম।

পরিবার এবং প্রতিবেশীদের কাছে এই মৃত্যু অস্বাভাবিক। পরিবার মনে করে নির্যাতনের কারণেই তার মৃত্যু হয়েছে।

ফিরোজা বেগমের শাশুড়ি, প্রায় ৮০ বছর বয়সী আপেলা বেগম জানান, অভিযানের সময় তার সামনেই লাঠি দিয়ে তার ছেলের বৌকে পেটানো হয়। তাকে নারী পুলিশ একাধিক বাড়ি দেয়।

টেপ পেঁচানো একটি কাঠের লাঠি দেখিয়ে তিনি দাবি করেন, ওই লাঠি দিয়ে ফিরোজা বেগম এবং তাকে পেটানো হয়। সেটি ভুলে ওই বাড়িতে রেখে গিয়েছিলেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। পরে কাঠের লাঠিতে টেপ পেঁচিয়ে রেখেছেন ফিরোজা বেগমের মেয়ে সোমা।

একজন প্রতিবেশী নারী বিবিসিকে জানান, মৃত্যুর পর হাসপাতালে দেখতে গিয়ে কাপড় সরিয়ে ফিরোজা বেগমের শরীরে গুরুতর কালসিটে দাগ দেখতে পেয়েছিলেন তিনি।

একটি অন্ধকার ঘরে চোখ বাঁধা অবস্থায় বসে আছে একজন মানুষ, প্রতীকী ছবি

ফিরোজা বেগমের মেয়ে সোমা দাবি করেন, মৃত্যুর পর তার মায়ের শরীরে আঘাতের চিহ্ন ছিল। মায়ের মৃত্যুর তদন্ত এবং পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট নিয়েও তারা সন্তষ্ট নন।

সোমার অভিযোগ, অভিযানে আসা সেনাবাহিনী ও পুলিশের সদস্যরা তার মাকে পিটিয়েছে। তার ভাষায়, “আমার মা তো টর্চারেই মারা গেছে”।

ফিরোজা বেগমকে নির্যাতনের অভিযোগ ‘অসত্য’ বলে দাবি করেছে সেনাবাহিনী। পরিবারের অভিযোগ নিয়ে জানতে চাইলে আইএসপিআর থেকে বিবিসি বাংলাকে দেওয়া লিখিত বক্তব্যে বলা হয়,

“সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে ১৩ ও ১৪ই জুন যৌথ বাহিনীর অভিযানে মাদক ব্যবসার সাথে সংশ্লিষ্ট থাকার অভিযোগে ফিরোজা বেগম নামে এক মাদক ব্যবসায়ীকে তার বাসা থেকে আটক করা হয়। ঘটনাস্থল থেকেই মহিলা পুলিশের উপস্থিতিতে তাকে থানায় হস্থান্তর করা হয়। অপরাধী নারী হওয়ায় বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা হয়”।

আইএসপিআর’র দাবি, ফিরোজা বেগম থানাতে অবস্থানকালীন হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পরদিন সাড়ে নয়টার দিকে মৃত্যুবরণ করেন। কর্তব্যরত মেডিকেল অফিসারের সুরতহাল রিপোর্ট এবং পরবর্তীতে পোস্টমর্টেম রিপোর্টে কোনো ইনজুরি পাওয়া যায়নি এবং এটিকে একটি স্বাভাবিক মৃত্যু হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

নূর খান লিটন

ফিরোজা বেগমের পোস্টমর্টেম রিপোর্টে দেখা যায়, মৃত্যুর কারণ ‘কার্ডিয়াক ফেইলিয়র’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে সেখানে মতামতে প্রাথমিক রিপোর্টে তার শরীরে আঘাতের চিহ্ন থাকার কথা উল্লেখ আছে।

তবে যে ইনজুরি বা আঘাতের চিহ্ন ছিল সেটি ‘মৃত্যু ঘটানোর জন্য যথেষ্ট নয়’ বলে পোস্টমর্টেম রিপোর্টে বলা হয়।

কটিয়াদী থানার তদন্ত কর্মকর্তারা জানান, ফিরোজা বেগমের ‘স্বাভাবিক মৃত্যু’ হয়েছে উল্লেখ করে তদন্ত ও মামলা সমাপ্ত করে ফাইনাল রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে।

নূর খান লিটন বলেন, আগের আমলের যেভাবে বলা হত, এখনো একইভাবে বিষয়গুলোকে এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে

“প্রথম হচ্ছে আমাকে এডমিট করতে হবে যে হ্যাঁ এই ঘটনাগুলো ঘটছে, তাহলেই আমি কেবলমাত্র এর ঔষধ প্রয়োগ করতে পারব। কিন্তু আমি স্বীকার করবো না যতক্ষণ, ততক্ষণ পর্যন্ত এইটার থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য যে চেষ্টা সেটা আমরা করব না,” বলেন তিনি।

সরকার কী বলছে

বিচারবহির্ভুত হত্যার অভিযোগ এবং এর তদন্তগুলো পর্যালোচনা করে বোঝা যায়, এসব ঘটনার মামলা ও তদন্ত গতানুগতিক ধারায় চলছে। এ বিষয়ে মতামত জানতে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার দপ্তরে যোগাযোগ করে মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

কবে তদন্তের সমালোচনা নিয়ে সরকারের তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বিবিসি বাংলাকে বলেন,

“আমরা আমাদের জায়গা থেকে এগুলো সংস্কার করে রেখে দিয়ে যাইতে চাইতেছি। আমরা তো এক বছরের মধ্যে এটা স্বাধীন করতে পারি নাই। কিন্তু আমরা প্রক্রিয়াগুলো শুরু করছি। যেমন পুলিশে ইন্টারনালি, পুলিশের কেউ যদি এমন কিছু করে যেটা আইন ও মানবাধিকার বহির্তুভ, তাহলে কিন্ত সেটার তদন্ত হবে”।

“এই প্রবিশন আমরা গত এক বছরে সামনে নিয়ে আসতে পারছি। এইটা যদি প্র্যাকটিসে আসে তাহলেই কিন্তু তদন্তগুলো সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ হবে। কিন্তু প্র্যাকটিসটা তো আগেরই। লোকটা আগের, অফিসিয়ালরা আগের, ক্লায়েন্টাল রিলেশনশিপটা আগের। এটা তো হুট করে বদলায় নাই। এই প্রক্রিয়া যদি আরো চার-পাঁচ বছর, দশ বছর প্র্যাকটিসে আসে তখন তদন্তগুলো সুষ্ঠু হবে। না হলে তো হবে না। লোকগুলো তো একই আছে,” বলছেন মাহফুজ আলম।

তথ্য উপদেষ্টা  মাহফুজ আলম

বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে ক্রসফায়ারের ঘটনা অনেক কমেছে, গুমের অভিযোগও নেই। তবে প্রাণঘাতী গুলির ব্যবহার নিয়ে সমালোচনা আছে।

এ প্রশ্নে সরকারের অবস্থান এবং পদক্ষেপ নিয়ে তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেন, তারা আদর্শগতভাবে প্রাণঘাতী গুলি ব্যবহারের বিরোধী।

“প্রত্যেকটা জায়গাতেই হয়তো রাষ্ট্রের যুক্তি আছে যে কেন বাধ্য হইলো মারতে। কিন্তু আমরা তো অল আউট যেকোনো ধরনের মুভমেন্ট, প্রোটেস্টে লেথাল উইপনের বিরুদ্ধে। আমরা ব্যক্তিগতভাবে, রাজনৈতিকভাবে, আদর্শিকভাবে এটার বিরুদ্ধে। কিন্তু রাষ্ট্রে তো আইন, বিচার বা স্বরাষ্ট্রে যারা দায়িত্বে আছেন তাদের দিক থেকে যুক্তি আছে। যুক্তি ভালো কি খারাপ সেটা ইস্যু না। ইস্যু হচ্ছে যুক্তি তো আছে। আইন মন্ত্রণালয়ে জিনিসগুলো নিয়ে আসতে চেষ্টা করসে, যাতে কোনোভাবে, কোনো মুভমেন্টেই লেথাল উইপন ইউজ না করা হয়,” তিনি যুক্ত করেন।

তবে মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটনের দৃষ্টিতে বিচারবহির্ভূত হত্যা ও তদন্তের ক্ষেত্রে অতীতের ধারাবাহিকতাই বজায় রয়েছে। প্রাণঘাতী গুলির ব্যবহার এবং অতিরিক্ত বল প্রয়োগের ক্ষেত্রেও নিরাপত্তা বাহিনীর আচরণে খুব একটা পরিবর্তন হয়নি।

আইএসপিআরের লিখিত উত্তর

বিবিসির প্রশ্নের জবাবে যা জানিয়েছে আইএসপিআর

অন্তবর্তীকালীন সরকারের সময়ে গুলি ও নির্যাতনের অভিযোগের তদন্ত নিয়ে চারটি প্রশ্ন করেছিল বিবিবি বাংলা, যেগুলোর উত্তর দিয়েছে আন্তবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর)।

অভিযানে গুলি ও নির্যাতনের অভিযোগে সশস্ত্র বাহিনীর পক্ষ থেকে তদন্ত পরিচালনার ক্ষেত্রে অন্তবর্তীকালীন সরকারের সময়ে কোনো পরিবর্তন হয়েছে কি না, যদি হয় সেটি কেমন–– জানতে চেয়েছিল বিবিসি।

আইএসপিআর জানিয়েছে, “অপ্রত্যাশিত গুলি বা নির্যাতন সংক্রান্ত কোনো অভিযোগ উত্থাপিত হওয়ার সাথে সাথেই সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে সেনা আইন ও বিধি অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পরিসরে উপযুক্ত তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়”।

“সার্বিকভাবে বলা যায়, তদন্ত পদ্ধতিতে স্বচ্ছতা, গতি, জবাবদিহিতা এবং মানবাধিকার সংক্রান্ত বিষয়ে অধিক গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে। তবে সেনাবাহিনীর দীঘদিনের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলাবদ্ধ ও প্রাতিষ্ঠানিক তদন্ত কাঠামো আগের মতোই বহাল রয়েছে,” জানিয়েছে আইএসপিআর।

প্রাণঘাতী গুলি চালানোর ক্ষেত্রে সশস্ত্র বাহিনীর নির্দেশিকা কেমন–– জানতে চেয়েছিল বিবিসি।

উত্তরে আইএসপিআর জানায়, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রাণঘাতী অস্ত্র শুধু অনুমোদিত রুলস অব এনগেজমেন্ট (Rules of Engagement-ROE) অনুযায়ী ব্যবহার করে থাকে, যেখানে সংবিধান ও প্রযোজ্য আইন অনুসরণ করে পরিস্থিতি অনুযায়ী প্রয়োজনীয় সকল বিধি কঠোরভাবে মেনে চলা হয়।

গত জুন মাসে কিশোরগঞ্জের কটিয়াদিতে যৌথ অভিযানে আটক ফিরোজা বেগম ও তার পরিবারের সদস্যদের বেধড়ক মারধরের অভিযোগ প্রসঙ্গে সেনাবাহিনীর অবস্থান এবং কোনো তদন্ত হলে তার অগ্রগতি জানতে চাওয়া হয়েছিল।

এ বিষয়ে আইএসপিআর জানায়, “গত ১৩ ও ১৪ জুন ২০২৫ তারিখে কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদী উপজেলায় সুনিদিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে পরিচালিত একটি যৌথ অভিযানে মাদক ব্যবসার সাথে সংশ্লিষ্ট থাকার অভিযোগে ফিরোজা বেগম নামে এক মাদক ব্যবসায়ীকে তার বাসা থেকে আটক করা হয় এবং ঘটনাস্থল থেকেই মহিলা পুলিশের উপস্থিতিতে তাকে থানায় হস্তান্তর করা হয়। যৌথ বাহিনীর এই অভিযানে অপরাধী কিংবা তার পরিবারের কোনো সদস্যকে মারধর এর অভিযোগ অসত্য। বরং অপরাধী নারী হওয়ায় বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা হয়। অভিযানে নারী পুলিশ অংশগ্রহণ করে এবং অপরাধীকে নারী পুলিশ গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যায়।”

ওই নারী থানায় অবস্থানকালে হঠাৎ শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে উপজেলা হাসপাতালে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে মৃত্যু বরণ করে বলে পরদিন জানা যায় উল্লেখ করে আইএসপিআর বলছে, “কর্তব্যরত মেডিকেল অফিসারের সুরতহাল রিপোর্ট এবং পরবর্তীতে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট এ কোনো ধরনের ইনজুরি পাওয়া যায়নি এবং এটিকে একটি স্বাভাবিক মৃত্যু হিসেবে ঘোষণা করা হয়”।

গোপালগঞ্জ, খাগড়াছড়ি, গাজীপুর ও মোহাম্মদপুরে গুলিতে প্রাণহানির ঘটনাগুলোর বাহিনী থেকে কী ধরনের তদন্ত ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে–– সেব্যাপারেও জানতে চেয়েছিল বিবিসি বাংলা।

প্রতিটি জেলার বিষয়ে আলাদাভাবে উত্তর দিয়েছে আইএসপিআর।

গোপালগঞ্জের ঘটনায় জাতীয় পর্যায়ে একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়েছে এবং কমিশন কর্তৃক ইতিমধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়েছে জানিয়ে আইএসপিআর বলছে, গত ১৭ জুলাই ২০২৫ তারিখে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমেও বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়েছে।

খাগড়াছড়ির গুইমারার ঘটনা নিয়ে আইএসপিআর বলছে, “পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সেনাবাহিনী আকাশে সতর্কতামূলক গুলি নিক্ষেপ করে। প্রাথমিক তথ্য ও বিশ্লেষণে ধারণা করা হয়, ইউপিডিএফ এর সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর গুলিতে উক্ত নিহতের ঘটনা ঘটে যা ইতিমধ্যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী গত ২৮শে সেপ্টেম্বর ২০২৫ তারিখে প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে স্পষ্ট করেছে”

এ বিষয়ে পুলিশ কর্তৃক একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে যার কার্যক্রম চলমান রয়েছে বলেও জানায় সংস্থাটি।

গত ২০শে ফেব্রুয়ারি মোহাম্মদপুরে গুলিবিদ্ধ হয়ে দুই জনের মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে আইএসপিআরের ব্যাখ্যা, সন্ত্রাসীদের “অতর্কিত গুলির” মুখে সেনাবাহিনীর আভিযানিক দলটি “আত্মরক্ষার্থে Rules of Engagement (ROE) অনুযায়ী যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করে”।

“ইতিমধ্যে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে গত ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ তারিখে প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে স্পষ্ট করা হয়েছে এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে” বলছে সংস্থাটি ।

গত বছর ৩০শে সেপ্টেম্বর গাজীপুরের আশুলিয়া ইন্ডাস্ট্রিয়াল এলাকার ঘটনা নিয়ে আইএসপিআরের দাবি, “মন্ডল নিটওয়ার এ মালিক-শ্রমিক অসন্তোষ সমাধানের আলোচনা চলাকালীন প্রায় পাঁচ/ছয় হাজার শ্রমিক ও একদল সন্ত্রাসী মিথ্যা গুজব ছড়িয়ে যৌথ বাহিনীর উপরে হামলা চালায় এবং সরকারি সম্পত্তি বিনষ্ট করে। শ্রমিকদের সাথে থাকা সন্ত্রাসীরা ইট পাটকেল ছোড়ার পাশাপাশি এলোপাথাড়ি গুলি ছোড়ে ও ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায়। এতে যৌথ বাহিনীর ১৪ জন সদস্য গুরুতর আহত হয়। যৌথ বাহিনীর টহল দল আত্মরক্ষার্থে Rules of Engagement (ROE) এর ধাপ অনুসারে যথাযথ নিয়ম অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করে এবং পরিস্থিতে নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। এ সময় সন্ত্রাসীদের এলোপাথাড়ি ছোড়া গুলিতে একজন ব্যক্তি নিহত এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়”।

“পরবর্তীতে, এ বিষয়ে গামেন্টস কর্তৃপক্ষ একটি হত্যা মামলা এবং সরকারি সম্পত্তি বিনষ্টের অপরাধে ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ একটি ফৌজদারি মামলা দায়ের করেছে যার কার্যক্রম চলমান রয়েছে”- বলছে আইএসপিআর।

BBC News বাং

জনপ্রিয় সংবাদ

চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙর করেছে পাকিস্তানি নৌযান ‘পিএনএস সাইফ’

বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগ তদন্ত নিয়ে কী বলছে সরকার, আইএসপিআর

০৪:৪৫:১৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ৮ নভেম্বর ২০২৫

শেখ হাসিনার শাসনামলে গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে বহু সমালোচনা হয়েছে। অতীতের মতো অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ও নির্যাতন, গুলিতে মৃত্যুর অভিযোগ থেমে নেই বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন মানবাধিকারকর্মীরা।

বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থানের পরে প্রাণঘাতী গুলি ও হেফাজতে নির্যাতনে বিচারবহির্ভূত হত্যার বেশকিছু অভিযোগ সুষ্ঠু তদন্ত হচ্ছে কি না সেই প্রশ্নও তুলেছেন তারা।

মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই সরকারের সময়ে সারা দেশে অন্তত ৪০টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের হিসেবে ওই সংখ্যা ৬০। অর্থাৎ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে গড়ে প্রতি মাসে চারটির বেশি বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা ঘটেছে।

বর্তমান সরকারের আমলে সংগঠিত বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনাগুলোর তদন্ত নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন মানবাধিকারকর্মী ও অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত গুম কমিশনের সদস্য নূর খান লিটন। গুলিতে মৃত্যুর প্রতিটি ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত হওয়া দরকার বলে মনে করেন তিনি।

“বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বা কাস্টডিয়াল টর্চারের যে কালচার সেটা থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী বা নিরাপত্তা বাহিনী বেরিয়ে আসছে এখন পর্যন্ত এইটা বলার সুযোগ নাই। অর্থাৎ বিগত সরকারের আমলে যে অবস্থাটা ছিল, তার থেকে আপনি কিছু ব্যতিক্রম পেতে পারেন। কিন্তু খুব বেশি যে উন্নতি হয়েছে সেটা বলার সুযোগ আসেনি। ইতিমধ্যে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন এই বিষয়গুলো নিয়ে প্রশ্ন তুলছে, পরিসংখ্যান দেখাচ্ছে,” বলেন তিনি।

গুলিতে মৃত্যুর ঘটনায় আলাদা বিশেষজ্ঞ কমিটির মাধ্যমে তদন্ত করা প্রয়োজন বলে মনে করেন গোপালগঞ্জে সহিংসতার ঘটনায় সরকারি তদন্ত কমিশনের সদস্য সাজ্জাদ সিদ্দিকী।

“পাঁচ অগাস্টের পরিণতির পরে আবারো যদি কেউ লেথাল উইপন ব্যবহার করে, কারো গুলিতে মারা যায়, তাহলে মানুষের আশার জায়গাটা থাকে না,” বলেন তিনি।

গোপালগঞ্জ, খাগড়াছড়ির মতো ঘটনায় গুলিতে মৃত্যুতে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ‘অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের’ অভিযোগ এবং প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের সমালোচনা করেন মানবাধিকারকর্মীরা।

এ ব্যাপারে আইএসপির বিবিসিকে জানিয়েছে, প্রাণঘাতী গুলি সেনাবাহিনী শুধু অনুমোদিত রুলস অব এনগেজমেন্ট অনুযায়ী ব্যবহার করে। এছাড়া যেকোনো অভিযোগ আসলে সেনা আইন অনুযায়ী তদন্ত হয়। বর্তমানে তদন্তে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও মানবাধিকার সংক্রান্ত বিষয়ে সেনাবাহিনী অধিকতর গুরুত্ব দিচ্ছে

প্রাণঘাতী গুলি ও তদন্ত নিয়ে উদ্বেগ

গত জুলাই মাসে এনসিপির গোপালগঞ্জ সফরকে ঘিরে সংঘর্ষে গুলিতে পাঁচ জনের মৃত্যু হয়। অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ ও গুলিতে একদিনে সর্বোচ্চ প্রাণহানীর ঘটনা এটি।

গোপালগঞ্জে ঘটনায় সেনাবাহিনীর অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের অভিযোগ করেছিলেন মানবাধিকারকর্মীরা।

ঘটনার পরদিন ১৭ই জুলাই সেনাবাহিনীর পক্ষে আইএসপির এক বিবৃতিতে বলেছিল ‘আত্মরক্ষার্থে বলপ্রয়োগে বাধ্য হয়েছে সেনাবাহিনী’।

গোপালগঞ্জে গুলির ঘটনায় বাহিনীর নিজস্ব কোনো তদন্ত হয়েছে কি না এমন প্রশ্নে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বিবিসি বাংলাকে জানানো হয়,

“গোপালগঞ্জে সংঘটিত ঘটনার প্রেক্ষিতে জাতীয় পর্যায়ে একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়েছে এবং কমিশন কর্তৃক তদন্ত প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়েছে”।

তবে, গোপালগঞ্জে ঘটনা তদন্তে সাবেক একজন বিচারপতির নেতৃত্বে সরকার যে তদন্ত কমিটি গঠন করে সেটি গুলির ঘটনা সেভাবে তদন্ত করেনি। সম্প্রতি এই কমিশন তাদের তদন্ত প্রতিবেদন সরকারের কাছে উপস্থাপন করেছে, তবে অন্তর্বর্তী সরকার তা এখনো জনসমক্ষে প্রকাশ করেনি।

সরকার গঠিত ওই তদন্ত দলের একজন সদস্য ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যান সাজ্জাদ সিদ্দিকী। বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, গোপালগঞ্জে কার গুলিতে মৃত্যু হয়েছে এ বিষয়টি তদন্ত করা কমিটির কার্যপরিধিতে ছিল না।

যে প্রতিবেদনগুলো আসছে, যে ভিডিও ফুটেজগুলো আসছে- তাকে উভয় পক্ষ থেকেই কিন্তু গুলির রেকর্ড পাওয়া গেছে, জানান তিনি।

“সাবোটাজ হওয়ার সম্ভাবনা একপাশ থেকে যেরকম আছে, আবার যারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ছিল তাদের পক্ষ থেকেও গুলিতে মারা গেছে এই সন্দেহ ছিল। এই জিনিসগুলো আমাদের টিওআর এর মধ্যে ছিল না যে কার গুলিতে মারা গেছে। এটা এখনো অমিমাংসিত। এটা হয়তো এক্সপার্ট যারা তারা করবে। তবে গুলিতে মারা গেছে এটা সত্য,” বলেন তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যান সাজ্জাদ সিদ্দিকী

গোপালগঞ্জে গুলিতে নিহত চারজনকে কবর থেকে উঠিয়ে পোস্ট মর্টেম করা হয়েছিল।

গোপালগঞ্জের পুলিশ সুপার বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, সবগুলোর ক্ষেত্রে একইরকম ভাষায় মতামত দেয়া হয়েছে।

পুলিশ সুপারের পাঠানো ইংরেজিতে লেখা সেই মতামতের অনুবাদ হলো–– “আমাদের অভিমত, মৃত্যুর কারণ ছিল রক্তক্ষরণ ও শক, যা পূর্ববর্তী আঘাতের ফলে ঘটেছে এবং হত্যাকাণ্ডের প্রকৃতির ছিল”।

গোপালগঞ্জ ছাড়াও এ সরকারের সময় খাগড়াছড়ির গুইমারা, আশুলিয়ায় শ্রমিক বিক্ষোভ, মোহাম্মদপুরে অভিযানে গুলিতে মৃত্যুর ঘটনা সমালোচিত হয়েছে।

মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের হিসেবে অন্তবর্তীকালীন সরকারের ১৪ মাসে গুলিতে মৃত্যু হয়েছে অন্তত ১৯ জনের। মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের হিসাবে এ সংখ্যা ২৯ জন।

গুলিতে মৃত্যুর কোনো ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও সে অনুযায়ী দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার নজির তৈরি করতে পারেনি এই সরকার, এমন হতাশা প্রকাশ করে মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন বলেন,

“গোপালগঞ্জের ঘটনা বলেন, আশুলিয়ার ঘটনা বলেন- যেখানে যেখানে ঘটনাগুলি ঘটেছে সেই জায়গাগুলোতে যদি একটা সুষ্ঠু তদন্ত করে জনসম্মুখে বলে দিক যে হ্যাঁ, এই ঘটনার প্রেক্ষিতে এইটা হয়েছে, তাহলে কিন্তু বিষয়টা বোঝা যেত। যে সরকারের তরফ থেকে বা বাহিনীগুলির তরফ থেকে তাদের সদস্যদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য, আইনের বাইরে গিয়ে কাজ করার জন্য শাস্তি পেতে হচ্ছে বা তাদেরকে বিচারের মুখোমুখী করছে। তাহলে জনগণ কিন্তু কিছুটা আস্থা পেতে পারতো”।

সার্বিকভাবে গুলির ঘটনাগুলো উদ্ঘাটনে সরকারের পদক্ষেপ নিয়ে সাজ্জাদ সিদ্দিকী বলেন, প্রাণঘাতী অস্ত্র বা লেথাল উইপন দিয়ে গুলিতে কেউ মারা গেছে সেটারও তদন্ত হচ্ছে না ঠিকমতো। কিংবা এটার জন্য সুনির্দিষ্টভাবে যে তদন্ত হওয়া দরকার, এই গুরুত্বটা অনুধাবন করা এই সরকারের দরকার ছিল।

“কার গুলিতে মারা গেল এটা কিন্তু একটা স্পেসিফিক টিওআর (কার্যপরিধি)। এই টিওআর’র জায়গায় কাজ করতে হবে একেবারে স্পেসিফিক এক্সপার্ট দিয়ে। আদারওয়াইজ আপনার প্রতি ট্রাস্ট আসবে না। সরকার সেই কাজগুলো করছে কি না সে জায়গায় যথেষ্ট সন্দেহ আছে। সেই জায়গায় একটা রিল্যাকটেন্স (অনীহা) এই যে বিগত সরকারের সময়ে যেরকম দেখা গিয়েছিল এই সরকারের সময়ে এই জায়গায় একটা রিল্যাকটেন্স আছে আমার কাছে মনে হয়”।

কিশোরগঞ্জে আটকের পর নারীর মৃত্যু

গুলিতে মৃত্যুর পাশাপাশি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আটকের পর তাদের হেফাজতে ২১ জনের মৃত্যুর অভিযোগ পাওয়া গেছে।

এ বছর ১৩ই জুন কিশোরগঞ্জে কটিয়াদীতে মাদকবিরোধী এক অভিযানে যৌথ বাহিনীর হাতে আটক হওয়ার পর ছয় ঘণ্টার মধ্যে মৃত্যু হয় এক নারীর।

ফিরোজা বেগম নামে ওই নারীর পরিবারের দাবি, তার স্বামী স্বপন মিয়াকে বাড়িতে না পেয়ে তাকে আটক করা হয়। গভীর রাতে তাকে থানা পুলিশে সোপর্দ করার পর ছয় ঘণ্টার মধ্যে মারা যান ফিরোজা বেগম।

পরিবার এবং প্রতিবেশীদের কাছে এই মৃত্যু অস্বাভাবিক। পরিবার মনে করে নির্যাতনের কারণেই তার মৃত্যু হয়েছে।

ফিরোজা বেগমের শাশুড়ি, প্রায় ৮০ বছর বয়সী আপেলা বেগম জানান, অভিযানের সময় তার সামনেই লাঠি দিয়ে তার ছেলের বৌকে পেটানো হয়। তাকে নারী পুলিশ একাধিক বাড়ি দেয়।

টেপ পেঁচানো একটি কাঠের লাঠি দেখিয়ে তিনি দাবি করেন, ওই লাঠি দিয়ে ফিরোজা বেগম এবং তাকে পেটানো হয়। সেটি ভুলে ওই বাড়িতে রেখে গিয়েছিলেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। পরে কাঠের লাঠিতে টেপ পেঁচিয়ে রেখেছেন ফিরোজা বেগমের মেয়ে সোমা।

একজন প্রতিবেশী নারী বিবিসিকে জানান, মৃত্যুর পর হাসপাতালে দেখতে গিয়ে কাপড় সরিয়ে ফিরোজা বেগমের শরীরে গুরুতর কালসিটে দাগ দেখতে পেয়েছিলেন তিনি।

একটি অন্ধকার ঘরে চোখ বাঁধা অবস্থায় বসে আছে একজন মানুষ, প্রতীকী ছবি

ফিরোজা বেগমের মেয়ে সোমা দাবি করেন, মৃত্যুর পর তার মায়ের শরীরে আঘাতের চিহ্ন ছিল। মায়ের মৃত্যুর তদন্ত এবং পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট নিয়েও তারা সন্তষ্ট নন।

সোমার অভিযোগ, অভিযানে আসা সেনাবাহিনী ও পুলিশের সদস্যরা তার মাকে পিটিয়েছে। তার ভাষায়, “আমার মা তো টর্চারেই মারা গেছে”।

ফিরোজা বেগমকে নির্যাতনের অভিযোগ ‘অসত্য’ বলে দাবি করেছে সেনাবাহিনী। পরিবারের অভিযোগ নিয়ে জানতে চাইলে আইএসপিআর থেকে বিবিসি বাংলাকে দেওয়া লিখিত বক্তব্যে বলা হয়,

“সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে ১৩ ও ১৪ই জুন যৌথ বাহিনীর অভিযানে মাদক ব্যবসার সাথে সংশ্লিষ্ট থাকার অভিযোগে ফিরোজা বেগম নামে এক মাদক ব্যবসায়ীকে তার বাসা থেকে আটক করা হয়। ঘটনাস্থল থেকেই মহিলা পুলিশের উপস্থিতিতে তাকে থানায় হস্থান্তর করা হয়। অপরাধী নারী হওয়ায় বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা হয়”।

আইএসপিআর’র দাবি, ফিরোজা বেগম থানাতে অবস্থানকালীন হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পরদিন সাড়ে নয়টার দিকে মৃত্যুবরণ করেন। কর্তব্যরত মেডিকেল অফিসারের সুরতহাল রিপোর্ট এবং পরবর্তীতে পোস্টমর্টেম রিপোর্টে কোনো ইনজুরি পাওয়া যায়নি এবং এটিকে একটি স্বাভাবিক মৃত্যু হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

নূর খান লিটন

ফিরোজা বেগমের পোস্টমর্টেম রিপোর্টে দেখা যায়, মৃত্যুর কারণ ‘কার্ডিয়াক ফেইলিয়র’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে সেখানে মতামতে প্রাথমিক রিপোর্টে তার শরীরে আঘাতের চিহ্ন থাকার কথা উল্লেখ আছে।

তবে যে ইনজুরি বা আঘাতের চিহ্ন ছিল সেটি ‘মৃত্যু ঘটানোর জন্য যথেষ্ট নয়’ বলে পোস্টমর্টেম রিপোর্টে বলা হয়।

কটিয়াদী থানার তদন্ত কর্মকর্তারা জানান, ফিরোজা বেগমের ‘স্বাভাবিক মৃত্যু’ হয়েছে উল্লেখ করে তদন্ত ও মামলা সমাপ্ত করে ফাইনাল রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে।

নূর খান লিটন বলেন, আগের আমলের যেভাবে বলা হত, এখনো একইভাবে বিষয়গুলোকে এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে

“প্রথম হচ্ছে আমাকে এডমিট করতে হবে যে হ্যাঁ এই ঘটনাগুলো ঘটছে, তাহলেই আমি কেবলমাত্র এর ঔষধ প্রয়োগ করতে পারব। কিন্তু আমি স্বীকার করবো না যতক্ষণ, ততক্ষণ পর্যন্ত এইটার থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য যে চেষ্টা সেটা আমরা করব না,” বলেন তিনি।

সরকার কী বলছে

বিচারবহির্ভুত হত্যার অভিযোগ এবং এর তদন্তগুলো পর্যালোচনা করে বোঝা যায়, এসব ঘটনার মামলা ও তদন্ত গতানুগতিক ধারায় চলছে। এ বিষয়ে মতামত জানতে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার দপ্তরে যোগাযোগ করে মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

কবে তদন্তের সমালোচনা নিয়ে সরকারের তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বিবিসি বাংলাকে বলেন,

“আমরা আমাদের জায়গা থেকে এগুলো সংস্কার করে রেখে দিয়ে যাইতে চাইতেছি। আমরা তো এক বছরের মধ্যে এটা স্বাধীন করতে পারি নাই। কিন্তু আমরা প্রক্রিয়াগুলো শুরু করছি। যেমন পুলিশে ইন্টারনালি, পুলিশের কেউ যদি এমন কিছু করে যেটা আইন ও মানবাধিকার বহির্তুভ, তাহলে কিন্ত সেটার তদন্ত হবে”।

“এই প্রবিশন আমরা গত এক বছরে সামনে নিয়ে আসতে পারছি। এইটা যদি প্র্যাকটিসে আসে তাহলেই কিন্তু তদন্তগুলো সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ হবে। কিন্তু প্র্যাকটিসটা তো আগেরই। লোকটা আগের, অফিসিয়ালরা আগের, ক্লায়েন্টাল রিলেশনশিপটা আগের। এটা তো হুট করে বদলায় নাই। এই প্রক্রিয়া যদি আরো চার-পাঁচ বছর, দশ বছর প্র্যাকটিসে আসে তখন তদন্তগুলো সুষ্ঠু হবে। না হলে তো হবে না। লোকগুলো তো একই আছে,” বলছেন মাহফুজ আলম।

তথ্য উপদেষ্টা  মাহফুজ আলম

বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে ক্রসফায়ারের ঘটনা অনেক কমেছে, গুমের অভিযোগও নেই। তবে প্রাণঘাতী গুলির ব্যবহার নিয়ে সমালোচনা আছে।

এ প্রশ্নে সরকারের অবস্থান এবং পদক্ষেপ নিয়ে তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেন, তারা আদর্শগতভাবে প্রাণঘাতী গুলি ব্যবহারের বিরোধী।

“প্রত্যেকটা জায়গাতেই হয়তো রাষ্ট্রের যুক্তি আছে যে কেন বাধ্য হইলো মারতে। কিন্তু আমরা তো অল আউট যেকোনো ধরনের মুভমেন্ট, প্রোটেস্টে লেথাল উইপনের বিরুদ্ধে। আমরা ব্যক্তিগতভাবে, রাজনৈতিকভাবে, আদর্শিকভাবে এটার বিরুদ্ধে। কিন্তু রাষ্ট্রে তো আইন, বিচার বা স্বরাষ্ট্রে যারা দায়িত্বে আছেন তাদের দিক থেকে যুক্তি আছে। যুক্তি ভালো কি খারাপ সেটা ইস্যু না। ইস্যু হচ্ছে যুক্তি তো আছে। আইন মন্ত্রণালয়ে জিনিসগুলো নিয়ে আসতে চেষ্টা করসে, যাতে কোনোভাবে, কোনো মুভমেন্টেই লেথাল উইপন ইউজ না করা হয়,” তিনি যুক্ত করেন।

তবে মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটনের দৃষ্টিতে বিচারবহির্ভূত হত্যা ও তদন্তের ক্ষেত্রে অতীতের ধারাবাহিকতাই বজায় রয়েছে। প্রাণঘাতী গুলির ব্যবহার এবং অতিরিক্ত বল প্রয়োগের ক্ষেত্রেও নিরাপত্তা বাহিনীর আচরণে খুব একটা পরিবর্তন হয়নি।

আইএসপিআরের লিখিত উত্তর

বিবিসির প্রশ্নের জবাবে যা জানিয়েছে আইএসপিআর

অন্তবর্তীকালীন সরকারের সময়ে গুলি ও নির্যাতনের অভিযোগের তদন্ত নিয়ে চারটি প্রশ্ন করেছিল বিবিবি বাংলা, যেগুলোর উত্তর দিয়েছে আন্তবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর)।

অভিযানে গুলি ও নির্যাতনের অভিযোগে সশস্ত্র বাহিনীর পক্ষ থেকে তদন্ত পরিচালনার ক্ষেত্রে অন্তবর্তীকালীন সরকারের সময়ে কোনো পরিবর্তন হয়েছে কি না, যদি হয় সেটি কেমন–– জানতে চেয়েছিল বিবিসি।

আইএসপিআর জানিয়েছে, “অপ্রত্যাশিত গুলি বা নির্যাতন সংক্রান্ত কোনো অভিযোগ উত্থাপিত হওয়ার সাথে সাথেই সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে সেনা আইন ও বিধি অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পরিসরে উপযুক্ত তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়”।

“সার্বিকভাবে বলা যায়, তদন্ত পদ্ধতিতে স্বচ্ছতা, গতি, জবাবদিহিতা এবং মানবাধিকার সংক্রান্ত বিষয়ে অধিক গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে। তবে সেনাবাহিনীর দীঘদিনের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলাবদ্ধ ও প্রাতিষ্ঠানিক তদন্ত কাঠামো আগের মতোই বহাল রয়েছে,” জানিয়েছে আইএসপিআর।

প্রাণঘাতী গুলি চালানোর ক্ষেত্রে সশস্ত্র বাহিনীর নির্দেশিকা কেমন–– জানতে চেয়েছিল বিবিসি।

উত্তরে আইএসপিআর জানায়, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রাণঘাতী অস্ত্র শুধু অনুমোদিত রুলস অব এনগেজমেন্ট (Rules of Engagement-ROE) অনুযায়ী ব্যবহার করে থাকে, যেখানে সংবিধান ও প্রযোজ্য আইন অনুসরণ করে পরিস্থিতি অনুযায়ী প্রয়োজনীয় সকল বিধি কঠোরভাবে মেনে চলা হয়।

গত জুন মাসে কিশোরগঞ্জের কটিয়াদিতে যৌথ অভিযানে আটক ফিরোজা বেগম ও তার পরিবারের সদস্যদের বেধড়ক মারধরের অভিযোগ প্রসঙ্গে সেনাবাহিনীর অবস্থান এবং কোনো তদন্ত হলে তার অগ্রগতি জানতে চাওয়া হয়েছিল।

এ বিষয়ে আইএসপিআর জানায়, “গত ১৩ ও ১৪ জুন ২০২৫ তারিখে কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদী উপজেলায় সুনিদিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে পরিচালিত একটি যৌথ অভিযানে মাদক ব্যবসার সাথে সংশ্লিষ্ট থাকার অভিযোগে ফিরোজা বেগম নামে এক মাদক ব্যবসায়ীকে তার বাসা থেকে আটক করা হয় এবং ঘটনাস্থল থেকেই মহিলা পুলিশের উপস্থিতিতে তাকে থানায় হস্তান্তর করা হয়। যৌথ বাহিনীর এই অভিযানে অপরাধী কিংবা তার পরিবারের কোনো সদস্যকে মারধর এর অভিযোগ অসত্য। বরং অপরাধী নারী হওয়ায় বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা হয়। অভিযানে নারী পুলিশ অংশগ্রহণ করে এবং অপরাধীকে নারী পুলিশ গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যায়।”

ওই নারী থানায় অবস্থানকালে হঠাৎ শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে উপজেলা হাসপাতালে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে মৃত্যু বরণ করে বলে পরদিন জানা যায় উল্লেখ করে আইএসপিআর বলছে, “কর্তব্যরত মেডিকেল অফিসারের সুরতহাল রিপোর্ট এবং পরবর্তীতে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট এ কোনো ধরনের ইনজুরি পাওয়া যায়নি এবং এটিকে একটি স্বাভাবিক মৃত্যু হিসেবে ঘোষণা করা হয়”।

গোপালগঞ্জ, খাগড়াছড়ি, গাজীপুর ও মোহাম্মদপুরে গুলিতে প্রাণহানির ঘটনাগুলোর বাহিনী থেকে কী ধরনের তদন্ত ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে–– সেব্যাপারেও জানতে চেয়েছিল বিবিসি বাংলা।

প্রতিটি জেলার বিষয়ে আলাদাভাবে উত্তর দিয়েছে আইএসপিআর।

গোপালগঞ্জের ঘটনায় জাতীয় পর্যায়ে একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়েছে এবং কমিশন কর্তৃক ইতিমধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়েছে জানিয়ে আইএসপিআর বলছে, গত ১৭ জুলাই ২০২৫ তারিখে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমেও বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়েছে।

খাগড়াছড়ির গুইমারার ঘটনা নিয়ে আইএসপিআর বলছে, “পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সেনাবাহিনী আকাশে সতর্কতামূলক গুলি নিক্ষেপ করে। প্রাথমিক তথ্য ও বিশ্লেষণে ধারণা করা হয়, ইউপিডিএফ এর সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর গুলিতে উক্ত নিহতের ঘটনা ঘটে যা ইতিমধ্যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী গত ২৮শে সেপ্টেম্বর ২০২৫ তারিখে প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে স্পষ্ট করেছে”

এ বিষয়ে পুলিশ কর্তৃক একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে যার কার্যক্রম চলমান রয়েছে বলেও জানায় সংস্থাটি।

গত ২০শে ফেব্রুয়ারি মোহাম্মদপুরে গুলিবিদ্ধ হয়ে দুই জনের মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে আইএসপিআরের ব্যাখ্যা, সন্ত্রাসীদের “অতর্কিত গুলির” মুখে সেনাবাহিনীর আভিযানিক দলটি “আত্মরক্ষার্থে Rules of Engagement (ROE) অনুযায়ী যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করে”।

“ইতিমধ্যে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে গত ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ তারিখে প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে স্পষ্ট করা হয়েছে এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে” বলছে সংস্থাটি ।

গত বছর ৩০শে সেপ্টেম্বর গাজীপুরের আশুলিয়া ইন্ডাস্ট্রিয়াল এলাকার ঘটনা নিয়ে আইএসপিআরের দাবি, “মন্ডল নিটওয়ার এ মালিক-শ্রমিক অসন্তোষ সমাধানের আলোচনা চলাকালীন প্রায় পাঁচ/ছয় হাজার শ্রমিক ও একদল সন্ত্রাসী মিথ্যা গুজব ছড়িয়ে যৌথ বাহিনীর উপরে হামলা চালায় এবং সরকারি সম্পত্তি বিনষ্ট করে। শ্রমিকদের সাথে থাকা সন্ত্রাসীরা ইট পাটকেল ছোড়ার পাশাপাশি এলোপাথাড়ি গুলি ছোড়ে ও ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায়। এতে যৌথ বাহিনীর ১৪ জন সদস্য গুরুতর আহত হয়। যৌথ বাহিনীর টহল দল আত্মরক্ষার্থে Rules of Engagement (ROE) এর ধাপ অনুসারে যথাযথ নিয়ম অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করে এবং পরিস্থিতে নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। এ সময় সন্ত্রাসীদের এলোপাথাড়ি ছোড়া গুলিতে একজন ব্যক্তি নিহত এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়”।

“পরবর্তীতে, এ বিষয়ে গামেন্টস কর্তৃপক্ষ একটি হত্যা মামলা এবং সরকারি সম্পত্তি বিনষ্টের অপরাধে ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ একটি ফৌজদারি মামলা দায়ের করেছে যার কার্যক্রম চলমান রয়েছে”- বলছে আইএসপিআর।

BBC News বাং