টানা সাতদিন ধরে জিপিএস বিভ্রাট
দিল্লির আকাশে গত এক সপ্তাহ ধরে একাধিক বিমানে গুরুতর জিপিএস স্পুফিংয়ের ঘটনা ঘটছে। পাইলট ও এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল (এটিসি) কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই বিভ্রাটের কারণে বিমানগুলোতে ভুল অবস্থান নির্দেশনা, ভুল ন্যাভিগেশন ডেটা ও মিথ্যা ভূখণ্ড সতর্কতা দেখা দিচ্ছে।
একজন শীর্ষ সরকারি কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বেসামরিক বিমান চলাচল অধিদপ্তর (ডিজিসিএ) ইতোমধ্যেই ঘটনাটি সম্পর্কে অবগত এবং তদন্ত শুরু করেছে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয়ের সচিব এস. কে. সিনহা ও ডিজিসিএর মহাপরিচালক ফয়জ কিদওয়াইয়ের মধ্যে এই বিষয়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে।
রাজধানীর ৬০ নটিক্যাল মাইল এলাকাজুড়ে বিভ্রাট
এটিসি সূত্রে জানা গেছে, দিল্লি থেকে ৬০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত এলাকাজুড়ে এই স্পুফিংয়ের ঘটনা ঘটছে। এতে স্বয়ংক্রিয় ন্যাভিগেশন ব্যাহত হওয়ায় অনেক ক্ষেত্রে এটিসি কর্মকর্তাদের সরাসরি নির্দেশনা দিতে হচ্ছে পাইলটদের।
একজন প্রধান এয়ারলাইনের পাইলট জানান, তিনি গত সপ্তাহে ছয়দিনই উড়ান চালানোর সময় জিপিএস বিভ্রাটের মুখোমুখি হয়েছেন। একবার দিল্লি বিমানবন্দরে নামার সময় তার ককপিট সিস্টেম ভুলভাবে ‘ভূখণ্ড সতর্কতা’ (terrain warning) জারি করে, যেখানে আসলে কোনও প্রতিবন্ধক ছিল না। আবার কেউ কেউ টেকঅফের সময়ও একই রকম সতর্কতা পান। এসব কারণে ব্যস্ত বিমানবন্দরে উড়ান বিলম্বের ঘটনাও ঘটছে।

সীমান্ত অঞ্চলে সাধারণ, দিল্লিতে অস্বাভাবিক ঘটনা
সূত্ররা জানিয়েছেন, পাকিস্তান সীমান্ত এলাকায় এ ধরনের জিপিএস স্পুফিং মাঝে মাঝে ঘটলেও দিল্লির মতো কেন্দ্রীয় অঞ্চলে এমন ঘটনা অত্যন্ত বিরল। এছাড়া দিল্লির আকাশসীমায় কোনো সামরিক মহড়ার বিষয়ে বিমান ও এটিসিকে সতর্ক করার কোনও সরকারি নির্দেশনাও জারি করা হয়নি।
কী এই জিপিএস স্পুফিং
স্পুফিং এক ধরনের সাইবার আক্রমণ, যেখানে কৃত্রিম জিপিএস সংকেত পাঠিয়ে বিমান বা অন্য যানবাহনের ন্যাভিগেশন সিস্টেমকে বিভ্রান্ত করা হয়। এতে বিমান ভুল অবস্থান ধরে নিতে পারে, যদিও আধুনিক বিমানে একাধিক বিকল্প ব্যবস্থা থাকায় তাৎক্ষণিক ঝুঁকি সাধারণত কম থাকে।
আন্তর্জাতিক সংস্থার সতর্কবার্তা
আন্তর্জাতিক বিমান সংস্থা আইএটিএ (IATA) এবং জাতিসংঘের বিমান নিরাপত্তা সংস্থা আইসিএও (ICAO) ইতিমধ্যেই সতর্ক করেছে যে, এই ধরনের জিপিএস বিভ্রাট বিশ্বব্যাপী বিমান নিরাপত্তার জন্য এক ক্রমবর্ধমান হুমকি।
আইএটিএর তথ্যমতে, ২০২১ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে জিপিএস সংকেত হারানোর ঘটনাগুলো ২২০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে।
ভারতের পার্লামেন্টে প্রতিবেদন
২০২৫ সালের মার্চে সংসদে উপস্থাপিত মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে সীমান্ত এলাকায়—বিশেষত আমৃতসর ও জম্মু অঞ্চলে—মোট ৪৬৫টি জিপিএস হস্তক্ষেপ ও স্পুফিংয়ের ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে।
এরপর ২০২৩ সালের নভেম্বরে ডিজিসিএ বিমান সংস্থাগুলিকে নির্দিষ্ট মানসম্মত অপারেশন পদ্ধতি (SOP) তৈরির নির্দেশ দেয় এবং স্পুফিং সংক্রান্ত ঘটনাগুলোর ওপর দুই মাস অন্তর প্রতিবেদন জমা দিতে বলে।

নিরাপত্তা ব্যবস্থার নিশ্চয়তা
বিশেষজ্ঞরা জানান, জিপিএস স্পুফিং নিজে থেকেই বিমানের নিরাপত্তা বিপন্ন করে না। আধুনিক বিমানে বিকল্প ন্যাভিগেশন সিস্টেম যেমন ‘ইনারশিয়াল রেফারেন্স সিস্টেম’ (IRS) বিদ্যমান থাকে, যা প্রাথমিক সিস্টেম ব্যর্থ হলেও পাঁচ ঘণ্টা পর্যন্ত সঠিকভাবে কাজ চালিয়ে যেতে সক্ষম।
দিল্লির আকাশে টানা সাতদিনের এই জিপিএস স্পুফিং ঘটনায় বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। যদিও তাৎক্ষণিক নিরাপত্তা ঝুঁকি এড়ানো গেছে, তবুও বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন—এটি ভবিষ্যতের সাইবার আক্রমণ প্রতিরোধ ও বিমান নিরাপত্তা জোরদারের প্রয়োজনীয়তার এক বড় সংকেত।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















